রাজশাহীর সমাবেশ ৩ ঘণ্টার, অবস্থান ও দুর্ভোগ ৩ দিনের

বিএনপির গণসমাবেশের আগের দিনই রাজশাহী শহরের পাঠানপাড়ায় মাদ্রাসা মাঠের পাশের সড়কে নেতা–কর্মীরা এসে পড়েছেন। গতকাল বিকেল পাঁচটায়
ছবি: শহীদুল ইসলাম

নাটোর থেকে বিএনপির কর্মী সানোয়ার হোসেন রাজশাহী এসেছেন গত বুধবার রাতে। তাঁরা একসঙ্গে এসেছেন প্রায় আড়াই শ জন। থাকছেন রাজশাহীর পাঠানপাড়ায় শাহ মখদুম কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে, তাঁবু টানিয়ে। সেখানেই চলছে খাওয়াদাওয়া। তাঁদের মতো হাজার হাজার নেতা-কর্মী তিন দিন ধরে অবস্থান করছেন এই ময়দানে। তাঁরা সবাই রাজশাহী এসেছেন দলের বিভাগীয় গণসমাবেশে যোগ দিতে।

আজ শনিবার বিএনপির এ সমাবেশের জন্য পুলিশ যে সময় বেঁধে দিয়েছে, তাতে বেলা দুইটায় শুরু করে পাঁচটার মধ্যে শেষ করতে হবে। তিন ঘণ্টার এ সমাবেশের জন্য তিন দিন ধরে সমাবেশস্থলের পাশের একটি মাঠে অবস্থান করছেন নেতা-কর্মীরা।

কারণ, বিএনপির সমাবেশের দুদিন আগে থেকে পরিবহন মালিক সমিতি রাজশাহী বিভাগে ধর্মঘট ডেকে গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখেছে। বিএনপির অভিযোগ, তাদের সমাবেশে যাতে লোকজন আসতে না পারে, সে জন্য অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশের মতো রাজশাহীতেও ধর্মঘট ডেকে বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে ১ ডিসেম্বর থেকে।

আরও পড়ুন

রাজশাহী বিভাগে সাংগঠনিক দিক থেকে বিএনপির শক্ত অবস্থান আছে বলে মনে করা হয়। অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশের মতো রাজশাহীতেও নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে রাজশাহীতে পরিবহন ধর্মঘট ও পুলিশের তৎপরতার মাত্রাটা বেশি। কয়েক দিন ধরে আওয়ামী লীগও মাঠে তৎপর। গতকাল নগরের কাশিয়াডাঙ্গা মোড়ে বিক্ষোভ মিছিল করে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ। মিছিল শেষে সমাবেশে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, বিএনপি সমাবেশের নামে কোনো বিশৃঙ্খলা করলে আওয়ামী লীগ ছাড় দেবে না।

রাজশাহীতে বিএনপির সমাবেশে অনেকেই আগেভাগে চলে এসেছেন। থাকছেন নগরের পাঠানপাড়া ঈদগাহ মাঠে খোলা আকাশের নিচে। ১ ডিসেম্বর
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীতে সমাবেশের আগে নতুন প্রবণতা হচ্ছে ‘গায়েবি মামলা’। বিএনপির অভিযোগ, এ কর্মসূচি সামনে রেখে গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় ৬১টি গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছে বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১১৫ জনকে।

চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা ছাড়া অন্য সমাবেশ সামনে রেখে যেভাবে বিভাগীয় পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল, রাজশাহীতেও সেটা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ধর্মঘট পালন করেছে পরিবহন মালিক সমিতি। সমাবেশের আগের দিন, গতকাল থেকে শুরু হয়েছে মিশুক-সিএনজিচালিত অটোরিকশা মালিক সমিতির অদ্ভুত ধরনের ধর্মঘট। তিন চাকার যানগুলো শহর থেকে যাত্রী নিয়ে অন্যত্র যাচ্ছে। কিন্তু যাত্রী নিয়ে শহরে ফিরছে না।

আরও পড়ুন

সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ

সুবর্ণার শ্বশুরবাড়ি পাবনায়। তাঁর স্বামী রাজশাহীতে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। শুক্রবার তিনি পাবনা থেকে রাজশাহীতে রওনা দিয়ে বিপাকে পড়েন। ভেঙে ভেঙে আসছিলেন। সর্বশেষ অটোরিকশায় পুঠিয়ায় পৌঁছান। সেখানে আর কিছু পাননি। পরে একটি ভ্যান ভাড়া করে পুঠিয়া থেকে রাজশাহী নগরের তালাইমারীতে আসতেই তাঁর সন্ধ্যা ছয়টা বেজে যায়। সুবর্ণা বলেন, সাধারণত বাসে ১৮০ টাকা ভাড়ায় পাবনা থেকে রাজশাহীতে আসা যায়। কিন্তু গতকাল ভেঙে ভেঙে আসতে তাঁর ৪০০ টাকার বেশি লেগেছে। এর সঙ্গে দিনভর রাস্তার দুর্ভোগ তো ছিলই।

গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে রাজশাহী রেলগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তিনটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে দুটো মুহূর্তেই যাত্রী ভর্তি হয়ে গেছে। আরও অন্তত ২০ জনের মতো যাত্রী গাড়ির অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁদের একজন আবদুল আলিম। মান্দা ফেরিঘাট থেকে গত বৃহস্পতিবার তিনি রাজশাহী এসেছিলেন স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য।

তাঁবুতে রাত কাটিয়ে সকালের নাস্তা করছেন বিএনপির নেতা–কর্মীরা। শুক্রবার সকালে রাজশাহী নগরের পাঠানপাড়ার শাহ মখদুম কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

আবদুল আলিম প্রথম আলোকে বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে মান্দায় বাসের অপেক্ষা থেকে বাস পাননি। পরে বাড়তি ভাড়া দিয়ে কিছু দূর আসেন অটোরিকশায়। পথে সিএনজিচালিত অটোরিকশা পেয়ে ওঠেন। পথে তাঁকে চার-পাঁচ জায়গায় থামতে হয়েছে। যাত্রীদের পুলিশ জেরা করেছে, তাঁরা কেন রাজশাহী যাচ্ছেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে তিনি রাজশাহীতে আত্মীয়বাড়িতে ছিলেন। চিকিৎসা শেষে রেলগেটে এসে শোনেন অটোরিকশাও ধর্মঘটের আওতায়। এখানে এসে দেখেন মান্দা ফেরির ভাড়া ২০০ টাকা হয়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে এ ভাড়া ১২০ টাকা।

আরও পড়ুন

আসার পথে প্রতিবন্ধকতা

পরিবহন মালিক সমিতি বলছে, ১০ দফা দাবিতে তাদের এ কর্মসূচি। বিএনপির সমাবেশের তারিখের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে ধর্মঘটের তারিখ মিলে গেছে। কৌশলী এ ধর্মঘটের বিপরীতে বিএনপির নেতা-কর্মীরাও কৌশলী হয়েছেন। আশপাশের জেলা বগুড়া, পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলা থেকে বুধবার রাতের মধ্যেই অনেকে রাজশাহী চলে আসেন। অনেকে তারও আগে মঙ্গলবারে রাজশাহী পৌঁছান।

গতকাল শুক্রবারও বিভিন্ন জেলা এবং রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলা থেকে অনেক নেতা-কর্মীকে আসতে দেখা যায়। আসার পথে বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা পুলিশের জেরা ও তল্লাশির মুখে পড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।

মো. শামীম হোসেন নামে নাটোরের একটি ওয়ার্ড শাখা যুবদলের সভাপতি প্রথম আলোকে বলেন, জুমার নামাজের পর তাঁরা ২২ জন ট্রাকে করে নাটোর থেকে রওনা হন। কয়েক জায়গায় ট্রাক থামিয়ে পুলিশ তল্লাশি চালায়। পুঠিয়ার বেলপুকুরে আসার পর পুলিশ তাঁদের ট্রাক থেকে নামিয়ে দেয়। পরে তাঁরা হেঁটে, অটোরিকশা করে ভেঙে ভেঙে রাজশাহী পৌঁছান।

বগুড়া থেকে একটি বড় মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা নিয়ে ছাত্রদল ও যুবদলের নেতারা সমাবেশে যোগ দিতে আসেন। আমাদের বগুড়া প্রতিনিধি জানান, ছাত্রদল-যুবদলের নেতারা অভিযোগ করেন, গতকাল সকালে বগুড়া থেকে রওনা হওয়ার পর চারমাথা সেঞ্চুরি মোটেলের সামনে পুলিশ মোটরসাইকেলের বহরটি আটকে দেয়। ১৫-২০টি মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। তাঁরা পথে পুলিশের তল্লাশির মুখে পড়েন।

রাজশাহীর গণসমাবেশের সমন্বয়কারী ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‌পুলিশ ব্যাপক বাধার সৃষ্টি করেছে, মামলা দিয়েছে, নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর মতে, ‘পুলিশ বরং বাধা দিয়ে তিন ঘণ্টার সমাবেশকে তিন দিনের সমাবেশে পরিণত করেছে।’

রাজশাহী শহরের প্রধান তিনটি প্রবেশমুখ এবং শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ১৭টি তল্লাশিচৌকি বসায় মহানগর পুলিশ। এর আগে রাজশাহী শহরের বিভিন্ন মেসে বহিরাগতদের রাখতে বারণ করেছিল পুলিশ। বিভিন্ন মেসে তল্লাশিও চালানো হয়।

তবে রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আবু কালাম সিদ্দিক দাবি করেন, কোথাও কোনো ধরনের হয়রানি করা হচ্ছে না। সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি করা হচ্ছে।

অবস্থানস্থলের চিত্র

বিএনপির অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশে দেখা গেছে, নেতা-কর্মীরা সমাবেশের আগের রাতে সমাবেশস্থলেই অবস্থান করেছেন। কিন্তু রাজশাহীতে গতকাল পর্যন্ত সমাবেশস্থলে দলটির নেতা-কর্মীদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এ সমাবেশ হবে হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে, যা মাদ্রাসা মাঠ নামে পরিচিত। এর পাশেই ঈদগাহ মাঠ। সেখানেই বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতা-কর্মীরা তিন দিন ধরে থাকছেন।

গতকাল বিকেলে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠজুড়ে খণ্ড খণ্ড তাঁবু ও শামিয়ানা টানানো। প্রত্যেক তাঁবুর সামনে সংশ্লিষ্ট এলাকার নাম লেখা ব্যানার। তাঁবু ও শামিয়ানার ভেতরে অনেকে শুয়ে–বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ আড্ডা দিচ্ছেন। আবার চলছে ছোট ছোট মিছিল, স্লোগানও আছে। তাঁবুগুলোর পাশেই চলছে রাতের রান্নার প্রস্তুতি। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা যেসব এলাকা থেকে এসেছেন, ওই সব এলাকার নেতারাই মূলত খাবারের ব্যবস্থা করছেন।

দুই দিন ধরেই এ অবস্থা চলছে। গতকাল সন্ধ্যা থেকে ওই মাঠে নেতা-কর্মীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলা যুবদলের নেতা হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ধর্মঘটের কারণে তাঁরা গত বুধবার রাতেই রাজশাহী চলে আসেন। আলোর স্বল্পতার মধ্যে মশার কামড় খেয়ে নেতা-কর্মীরা অবস্থান করছেন।

জ্বালানি তেলসহ দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও দলের পাঁচ নেতা-কর্মী হত্যার প্রতিবাদ, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিভাগীয় গণসমাবেশ করছে বিএনপি। ১২ অক্টোবরের চট্টগ্রামে সমাবেশের মধ্য দিয়ে এ কর্মসূচি শুরু হয়। আজ রাজশাহীর সমাবেশের মধ্য দিয়ে ঢাকার বাইরে এ কর্মসূচি শেষ হচ্ছে। এরপর ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে।