ফরহাদ মজহার ও শওকত মাহমুদের নৈশভোজ নিয়ে বিএনপির সন্দেহ কেন

ফরহাদ মজহার ও শওকত মাহমুদ

ফরহাদ মজহার ও শওকত মাহমুদের একটি সংগঠনের নৈশভোজ নিয়ে বিরোধী দল বিএনপিতে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ঢাকার একটি পাঁচতারা হোটেলে ১৬ মার্চ এই নৈশভোজের আয়োজন করে বড় মূল্য দিতে হয়েছে শওকত মাহমুদকে। আগে অন্তত দুই দফায় কারণ দর্শানোর নোটিশ পেলেও এবার বিএনপি তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে।

একটি নৈশভোজ ঘিরে বিএনপি নেতৃত্বের এত সন্দেহ কেন? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে, বিএনপি এই আয়োজনকে শুধু ভোজের আসর হিসেবে দেখতে রাজি নয়। দলটি এটিকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে এবং মনে করছে, এর পেছনে কোনো শক্তির হাত রয়েছে।

যদিও নৈশভোজের আয়োজন করে বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া শওকত মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁদের আয়োজনের ব্যাপারে বিএনপিতে ভুল–বোঝাবুঝি রয়েছে।

কিন্তু ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে এ আয়োজন নৈশভোজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। আয়োজকেরা একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছেন। তাদের প্রস্তাবটি হচ্ছে, নির্বাচনের আগে দেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা।

সেই সরকার নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে এবং তারপর জাতীয় নির্বাচন দেবে। এই রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়েই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে এমন রাজনৈতিক প্রস্তাব নিয়ে দুজন ব্যক্তির একটি সংগঠনের পাঁচতারা হোটেলে নৈশভোজ আয়োজনের অর্থের উৎস কী—এই প্রশ্নও উঠেছে।

বিএনপির আপত্তি কোথায়

নৈশভোজে উত্থাপিত রাজনৈতিক প্রস্তাব নিয়েই মূল আপত্তি বিএনপির। দলটি এখন সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে। তারা নির্বাচনে জয়ী হলে তখন জাতীয় সরকার গঠন করবে। এ ঘোষণা বিএনপি দিয়েছে সমমনা বিভিন্ন দল ও জোটের সঙ্গে আন্দোলন শুরু করার আগে। কিন্তু নির্বাচনের আগেই জাতীয় সরকার গঠনের যে প্রস্তাব করা হয়েছে ইনসাফ কায়েম কমিটির নৈশভোজে, সেটাকে বিএনপি তাদের অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করছে।

রাজধানীর বনানীর শেরাটন হোটেলে ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার
ছবি: সংগৃহীত

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা যখন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছেন, তখন নির্বাচনের আগেই জাতীয় সরকার গঠন ও নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব তোলা হয়েছে। এটি  উদ্দেশ্যমূলক এবং কোনো শক্তির ষড়যন্ত্রের অংশ। এর পেছনে সরকারের হাত রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

এ ধরনের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপির আন্দোলন নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিতেই এ ধরনের তৎপরতা চালানো হচ্ছে।

কিন্তু যেকোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের যেকোনো বিষয়ে মতামত দেওয়ার বা প্রস্তাব তোলার অধিকার রয়েছে সংবিধানে। তাহলে ইনসাফ কায়েম কমিটির নৈশভোজের বক্তব্য নিয়ে বিএনপির আপত্তি কেন—এই প্রশ্নও অনেকে তুলতে পারেন।

আরও পড়ুন

আসলে ইনসাফ কায়েম কমিটি নামের সংগঠনটির সদস্য সচিব শওকত মাহমুদ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। দলের উচ্চপর্যায়ের একটি পদে থেকে তিনি বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানের থেকে ভিন্ন একটি বক্তব্য বা প্রস্তাব তুলে ধরেছেন অন্য একটি সংগঠনের ব্যানারে। এ বিষয়টিই বেশি ক্ষুব্ধ করেছে বিএনপি নেতৃত্বকে।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া ওই নৈশভোজে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁদেরও অনেকের ব্যাপারে বিএনপি নেতৃত্বের একধরনের সন্দেহ রয়েছে বলে মনে হয়। গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী, সাবেক রাষ্ট্রদূত সাকিব আলী, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ, গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানসহ পুলিশের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা অংশ নিয়েছিলেন ওই নৈশভোজে।

