খোলাসা করেনি আওয়ামী লীগ, অনিশ্চয়তা নিয়েই শরিকদের মনোনয়নপত্র জমা

শেষ পর্যন্ত কারা ভোটে থাকবে, তা দেখেই শরিক-মিত্রদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চায় আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগ

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া সব দল শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকবে—এটা পুরোপুরি বিশ্বাস করছে না আওয়ামী লীগ। শেষ মুহূর্তে কেউ ভোট থেকে সরে গেলে যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় থাকে, সে জন্য নিজ দলের স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থী রাখছে ক্ষমতাসীনেরা। তাই মনোনয়ন যাচাই-বাছাই, এমনকি প্রত্যাহারের আগপর্যন্ত নিজেদের কৌশল খোলাসা করছে না আওয়ামী লীগ। যার ফলে জোট ও মিত্রদের নিয়েও জট খুলছে না।

নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন আজ। কিন্তু আসন সমঝোতার বিষয়ে কোনো আশ্বাস না পাওয়ায় ১৪ দলের শরিকদের কেউ কেউ জোটগতভাবে ভোটের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার কথা বলেন। অধিকাংশ শরিক দলের নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিতে গড়িমসি করেন। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শরিকদের বার্তা দেওয়া হয় যে মনোনয়ন জমা না দিলে কোনো সমঝোতা নয়। এমন এক পরিস্থিতিতে ১৪ দলের শরিকেরা মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ব্যাপারে তৎপর হন। একাধিক শরিক দলের নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

শরিক হলেই কি দিতে হবে? নির্বাচনে জেতার অবস্থানে নেই, সেই রকম জনসমর্থন নেই। তাহলে শরিক এ জন্য দিয়ে হারব? সেটা তো হবে না। নির্বাচনে জিততে হবে।
ওবায়দুল কাদের, সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ

১৪-দলীয় জোটের বাইরে জাতীয় পার্টি, কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত দলগুলো এবং ইসলামপন্থী কিছু দল যারা ভোটে অংশ নিচ্ছে, তাদেরও প্রত্যাশা রয়েছে ক্ষমতাসীনদের কাছে। আওয়ামী লীগ এবার আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে জোটের শরিক ও মিত্রদের দর-কষাকষির সুযোগ দিতে চায় না বলে দলটির সূত্রগুলো বলছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বিএনপিবিহীন আগামী সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ। কোন কোন দল ভোটে অংশ নিচ্ছে, প্রার্থী কারা হচ্ছেন—এই বিষয়ে আগে পরিষ্কার ধারণা পেতে চাইছেন নীতিনির্ধারকেরা।

আরও পড়ুন

এরপরই নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী কারা থাকবেন, কাদের বসাতে চাপ দেওয়া হবে, তা ঠিক করা হবে। জোট ও মিত্রদের মধ্যে কাদের নৌকা প্রতীক দেওয়া হবে, সেটাও ঠিক করা হবে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্ধারিত সময়ের শেষ দিকে। তবে জোট ও মিত্রদের সংসদ সদস্য আছেন এমন কিছু আসনে নিজেদের ‘দুর্বল’ প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এটাও শরিক ও মিত্রদের ছাড়ের কথা বিবেচনায় নিয়ে করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতারা অবশ্য বলছেন, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ছাড়া নির্বাচনের পুরো কৌশল কারও জানা নেই। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে, জোট-মহাজোটের চেয়ে ভোটার টানার কৌশলে মনোযোগ দলীয় প্রধানের।

সর্বশেষ তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন করেছে জাতীয় পার্টি। এবার দলটি নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে গড়িমসি করেছে। শেষ পর্যন্ত সুযোগ পেলেই নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে বলে আশঙ্কা আওয়ামী লীগের। অন্যদিকে ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের মাঠের শক্তি খুব কম মনে করে আওয়ামী লীগ। তাই তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক দর-কষাকষি করতে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না ক্ষমতাসীন দলটি। শেষ দিকে শীর্ষ কিছু নেতাকে জয়ী করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান।

আওয়ামী লীগ নেতারা অবশ্য বলছেন, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ছাড়া নির্বাচনের পুরো কৌশল কারও জানা নেই। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে, জোট-মহাজোটের চেয়ে ভোটার টানার কৌশলে মনোযোগ দলীয় প্রধানের।

আরও পড়ুন

মনোনয়নপত্র জমা

তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ১৪-দলীয় জোটের শরিকেরা জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর সঙ্গে করণীয় নিয়ে যোগাযোগ করছিল। কিন্তু আসন সমঝোতার বিষয়ে কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ জোটের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু সবাইকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কথা বলেন। জমা না দিলে কোনো সমঝোতা নয়—এমন বার্তা দেওয়া হয়।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান প্রথমে ঢাকা-৮ আসন থেকে মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন। কিন্তু তাঁর দলের সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা না পাওয়ায় এই আসনে মনোনয়নপত্র জমা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল বুধবার রাশেদ খান মেনন বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) ও বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদি) এই দুটি আসন থেকে তার পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে বরিশাল-২ আসনে বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য।

আর বরিশাল-৩-এর সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির। শেষ পর্যন্ত বরিশাল-৩ আসনে নৌকা প্রতীক পাওয়ার আশা করছে ওয়ার্কার্স পার্টি। এই আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনূস।

এর বাইরে রাজশাহী-২ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা নৌকা প্রতীক পাবেন বলে প্রত্যাশা করছেন। তবে এখনো আওয়ামী লীগ তা নিশ্চিত করেনি। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন।

রাশেদ খান মেনন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বরিশাল থেকেই নির্বাচন করবেন। সমঝোতার বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি বলে তিনি জানান।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু কুষ্টিয়া-২ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তিনি এই আসনে নৌকা প্রতীক পাচ্ছেন বলে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে। তবে জাসদ আর কোনো আসনে নৌকা প্রতীক পাবে কি না, এটা নিশ্চিত করা হয়নি। জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার ফেনী-১ আসনে দুইবারের সংসদ সদস্য। এবার আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়ন পেয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক নির্বাহী সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম।

আরেক শরিক তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী চট্টগ্রাম-২ আসনে এবং পিরোজপুর-২ আসনে জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নৌকা প্রতীক পেতে পারেন বলে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে। যদিও দুটি আসনেই আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে।

নজিবুল বশর প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিতে এখন চট্টগ্রামে। আশা করছেন শিগগিরই সমঝোতার বৈঠক শুরু হবে।

এই বিষয়ে গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শরিক হলেই কি দিতে হবে? নির্বাচনের জেতার অবস্থানে নেই, সেই রকম জনসমর্থন নেই। তাহলে শরিক এ জন্য দিয়ে হারব? সেটা তো হবে না। নির্বাচনে জিততে হবে।’

বর্তমান সংসদে সরাসরি ভোটে ১৪-দলীয় জোটের নির্বাচিত সংসদ সদস্য আটজন। তাঁরা সবাই নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। এবার চারটি আসনে জোটের শরিকদের নৌকা প্রতীক দেওয়া হতে পারে বলে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

গাজীপুর মডেল

বিএনপিবিহীন নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি নানা মহলের চাপে পড়েছে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। সব দল অংশ না নিলেও ভোটার উপস্থিতি বেশি দেখাতে চায় দলটি। সে জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীনেরা। এতে দলীয় বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থাকলেও এই চ্যালেঞ্জ নিতে চায় দলটি। এটাকে দলের ভেতরে ‘গাজীপুর মডেল’ বলা হচ্ছে। ওই নির্বাচনে প্রায় ৪৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল।

গত মে মাসে গাজীপুরের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন মেয়র পদে ভোট করেন। শেষ পর্যন্ত জায়েদা খাতুন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। সেই নির্বাচন মোটামুটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। শুরুতে বহিষ্কার করলেও পরে জাহাঙ্গীরকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে গতকাল ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘দলের লোক হলে সিদ্ধান্ত মানতে হবে। সে রকম ঢালাওভাবে কিছু করতে যাব না। আমাদেরও কিছু কৌশল আছে।’