জামায়াত ‘সুযোগ’ নিল, নাকি সরকারের ‘কৌশল’

বিভিন্ন দাবিতে বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী গত শনিবার ঢাকায় সমাবেশ করে। এই সমাবেশ নিয়েই নানা আলোচনা
ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৈরি হওয়া ভিন্ন এক পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এ পরিস্থিতির কারণেও সরকার দলটিকে প্রকাশ্যে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার পাশাপাশি দলটির সঙ্গে সরকারের কোনো বোঝাপড়া হয়েছে কি না—এ প্রশ্নও সামনে এসেছে।

অন্যদিকে, বিরোধী দল বিএনপিও সন্দেহ করছে, সরকারের সঙ্গে একধরনের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে হয়তো জামায়াত নতুন করে মাঠে নেমেছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার পক্ষে সরকারের মন্ত্রীরা যেভাবে যুক্তি দিচ্ছেন, তাতে সন্দেহ আরও বাড়ছে। আর বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারাও ঘটনাটি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

গত শনিবার জামায়াতের সমাবেশের পরদিন সরকারের চারজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এ বিষয়ে কথা বলেছেন। যদিও সাংবাদিকদের প্রশ্নে তাঁরা বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সবার বক্তব্য প্রায় একই রকম। মন্ত্রীরা জামায়াতের সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে নানা যুক্তি দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত রোববার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বিচারের চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতকে দোষী বলা যাবে না। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী যেহেতু নিষিদ্ধ দল নয়, তাই তাদের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

তবে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে জামায়াতকে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বক্তব্যের কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান অবশ্য সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।

সরকারের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য বা ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তাতে জামায়াতের সঙ্গে সরকারের একধরনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে বলে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন।

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়েছিল। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দলগতভাবে জামায়াতের বিচারের বিষয় আদালতের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এক দশক ধরে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ওই বিষয়গুলোকেই এত দিন যুক্তি হিসেবে দেখানো হচ্ছিল। কিন্তু এখন মন্ত্রীরা জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার পক্ষেই যুক্তি দিচ্ছেন।

তবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একটা অংশের মধ্যে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া হয়েছে। দলটির একাধিক নেতা বলেছেন, জামায়াতের প্রতি সরকার নমনীয় হলে সেটা দলের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। হঠাৎ জামায়াতের মাঠে নামা নিয়ে তাঁদের মধ্যেও অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

যদিও জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টিকে কৌশল হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকে। তাঁরা মনে করেন, জামায়াতকে বিএনপি থেকে আলাদা রেখে নির্বাচনে আনার বিষয় বিবেচনায় থাকতে পারে। একই সঙ্গে বিএনপির ভেতরেও জামায়াত নিয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি করাও সরকারের একটি কৌশল হতে পারে।

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে এমন আলোচনাও আছে, বাধা দিলে জামায়াত অনুমতি ছাড়াই সমাবেশ করার প্রস্তুতি রেখেছিল। এ ধরনের তথ্য সরকারের কাছে ছিল এবং দলটিকে অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে এটিও সরকারের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সরকারের সঙ্গে জামায়াতের কোনো বোঝাপড়া ছাড়া নির্বিঘ্নে তারা সমাবেশ করতে পারত না। সেই বোঝাপড়া নির্বাচনকেন্দ্রিক হতে পারে বলে তাঁদের ধারণা।

জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, দলটির গত শনিবারের সমাবেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ অবহিত ছিল। সে কারণে সরকার অনুমতি দিয়েছে।

জামায়াতের রাজনীতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন—এমন একজন বিশ্লেষক প্রথম আলোকে বলেছেন, নির্বাচনের কয়েক মাস আগে জামায়াত তাদের একটা অবস্থান তুলে ধরতে চেয়েছিল এবং এই সমাবেশের মাধ্যমে তারা সেটি করেছে। সরকারের অনুমতি নিয়ে তা করায় সরকার মনে করছে, জামায়াত তাদের বোঝাপড়ার মধ্যেই থাকবে। আর বিএনপিসহ বিরোধী দল ভাবতে পারে, জামায়াতের শক্তি কমেনি। ফলে রাজনৈতিক কৌশল থেকে জামায়াত একটা নিজস্ব অবস্থান তুলে ধরল।

