জিয়া হত্যাকাণ্ড ও তারপর কী ঘটেছিল

৪৩ বছর আগে রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিহত হন সেনাবাহিনীর বিপথগামী একদল সদস্যের হাতে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোররাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যাঁরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, ঘটনার দুই দিনের মধ্যে তাঁদের দমন করা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ড, তারপর কী ঘটেছিল, সেই দুই দিনে?

জিয়াউর রহমানছবি: সংগৃহীত

জিয়াউর রহমান ঘটনার আগের দিন তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির স্থানীয় নেতাদের বিরোধ মেটাতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন মাত্র ৪৮ ঘণ্টার নোটিশে। চট্টগ্রামে দুটি উপদলে বিভক্ত বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ২৯ মে রাতে স্থানীয় সার্কিট হাউসে ঘুমিয়ে ছিলেন জিয়াউর রহমান। ভোররাতে সেখানেই তাঁকে হত্যা করা হয়।

৩০ মে ভোরে গোলাগুলির আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরীর। ডিসির বাংলো থেকে সার্কিট হাউসের দূরত্ব মাইলখানেক হবে। সকালেই তিনি বাংলো সার্কিট হাউসে গিয়ে জিয়াউর রহমানের মৃতদেহের বীভৎস দৃশ্য দেখেছিলেন। সেই থেকে জেলা প্রশাসক হিসেবে ঘটনাপ্রবাহ কাছে থেকে দেখেছেন তিনি।

‘দুই জেনারেলের হত্যাকাণ্ড, ১৯৮১-র ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান’ এই শিরোনামে একটি বই লিখেছেন জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, গোলাগুলি থেমে যাওয়ার পর ভোরেই একজন সহকারী প্রটোকল অফিসার মোশতাক তাঁকে ফোন করে কিছু তথ্য দেন।

ওই সহকারী প্রটোকল অফিসারের বরাত দিয়ে বইয়ে জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী লিখেছেন, ‘ভোর চারটার দিকে সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি গুলি করতে করতে সার্কিট হাউসে প্রবেশ করে। সে (সহকারী প্রটোকল অফিসার) জানে না পুলিশ বা প্রেসিডেন্টের গার্ড তাদের বাধা দিতে পেরেছিল কি না। তবে তারা গুলি করতে করতে সার্কিট হাউসে ঢুকে যায়। মোশতাক লাউঞ্জে বসে ছিল। সেনারা প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সে পাশের ডাইনিং রুমের টেবিলের নিচে লুকিয়ে পড়ে। এরপর সে শুনতে পায় ভারী বুটের আওয়াজ। কয়েকজন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে প্রেসিডেন্টের রুমের দিকে যায়। এরপর সে আরও গুলির আওয়াজ শুনতে পায়। কয়েক মিনিট পর ওপরের লোকগুলো নিচে চলে আসে আর তার কিছুক্ষণ পর শোনে গাড়ির আওয়াজ। সে বুঝল, যারা এসেছিল, তারা চলে গেছে। সে এত ভয় পেয়েছিল যে গাড়িগুলো চলে যাওয়ার পর সে পালিয়ে এসে গ্যারেজ থেকে আমাকে ফোন করেছে।  আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, প্রেসিডেন্ট কী অবস্থায় আছেন, সে জানে কি না, উত্তরে সে জানাল, এ ব্যাপারে এখনো কিছুই জানে না সে।’

এরপর অল্প সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার সাইফুদ্দিন ফোন করে জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরীকে জানান যে, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া আততায়ীদের হাতে খুন হয়েছেন।’

ঘটনা সম্পর্কে এ সব তথ্য পাওয়ার পর পরই বিভাগীয় কমিশনারকে সঙ্গে নিয়ে সার্কিট হাউসে যান জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী। সেখানে পৌঁছে দেখেন সার্কিট হাউস প্রায় পরিত্যক্ত একটা ভবন। চারপাশে কোনো প্রহরা ছিল না, ছিল না কোনো পুলিশ, ছিল না সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য।  সার্কিট হাউসের লনে দেখতে পান দাঁড়িয়ে আছেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনার, ডিআইজি পুলিশ ও পুলিশের গোপন শাখার সহকারী কমিশনার।

