রাজনীতিতে যে দুটি শব্দ বেশি শোনা যাচ্ছে

রাজধানীর শ্যামলী স্কয়ার শপিং মলের সামনে আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ৩০ ডিসেম্বর ২০২২
ফাইল ছবি

সভা–সমাবেশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সরকার বা বিরোধী পক্ষের নেতারা গত বছর দেশের মানুষকে যে দুটি শব্দ সবচেয়ে বেশি শুনিয়েছেন, তার একটি ‘ষড়যন্ত্র’।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা নিয়মিতই বলে আসছেন, সরকারকে বিপদে ফেলতে এবং ক্ষমতায় যেতে বিএনপি ষড়যন্ত্র করছে। অন্যদিকে বিএনপির নেতারাও বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে ষড়যন্ত্র করছে। একইভাবে প্রধান দুই দলের জোটে যেসব দল আছে, তারাও চারদিকে ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে।

দুই পক্ষের মতের অমিল শুধু একটি জায়গায়। এই জায়গায় (নির্বাচনব্যবস্থা) নতুন বছর শেষ হওয়ার আগেই দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা হয়ে যাবে—মানুষ শুধু এটুকুই চায়।

দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা যখন পাল্টাপাল্টি ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ করেন, তখন বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। বিপদ আরও বাড়িয়েছে, দেশি–বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা দুদিক থেকেই বলা হচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, দুই পক্ষই একে অন্যের ‘ষড়ষন্ত্রের’ বিষয়টি মোটামুটি মনে হয় জেনে গেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, সম্ভাব্য (পড়ুন যে আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে) ‘ষড়যন্ত্র’ নিয়ে দলগুলো নিজেরা যতটা না সাবধান হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি সতর্ক করছে সাধারণ মানুষকে। দুই পক্ষই জনগণকে ‘ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে। তাই নতুন বছরে জনগণের বড় একটি দায়িত্ব হবে দেশের স্বার্থে (প্রয়োজনে নিজের স্বার্থে) হুঁশিয়ার থাকা।

দেশের ফৌজদারি আইন অনুযায়ী, ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে ভবিষ্যতে কোনো অপরাধ সম্পন্ন করার জন্য দুই বা ততোধিক ব্যক্তির একজোট হওয়া। তবে অভিজ্ঞতা বলে, কেউ ক্ষমতায় যেতে না পারলে বা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে (ভোট সুষ্ঠু হলে তো কথাই নেই, সেটি যে ব্যবস্থার অধীনেই হোক) হেরে গেলে দায় প্রতিপক্ষের ‘ষড়যন্ত্রের’।

রাজধানীর নয়াপল্টন থেকে মগবাজার অভিমুখে গণমিছিল-পূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ৩০ ডিসেম্বর ২০২২
ছবি: তানভীর আহম্মেদ

দেশের রাজনীতিতে কারও ‘ষড়যন্ত্রের’ প্রমাণ হাজির করার চেয়ে বক্তব্যে এ বিষয় তুলে ধরে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বেশি উৎসাহ দেখা যায়। প্রযুক্তির এই যুগেও মীর জাফর বা খন্দকার মোশতাকদের দেখা পাওয়া যাবে না—এমনটি কেউ বলছে না। কিন্তু ওই দুজন নিজ ঘরের (দলের, সরকারের) ভেতর থেকেই বের হয়েছিলেন। ফলে জনগণকে ‘ষড়যন্ত্র’ থেকে হুঁশিয়ার থাকার পরামর্শ না দিয়ে নিজ নিজ ঘরের দিকে তাকানো বড় দুই দলের জন্য বেশি কার্যকর হবে—এমন আলোচনাও রাজনীতিতে রয়েছে।

রাজনৈতিক অঙ্গনে গত বছর সবচেয়ে বেশি শোনা আরেকটি শব্দ ‘খেলা’ । প্রতিপক্ষকে ‘ভয়’ দেখাতে এই শব্দ কয়েক বছর আগে ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের নেতা শামীম ওসমান। তখন ইউটিউব ও ফেসবুকে বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়েছিল।

তবে ‘খেলা হবে’ শব্দটি গত বছর নতুন করে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এনেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বারবার বলেছেন, ‘খেলা হবে’ আন্দোলনে, ‘খেলা হবে’ নির্বাচনে। তাঁর বক্তব্যের পাল্টা জবাবে বিএনপিও বলেছে ‘খেলা হবে’। দলটির নেতাদের কেউ কেউ অবশ্য আওয়ামী লীগের উদ্দেশে বলেছেন, পুলিশ ও প্রশাসন বাদ দিয়ে খেলতে আসেন, ‘খেলা হবে’। অবশ্য ‘ষড়যন্ত্রের’ বিষয়ে দুই পক্ষই যেভাবে জনগণকে হুঁশিয়ার করেছে, ‘খেলা হবে’র ক্ষেত্রে তা করেনি। বরং দুই পক্ষই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ‘খেলতে’ (প্রতিপক্ষকে হারাতে) নিজেদের আগ্রহের কথা খোলাখুলিই বলেছে। তাই নতুন বছরে জনগণের বড় একটি দায়িত্ব হবে ‘খেলা শিখে’ নেওয়া।

কোথায় ‘খেলতে হবে’, সেটিও বলে দিয়েছে দুই পক্ষই। সেটি ‘নির্বাচনে’। দুই পক্ষই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। সেই নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপি’ হলেও মেনে নেওয়ার মানসিকতা দেখাবে—অতীত অভিজ্ঞতার কারণে এমনটা বলাই যায়। কেউই বিনা ভোটে সরকার গঠন বা কথিত রাতের ভোট চায় না। এরপরও মতের অমিল শুধু একটি জায়গায়। এই জায়গায় (নির্বাচনব্যবস্থা) নতুন বছর শেষ হওয়ার আগেই দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা হয়ে যাবে—মানুষ শুধু এটুকুই চায়।


ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো

আরও পড়ুন