একই সঙ্গে এই বিশ্লেষক মনে করেন, জামায়াতের যেহেতু নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই, নিবন্ধন পাওয়ার জন্য কোনো কৌশলের অংশ হিসেবেও দলটি সরকারের সঙ্গে সাময়িক কোনো বোঝাপড়ায় যেতে পারে।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতারা দণ্ডিত হয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় বিগত দিনগুলোয় জামায়াতের কর্মসূচি সহিংস হয়ে উঠেছিল। সেই প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালের পর থেকে দলটি পুলিশের অনুমতি নিয়ে সমাবেশ করতে পারেনি। বিভিন্ন সময় জামায়াত ঝটিকা মিছিল করলেও নির্বিঘ্নে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। ঘরোয়া বৈঠক করতে গিয়েও দলের অনেক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন।

গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে বিএনপি যখন যুগপৎ আন্দোলনের ১০ দফা দাবি দিয়েছিল, তখন জামায়াতও আলাদাভাবে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করেছিল। সে সময়ই জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখনো তিনি জেলে রয়েছেন।

জামায়াত শুরুতে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি আলাদাভাবে পালন করলেও পরে ওই আন্দোলন থেকে সরে যায়। যদিও দলটি তখন এ বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেয়নি। এখন সরকারের অনুমতি নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের বিষয়ে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ সময় পর তাঁরা স্বস্তিতে সমাবেশ করতে পেরেছেন। সমাবেশের অনুমতি দেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ও জামায়াতের মধ্যে কোনো বোঝাপড়া হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, গত ১০ বছর তারা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে নজর দিয়েছিলেন। এখন নির্বাচন এগিয়ে আসায় তাঁরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গুরুত্ব দিতে চাইছেন। সে জন্য তাঁরা এখন সমাবেশ করেছেন।

জামায়াতের এই নেতা এমন বক্তব্য দিলেও দলটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, তাতে দেশে নতুন এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অবাধে সভা–সমাবেশ করার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জামায়াত নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গিয়ে সমাবেশের জন্য পুলিশের অনুমতি নিয়েছে।

জামায়াতের রাজনীতির পর্যবেক্ষক এবং দৈনিক নয়াদিগন্তের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সালাহ উদ্দিন বাবর প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কারণে সরকার একধরনের চাপ অনুভব করছে। সে প্রেক্ষাপটেই জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে সরকার।

তবে জামায়াতের সমাবেশকে ঘিরে দলটির দীর্ঘ সময়ের মিত্র বিএনপিতে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় পার্টির যুব সংগঠনের কর্মসূচি নির্ধারিত থাকলেও তা বাতিল করে জামায়াতকে সেখানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।

নির্বাচনের আগে জামায়াতের প্রতি সরকারের নমনীয় হওয়ার এ ঘটনা তাঁদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারাও ঘটনাটি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

যদিও জামায়াত নেতা আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন চান। এ দাবি আদায়ে তাঁরা আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করবেন।

একই দাবিতে বিএনপি যে যুগপৎ আন্দোলন করছে, তাতে জামায়াত অংশ নেবে কি না, এ প্রশ্নে জামায়াত নেতা আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের কৌশলী জবাব দেন। তিনি বলেন, তাঁরা এখন নিজেদের মতো করে ‘কেয়ারটেকার’ সরকারের দাবিতে আন্দোলন করবেন। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতের অংশ নেওয়া না নেওয়ার বিষয়টি ভবিষ্যতেই ঠিক হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সরকারের সঙ্গে জামায়াতের কোনো বোঝাপড়ার হয়ে থাকলে নির্বাচন আরও এগিয়ে এলে তা স্পষ্ট হবে। এখনই চূড়ান্তভাবে কিছু বলা বা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না।

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সরকার কৌশলে হেরে, পরিস্থিতির ফেরে পড়ে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে। এটি একটি দিক; আরেকটি দিক হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকেও কোনো কৌশল থাকতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াত এই কৌশলের অংশ কি না? সেটি সময়ই বলে দেবে।’