জেলা প্রশাসক হিসেবে জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী সে সময় পুলিশের গোপন শাখার সহকারী কমিশনার আবদুস সাত্তারকে নিয়ে সার্কিট হাউসের ওপরতলায় যান পরিস্থিতি দেখতে। সেই পরিস্থিতিরও বর্ণনা দিয়েছেন তিনি তাঁর বইয়ে।

জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী। তিনি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন
ছবি: আশরাফুল আলম

সার্কিট হাউসের ওপরতলায় পড়ে ছিল মৃতদেহ

জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী লিখেছেন, ‘সিঁড়ি ভেঙে ওপরতলায় গিয়েই দেখি, প্রেসিডেন্টের কামরার ঠিক দরজায় পড়ে আছে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি মৃতদেহ। তার পাশে দাঁড়িয়ে একজন প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড! সাত্তার আমাকে মৃতদেহের দিকে আঙুল দিয়ে বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়ার লাশ।’ তিনি কাপড় ওঠাতেই দেখলাম এক বীভৎস দৃশ্য। গুলির আঘাতে আঘাতে জিয়ার মুখে একপাশ উড়ে গিয়েছিল।’

সার্কিট হাউসের সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে একই রকম বর্ণনা দেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন একজন মেজর রেজাউল করিম রেজা।

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকার শ্যামলী এলাকায় তাঁর বাসায়। রেজাউল করিম প্রথম আলোকে জানান, ৩০ মে ভোরে তাঁকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের তাঁর বাসভবন থেকে ডেকে নেওয়া হয় সদর দপ্তরে। সেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কর্নেল মতিউর রহমান তাঁকে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘তুমি কি জানো, প্রেসিডেন্ট জিয়া কিল্ড।’ এর উত্তরে তিনি বলেন, তিনি জানেন না। কারণ, তিনি রাতে বাসায় ঘুমিয়ে ছিলেন।

এ ধরনের জবাবে মেজর রেজাউল করিমের ওপর কর্নেল মতিউর রহমান ক্ষুব্ধ হন বলে তাঁর তখন মনে হয়। তবে তাঁকে তখনই সার্কিট হাউসে যেতে বলা হয়।

মৃতদেহ নেওয়া হয় পাহাড়ে

রেজাউল করিম বলেন, ‘কিছু ট্রুপস (সৈন্য) সঙ্গে নিয়ে জিয়াউর রহমানের ডেডবডি (মৃতদেহ)  সার্কিট হাউস থেকে নিয়ে পাহাড়ের ভেতরে কোথাও কবর দেওয়ার জন্য আমাকে নির্দেশ দেন কর্নেল মতিউর রহমান। আমি তখন তাঁকে বললাম যে আমাকে অন্য কাজ দেন। তারপর উনি মেজর শওকত আলীকে ডেকে ওই দায়িত্ব দিলেন আর আমাকে বললেন, তুমি এদের সঙ্গে যাও।  গিয়ে সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের সৈন্যদের নিয়ে আসবে।’

সার্কিট হাউসে যাওয়ার পর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠেই মেজর রেজাউল করিমও সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা মৃতদেহ দেখতে পান। এর বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দেখি একটা ডেডবডি সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা আছে। পাশে একজন প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কার ডেডবডি? সে বলল, এটা রাষ্ট্রপতির। আমি বললাম কাপড়টা খোলো। সেটা খোলার পর দেখলাম তাঁর মাথাটা। ভয়াবহ অবস্থা।’

রেজাউল করিম সেখানে কাছাকাছি দূরত্বেই পড়ে থাকতে দেখেন জিয়াউর রহমানের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্নেল এহসান এবং ক্যাপ্টেন হাফিজের মৃতদেহ।
 সেনাবাহিনীর সাবেক এই মেজর উল্লেখ করেন, মেজর শওকত আলীর নেতৃত্বে যে দল তাঁর সঙ্গে ছিল, তারা জিয়াউর রহমানসহ তিনজনকে নিয়ে তাদের আনা পিকআপে ওঠায়। এরপর দলটির কিছু সদস্য সেনাবাহিনীর অন্য গাড়ি নিয়ে ওই পিকআপকে পাহারার জন্য থাকেন। তাঁরা তখন জিয়াউর রহমান ও অন্য দুজনের মৃতদেহ কবর দিতে পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে যান।

আর মেজর রেজাউল করিম সার্কিট হাউসে প্রেসিডেনশিয়াল গার্ডের যে কজন সদস্য সে সময় ছিলেন, তাঁদের নিয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে চলে যান।

মেজর (অব.) রেজাউল করিম
ছবি: প্রথম আলো

‘চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ছিল যুদ্ধের পরিবেশ’

রেজাউল করিম সার্কিট হাউস থেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ফিরে এসে দেখেছিলেন তাঁর মতো যেসব সেনা কর্মকর্তা হয়তো ছুটিতে ছিলেন অথবা অন্য কোনো কাজে ছিলেন, তাঁদের ডেকে এনে বিভিন্ন দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে একটি যুদ্ধের পরিবেশ ছিল।

মেজর রেজাউল করিমের কাঁধে চাপে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের তখনকার জিওসি মেজর জেনারেল এ মঞ্জুরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব। তিনি বলেন, ‘এই দায়িত্ব দেওয়ার সময় জেনারেল মঞ্জুর তাঁকে বলেছিলেন, ওদের (যারা হত্যাকাণ্ডে ছিল) মাথা তো গরম। তোমার মাথা ঠান্ডা আছে। তুমি ঠান্ডা মাথায় প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্বটা পালন করতে পারবে।’

মেজর জেনারেল এ মঞ্জুর ৩০ মে সকাল থেকে সারা দিন কর্মকর্তা ও সৈন্যদের বিভিন্ন ব্যারাকে ঘুরে ঘুরে বক্তব্য দেন। প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব পাওয়া মেজর রেজাউল করিমকে সারা দিন জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে থাকতে হয়েছে। তিনি জানান, জেনারেল মঞ্জুর যখন সেনানিবাসের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন একপর্যায়ে তাঁর কাছে ঢাকা সেনানিবাস থেকে একটি টেলিফোন আসে। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো যে জেনারেল এরশাদ মেজর জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু জেনারেল মঞ্জুর জেনারেল এরশাদের সঙ্গে কথা বলতে অনাগ্রহ দেখিয়ে ফোন রেখে দিয়েছিলেন।

রেজাউল করিম বলেন, ‘ফোনের অপর প্রান্ত থেকে যখন বলছে, জেনারেল এরশাদের সঙ্গে কথা বলেন, তখন জেনারেল মঞ্জুর বলেন, আই ক্যান নট টক টু এরশাদ। এ কথা বলে তিনি টেলিফোনটা রেখে দিলেন। আবার টেলিফোন আসল। আবার টেলিফোনে বলা হলো, ফর গড সেক স্যার, ফর গড সেক—ইউ টক টু জেনারেল এরশাদ। জেনারেল মঞ্জুর এমনভাবে ধরেছিলেন টেলিফোনটা, আমি ক্লিয়ার শুনতে পাচ্ছিলাম। জেনারেল মঞ্জুর আবার বললেন, আই ক্যান নট টক টু হিম। এ কথা বলে টেলিফোনটা রেখে দিলেন।’

জেনারেল মঞ্জুর সেনা সদস্যদের ব্যারাকে গিয়ে গিয়ে ৩০ মে সারা দিন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তিনি মূলত মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ও পাকিস্তানফেরত কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্বের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি পাকিস্তানফেরত কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কথা বলেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এ সব বক্তব্যে বিপ্লবী সরকার গঠনের কথাও বলা হয়েছিল।

ঢাকায় সাত্তারের নেতৃত্বে সরকার

জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময় দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে ৩০ মে দুপুরের দিকে রেডিও-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর সরকারের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ ও বিএনপির অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রম। তিনি পরে ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারের পূর্ণ মন্ত্রী হয়েছিলেন। কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বিএনপি ছেড়ে এলডিপি গঠন করেন ২০০৬ সালে।

