এক দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি বিএনপিতে, খবর নেই ‘যৌথ ঘোষণার’

বিএনপির লোগো

প্রায় এক বছর ধরে সরকারবিরোধী নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, সরকার হটানোর এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা শিগগিরই আসছে। চলমান কর্মসূচিগুলো তারই প্রস্তুতি পর্ব। তবে এই আন্দোলনে শরিক অন্য দলগুলোর সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত চুক্তি বা যৌথ ঘোষণা দিতে পারেনি বিএনপি।

গত পাঁচ মাসে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের (এখন ছয়টি দল ও সংগঠনের জোট) নেতারা একাধিকবার বৈঠক করেও সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্ত করতে পারেননি। এটাকে বিএনপির নেতৃত্বের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছেন যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা। তাঁরা মনে করছেন, যৌথ ঘোষণায় যত বিলম্ব হবে, আন্দোলনের তত ক্ষতি হবে।

গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে আন্দোলন সমন্বয়ের জন্য গঠিত বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নানামুখী কর্মসূচিতে আছি। ওনারাও (গণতন্ত্র মঞ্চ) আন্দোলনে আছেন। পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতার কারণেই কিছুটা সময় যাচ্ছে। এটা (ঘোষণাপত্র) নিয়ে কাজ হচ্ছে। আশা করি, খুব তাড়াতাড়ি একটা সমঝোতার ভিত্তিতে এটা প্রকাশ্যে আসবে।’

আরও পড়ুন

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বড় আন্দোলন গড়তে হলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের যুক্ততা জরুরি। এর জন্য আন্দোলনে সমাজের নানা অংশের সম্পৃক্ততা বাড়াতে তাঁদের আকাঙ্ক্ষা এবং পরিবর্তনের সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার এক মঞ্চ থেকে ব্যক্ত করতে হবে। সে কাজ করতে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে এমন একাট্টা ভাব তৈরি করতে হবে, যাতে মানুষের মধ্যে একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ জন্য বিরোধী দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার পাশাপাশি লিখিত অঙ্গীকারনামা থাকা জরুরি।

গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলছেন, তাঁরা চেয়েছিলেন, কিসের ওপর ভিত্তি করে বিরোধী দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাল, আন্দোলনের ভিত্তি কী, নির্বাচনে জয়ী হলে সরকারে গিয়ে কী কী পরিবর্তন আনা হবে, সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, মানবাধিকার এবং অধিকার হরণকারী আইনগুলোর বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, কোন কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি যৌথ ঘোষণায় থাকবে; যাতে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়। অতীতে সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়েও এ ধরনের যৌথ ঘোষণা (তিনদলীয় রূপরেখা) দেওয়া হয়েছিল।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন পরেও আন্দোলনের যৌথ ঘোষণা দিতে না পারাটা দুঃখজনক। আমি মনে করি, এটা চলমান আন্দোলনের একটা দুর্বল দিক। এখানে সংকটটা বিএনপির, অন্য কারও নয়। তাদের উচিত ছিল নিজ দলের অভ্যন্তরে আলোচনা করে অবস্থানটা পরিষ্কার করা।’
তবে সাইফুল হক এ-ও মনে করেন, সময় শেষ হয়ে যায়নি। যদিও একটি দিন, একটি মুহূর্তও নষ্ট করার সময় আর নেই।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

গত ৩০ ডিসেম্বর বিএনপি ‘ভোট ডাকাতি’ দিবস পালন করে। সেদিন ‘গণমিছিলের’ কর্মসূচি দিয়ে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও জোট যুগপৎ কর্মসূচি পালন শুরু করে। যদিও প্রথম কর্মসূচির আগেই বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে চেয়েছিল গণতন্ত্র মঞ্চ; কিন্তু গত পাঁচ মাসেও তা পারা যায়নি।

চাওয়া গণতন্ত্র মঞ্চের, বাগড়া অন্যদের

যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণার চাওয়াটি মূলত গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে আসে। এ নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়, এমনকি যৌথ ঘোষণার খসড়াও তৈরি হয়। কিন্তু হঠাৎ যৌথ ঘোষণাপত্র নিয়ে আপত্তি তোলে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের বাইরের অন্য শরিকেরা। কারণ, তারা মনে করছে, শুধু গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপি যৌথ ঘোষণা দিলে তাতে তারা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব হারাবে।

এমন প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র মঞ্চ সম্মত হয়, আন্দোলনে থাকা সব দল ও জোটকে সঙ্গে নিয়েই যৌথ ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সবার সঙ্গে আলোচনা করে যৌথ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। তাতেও কাজ হয়নি।

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন সংসদ নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলন করছে একাধিক দল ও জোট। গণতন্ত্র মঞ্চ ছাড়াও এ আন্দোলনে রয়েছে ১২–দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। এর বাইরে অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি ও গণফোরামও (মন্টু) যুগপৎ কর্মসূচি পালন করছে।

এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে গণ অধিকার পরিষদ এবং ১২–দলীয় জোট থেকে বাংলাদেশ লেবার পার্টি বেরিয়ে গেছে। তবে দুটি দলই যুগপৎ আন্দোলনে থাকার কথা জানিয়েছে।

এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমদ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে (যৌথ ঘোষণা) আমি অবগত নই। বিএনপির দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। তাদের জন্য যেটা সুবিধাজনক হয়, তারা সে সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা তাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করব।’

আরও পড়ুন

দাবি-দফার সংখ্যা নিয়ে জটিলতা

গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গোলাপবাগে বিভাগীয় সমাবেশ থেকে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনের জন্য ১০ দফা দাবি এবং রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কারের ব্যাপারে ২৭ দফা প্রস্তাব দেয়। দলের জ্যেষ্ঠ নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন এসব দাবি-দফা উপস্থাপন করেন। পরে গণতন্ত্র মঞ্চও ১৪ দফা কর্মসূচি দেয়। বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের দাবি–দফা সমন্বয় করে ঘোষণাপত্র তৈরির কাজ হচ্ছিল বলে বিভিন্ন সময়ে দুই পক্ষের নেতারা জানিয়েছেন।

অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যৌথ ঘোষণার কাজ চলছে। আর এটা দেওয়ারও তো একটা সময় আছে। সঠিক সময়ে এটা দিতে হবে। আমরা আলোচনা করেই সময়টা নির্ধারণ করে নেব। এটার জন্য আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

বিএনপির জ্যেষ্ঠ এক নেতা জানান, দলের স্থায়ী কমিটির এক সভায় যৌথ ঘোষণাপত্র নিয়ে কয়েকজন নেতা আলোচনা করেন। তাঁরা বিএনপির দাবি-দফা অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে মত দেন। তাঁদের মতে, বিএনপির ঘোষিত ১০ দফা দাবি এবং রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কারের ২৭ দফা প্রস্তাব ইতিমধ্যে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। এ ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে পুস্তিকা, প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করছে গণতন্ত্র মঞ্চ
ফাইল ছবি

এখন গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফা সমন্বয় করতে গেলে দাবি ও দফার সংখ্যা বেড়ে যাবে। এই পরিবর্তন নেতিবাচক হতে পারে। এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থায়ীভাবে ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতার ভারসাম্য এবং জবাবদিহি তৈরি করতে হবে। এ জন্য সংবিধান সংস্কারের যে অপরিহার্য বিষয়গুলো আছে, সেগুলো নিয়ে আমরা একটা মীমাংসার জায়গায় পৌঁছেছি। এরপরও কোনো বিষয়ে আপত্তি থাকলে (বিএনপির দিক থেকে) সেটি জানালে নিশ্চয়ই আমরা এক জায়গায় সমঝোতায় পৌঁছাতে পারব।’

বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা অন্য বিরোধী দলগুলোর নেতাদের মত হচ্ছে, শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, রাষ্ট্রকাঠামোয় গুণগত পরিবর্তন দরকার। বিশেষ করে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার পরিবর্তন দরকার। সমাজের নানা অংশের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারলেই কেবল চলমান আন্দোলন সফল পরিণতির দিকে যাবে।