তবে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান (মান্না) নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি অবশ্য বলেছেন, তিনি আমন্ত্রণ পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু নৈশভোজের কারণ বা আলোচনার বিষয় সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না।
তবে শওকত মাহমুদের সঙ্গে বিএনপির নেতৃত্বের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল অনেক দিন ধরে।

এর আগে গত বছরের এপ্রিলে শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল বিএনপি। তখনো দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ তোলা হয়েছিল। তিনি পেশাজীবী সমাজের ব্যানারে একটি সমাবেশ ডেকে সরকার পতনের ডাক দিয়েছিলেন। সেই পটভূমিতে তখন ওই সমাবেশের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক ছিল না বলে দলটির নেতারা বলেছিলেন।

২০১৯–২০ সালের ডিসেম্বরেও ঢাকায় এ ধরনের দুটি বড় জমায়েত করে রাস্তায় নেমেছিল জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল ও পেশাজীবী পরিষদ । এরও নেতৃত্বে ছিলেন শওকত মাহমুদ। তখনো তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল দলটি।

এখন অবশ্য আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়েই শওকত মাহমুদকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও বহিষ্কার করেছে বিএনপি। দলটি ইনসাফ কায়েম কমিটির কর্মকাণ্ডকেই ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে।

অর্থের উৎস নিয়েও প্রশ্ন

ঢাকার বনানী এলাকায় শেরাটন হোটেলে নৈশভোজ আয়োজনের বড় অঙ্কের অর্থের উৎস নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিএনপি নেতাদের। তাঁরা মনে করেন, আয়োজনের পেছনে থেকে কোনো পক্ষ এই অর্থের জোগান দিয়েছে।

সন্দেহ–অবিশ্বাস থেকেই বিএনপি শওকত মাহমুদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এ ছাড়া ওই নৈশভোজে রাজনীতিক যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছেন। তাঁদের ব্যাপারেও বিএনপি সতর্ক রয়েছে বিএনপি। দলটির আরও কেউ ইনসাফ কায়েম কমিটির সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃক্ত আছে কি না, সেটাও বিএনপি খতিয়ে দেখছে। দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।

আয়োজকেরা যা বললেন

তবে বিএনপির এ ধরনের প্রতিক্রিয়ায় অবাক হয়েছেন ইনসাফ কায়েম কমিটির আহ্বায়ক কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁদের এই সংগঠন অরাজনৈতিক।

স্বাধীনতার তিন মূলনীতি সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফের বাইরে অন্য কিছু নেই। এ বিষয়গুলোয় এবং মানবাধিকার প্রশ্নে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে তাঁরা কাজ করবেন। তাঁরা সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে চান। এ বক্তব্যই তাঁরা তুলে ধরেছেন ওই নৈশভোজে।

এর সঙ্গে শওকত মাহমুদের বক্তব্যের অবশ্য ভিন্নতা আছে। তিনি বলেছেন, তাঁরা নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব তুলেছেন। এটি বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলেও তিনি দাবি করেন।

ফরহাদ মজহার এই ইনসাফ কায়েম কমিটি নামের সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ২০১৩ সালে। তখন শওকত মাহমুদ এর সঙ্গে ছিলেন না। এখন শওকত মাহমুদ সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর প্রথম কর্মসূচি হিসেবে তাঁরা নৈশভোজের আয়োজন করলেন।

ফরহাদ মজহার বলেছেন, নানা প্রতিকূলতার কারণে সেটি ১০ বছরে সক্রিয় ছিল না।
এখন নৈশভোজের আয়োজন করে সংগঠনটি তার অস্তিত্বের জানান দিল। কিন্তু এখন মাত্র দুজন ব্যক্তির সমন্বয়ে এ সংগঠন চলছে। এর আহ্বায়ক ফরহাদ মজহার এবং সদস্যসচিব শওকত মাহমুদ। এই দুজন ছাড়া সংগঠনটির কমিটিতে আর কেউ নেই। তাঁরা বলছেন, এখন অল্প সময়ের মধ্যে সংগঠনে আরও লোকের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের চেষ্টা তাঁরা করবেন।

যদিও তাঁরা দুজনই এই ইনসাফ কায়েম কমিটিকে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন বলে দাবি করছেন, কিন্তু তাঁরা নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার গঠনের রাজনৈতিক প্রস্তাব তুলে বিতর্কের জন্ম দিলেন।  

ফরহাদ মজহার বলছেন, তাঁরা ইনসাফ কায়েম করতে চান। কিন্তু বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে পাঁচতারা হোটেলে নৈশভোজের আয়োজন করে তাঁরা কী ইনসাফ কায়েম করতে চান, সেই প্রশ্ন থেকে যায়।