অলি আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ৩০ মে সকাল সাড়ে আটটার দিকে বঙ্গভবন থেকে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব তাঁকে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানান। এরপর তিনি দ্রুত বঙ্গভবনে যান। সে সময় সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ, বিমান এবং নৌবাহিনীর প্রধানসহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন। তাঁরা সবাই বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

পরদিন দ্রুত পাল্টায় পরিস্থিতি

জিয়াউর রহমানকে হত্যার দিন, অর্থাৎ ৩০ মে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে যে যুদ্ধ পরিস্থিতি ছিল, সেটি তার পরের দিন দ্রুত পাল্টাতে থাকে।

জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় হান্নান শাহ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদায় চট্টগ্রাম মিলিটারি একাডেমিতে কর্মরত ছিলেন। তিনি পরে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি ৭৭ বছর বয়সে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যান।

বিএনপির প্রয়াত নেতা হান্নান শাহ
ফাইল ছবি

জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে হান্নান শাহের মৃত্যুর ৫ বছর আগে ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম। তখন তিনি বলেছিলেন, ৩০ মে তাঁকে মিলিটারি একাডেমি থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে বিদ্রোহের পক্ষে সমর্থন চাওয়া হয়েছিল। তিনি তাতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। পরে ৩১ মে ঢাকার সঙ্গে সমঝোতার জন্য মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে অনুরোধ করা হলে তিনি তাতে যুক্ত হন। ৩১ মে সারা দিন হান্নান শাহ ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন।

হান্নান শাহ আমাকে জানিয়েছিলেন, ৩১ মে বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত সৈনিক এবং অফিসারদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। বিদ্রোহীদের পক্ষ ত্যাগ করে অনেকেই বিচারপতি সাত্তার সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এসব খবর পেয়ে জেনারেল মঞ্জুর বিচলিত হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে চট্টগ্রাম সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যান জেনারেল মঞ্জুর ও আরও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা।

৩১ মে রাতের ঘটনা প্রবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে হান্নান শাহ বলেছিলেন, ‘৩১ মে রাতে জেনারেল মঞ্জুরের অফিসে বৈঠক চলছিল। আমিও সেই বৈঠকে ছিলাম। রাত ১১টার দিকে জেনারেল মঞ্জুরের বাসা থেকে হঠাৎ একটি ফোন আসে। তিনি আমাকে এবং আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে বসিয়ে রেখে ওনার অফিস থেকে বাসায় যান। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরও তিনি ফিরে এলেন না। এমন অবস্থায় অন্য অফিসারদের তাঁদের কর্মস্থলে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আমার কর্মস্থল মিলিটারি একাডেমিতে ফিরে আসলাম। ইতিমধ্যে আমি জানতে পারলাম, জেনারেল মঞ্জুর তাঁর পরিবার নিয়ে এবং অন্যান্য বিদ্রোহী অফিসাররা পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে গেছেন।’

শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ

মেজর জেনারেল মঞ্জুরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা মেজর রেজাউল করিম ওই গাড়ির বহরে ছিলেন, যে বহরে জেনারেল মঞ্জুর ও কর্নেল মতিউর রহমান পালিয়েছিলেন।

রেজাউল করিম জানান, গাড়ির বহর চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকা হয়ে খাগড়াছড়ি যাওয়ার জন্য কিছু দূর অগ্রসর হয়ে একটি পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছানোর পর সামনে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান তাঁরা। তখন তাঁরা লক্ষ করেন সামনে কিছু সৈন্য পাহাড়ের দিকে ছুটোছুটি করছে। সে সময় জেনারেল মঞ্জুর গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। কিন্তু তাঁদের বহনকারী গাড়িটি হঠাৎ বিকল হয়ে পড়ে।

তখন তাঁরা অন্য আরেকটি গাড়িতে করে পেছনের দিকে চলে আসেন। সেখানে তাঁরা কর্নেল মতিউর রহমান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। রাস্তায় ওই গোলাগুলি সময়ই কর্নেল মতিউর রহমানকে হত্যা করা হয় বলে রেজাউল করিমের ধারণা।

রেজাউল করিম উল্লেখ করেন, জেনারেল মঞ্জুর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিকল গাড়ি ফেলে রেখে তাঁরা একটি গ্রামে হাঁটা শুরু করেন। এলাকাটিতে চা–বাগান ছিল। জেনারেল মঞ্জুর তখন চা–বাগানের এক কুলির বাড়িতে যান। কারণ, তাঁর সন্তানেরা ছিল ক্ষুধার্ত। সেখানে জেনারেল মঞ্জুরের সন্তানদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।

আরও পড়ুন

রেজাউল করিম বলছিলেন, ‘তাঁরা যখন খেতে বসেছিলেন, তখন হঠাৎ কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দ শুনতে পাই। তখন আমরা লক্ষ করলাম বেশ কিছুটা দূরে পাহাড়ি এলাকায় খাকি পোশাকের পুলিশ দেখা যাচ্ছে। তখন জেনারেল মঞ্জুর বললেন যে আমি পুলিশের কাছে সারেন্ডার করব। পুলিশ সদস্যরা যখন সামনের দিকে এগিয়ে আসছিলেন তখন জেনারেল মঞ্জুর জঙ্গলের ভেতরে দাঁড়িয়ে যান।’

রেজাউল করিমের বর্ণনা অনুযায়ী জেনারেল মঞ্জুর তখন পুলিশের উদ্দেশে বলেন, ‘এই যে বাবারা, তোমরা ওখানে থাকো। সামনে আসিবে না। সামনে আসিলে তোমাদের অসুবিধা হইবে। আমি আসিতেছি। এ কথা বলে হনহন করে হেঁটে গিয়ে সারেন্ডার করলেন। তারপর আমিও গিয়ে সারেন্ডার করলাম।’

আত্মসমর্পণের পর তাঁদের হাটহাজারী থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জেনারেল মঞ্জুর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা বললেন যে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না।

মেজর জেনারেল এম আবুল মঞ্জুর
ছবি: সংগৃহীত

জেনারেল মঞ্জুরকে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তখন সেখানে একদল সেনা সদস্য আসেন।

রেজাউল করিম বলেন, ‘একজন সেনা সদস্য জেনারেল মঞ্জুরের স্ত্রীকে বলল, ভাবি আমরা আপনাদের নিতে এসেছি। কিন্তু জেনারেল মঞ্জুরের স্ত্রী বললেন তাঁরা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন এবং চট্টগ্রাম জেলে যাবেন। তিনি সৈন্যদের সঙ্গে সেনানিবাসে যেতে অস্বীকৃতি জানান।’

তখন জেনারেল মঞ্জুর সেনা সদস্যদের বলেন , ‘তোমাদের লজ্জা করে না? তোমরা সব ঘটনা ঘটাইলা, তোমরা আবার সারেন্ডার করলা। তোমরা আইছো আমাকে ধইরা নিতে। যাও, আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না।’

সে সময় একজন নায়েব সুবেদার এসে জেনারেল মঞ্জুরের হাত ধরে টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনেন এবং তাঁর হাত ও চোখ বেঁধে ফেলেন।

রেজাউল করিম জানান, জেনারেল মঞ্জুরের পরিবারের সদস্যদের ভিন্ন গাড়িতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে এনে তাঁদের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
পরে জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এবং সেই হত্যা মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি।

মৃতদেহের খোঁজ

শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ১ জুন জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ খুঁজতে বের হয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ কয়েকজন সিপাহি, একটি ওয়্যারলেস সেট এবং একটি স্ট্রেচার নিয়ে। তাঁর সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যও ছিলেন। তাঁরা ধারণা করে রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি এলাকায় যান।

গ্রামবাসীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হান্নান শাহ সৈন্যদের নিয়ে গিয়ে নতুন মাটিতে চাপা দেওয়া একটি কবর দেখতে পান। সেখানে মাটি খুঁড়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং আরও দুই সেনা কর্মকর্তার মৃতদেহ দেখতে পান তাঁরা।

তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ তুলে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে আনা হয়। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ ঢাকায় পাঠানো হয়।
চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সে সময় বিদ্রোহের অভিযোগে ১৮ জন সামরিক কর্মকর্তার বিচার করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ১৩ সেনা কর্মকর্তার ফাঁসি এবং বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন