এলাকাটির নাম চনপাড়া। এর তিন দিকে নদী, এক দিকে খাল। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় যোগাযোগবিচ্ছিন্ন চনপাড়ায় এখন লাখখানেক লোকের বাস। সড়কপথে এই এলাকায় যেতে হলে ঢাকার ডেমরা হয়ে বালু নদের ওপর নির্মিত সেতু পার হতে হয়। স্থলপথে এটিই চনপাড়ায় প্রবেশের একমাত্র রাস্তা। ভৌগোলিকভাবে জায়গাটি দুর্গম হওয়ায় এখানে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি বহাল। এখন এই ‘মুল্লুক’ চলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমান ওরফে বজলুর কথায়। তাঁর ভয়ে সেখানে কেউ মুখ খোলার সাহস পান না।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সূত্রের পাশাপাশি চনপাড়ার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিন বছর আগে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া ওয়ার্ডের ‘নিয়ন্ত্রক’ ছিলেন দুজন। একজন কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সংরক্ষিত নারী সদস্য বিউটি আক্তার ওরফে কুট্টি এবং অন্যজন ইউপি সদস্য বজলুর রহমান। চনপাড়ায় মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁদের কাছে। আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে প্রথমে বিউটির স্বামী এম এ হাসান এবং ২০১৯ সালের জুন মাসে বিউটি খুন হলে বদলে যায় পরিস্থিতি। চনপাড়ার ‘নিয়ন্ত্রণ’ চলে আসে বজলুর কাছে। তিনি রূপগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (চনপাড়া) সদস্য। একই সঙ্গে তিনি কায়েতপাড়া ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান।
চনপাড়া আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, বজলুর ইশারা ছাড়া কিছুই হয় না। এলাকায় কারা থাকবেন, কারা থাকবেন না—এটাও ঠিক করেন তিনি।
পুলিশের হিসাবে হত্যাসহ ৯টি মামলার আসামি বজলুর। সর্বশেষ গত বছরের জুলাই মাসে তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হয়। পুলিশের করা এই মামলায় তিনি জামিনে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগও রয়েছে।
পুলিশ সূত্র বলছে, চনপাড়ার বিভিন্ন এলাকার পাঁচটি বাহিনী সক্রিয়। এসব বাহিনী মাদক কেনাবেচা, চাঁদাবাজি, ‘অজ্ঞান’ পার্টি, ‘মলম’ পার্টিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত। প্রথম বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে জয়নাল আবেদীন, দ্বিতীয়টির নেতৃত্বে শাহীন মিয়া ওরফে সিটি শাহীন, তৃতীয় বাহিনী চালান সাদ্দাম হোসেন ওরফে স্বপন, চতুর্থ বাহিনীর প্রধান মো. রাজা এবং পঞ্চম বাহিনীর নেতা আনোয়ার হোসেন। তাঁরা সবাই বিউটি হত্যা মামলার আসামি। বিউটির স্বামী হাসান হত্যায় আসামি করা হয়েছে জয়নাল, শাহীন ও আনোয়ারকে। চনপাড়ার মধ্যেই এলাকাভিত্তিক গড়ে ওঠা এসব বাহিনীর ‘নিয়ন্ত্রক’ বজলুর। প্রতিটি বাহিনীর প্রধানের বিরুদ্ধে মাদক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে খুন হন একটি বাহিনীর প্রধান আনোয়ার হোসেন।
নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বজলুর রহমান ইউপি সদস্য এবং স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ার কারণে বিভিন্ন অপরাধে তাঁর সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন তাঁরা।
চনপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বজলুর ঢাকায় থাকেন। তবে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তিনি চনপাড়ায় যান। এলাকায় তিনজন দেহরক্ষী নিয়ে তিনি চলাচল করেন। বজলুর এলাকায় বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর লোক হিসেবে পরিচিত।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, চনপাড়ায় যত বাহিনী আছে, সব কটির মূল নিয়ন্ত্রক বজলুর রহমান।
চনপাড়ায় কোনো সমস্যা হলে আগে বজলুরকে বোঝাতে হয়। তাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া না হলে সেখানে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি হামলার শিকার হতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। এর মূল কারণ জায়গাটি বেশ দুর্গম। সড়কপথে যাওয়ার রাস্তা একটি। অভিযানে গেলে মূল রাস্তার প্রবেশমুখে সাত থেকে আট হাজার নারী ও শিশু মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে জড়ো হয়ে যায়। ফলে অপরাধীদের ধরা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
বালু নদ ও শীতলক্ষ্যা নদীসংলগ্ন ১২৬ একর জমির ওপর ১৯৭৪ সালে একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র (চনপাড়া) গড়ে তোলা হয়। পুলিশ বলছে, দ্বীপের মতো এই এলাকাটিতে ঢাকা ও আশপাশের এলাকার অপরাধীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বজলুর তিনজন দেহরক্ষী নিয়ে চলাচল করেন। এলাকায় তিনি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর লোক হিসেবে পরিচিত।
একাধিক খুনের ঘটনায় বজলুর ঘনিষ্ঠরা
চনপাড়া আওয়ামী লীগের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বজলুর ইশারা ছাড়া কিছুই হয় না। চনপাড়ায় কারা থাকবেন, কারা থাকবেন না—এটা নির্ধারণ করেন বজলুর। এলাকায় কোনো খুনের ঘটনা ঘটলে পরে দেখা যায় এর সঙ্গে বজলুর ঘনিষ্ঠরা জড়িত। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিউটি আক্তারের স্বামী হাসান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি শাহীনকে (চনপাড়ার একটি অপরাধী বাহিনীর প্রধান) জামিনে বের করে আনতে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন বজলুর।
পুলিশ জানায়, গত বছরের জুনে বজলুর ঘনিষ্ঠ জয়নাল ও শাহীন বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় জয়নাল ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। এই মামলায় জয়নাল এখন কারাগারে। জয়নালের বিরুদ্ধে হত্যা, মাদকসহ ১০টির বেশি মামলা রয়েছে। অথচ তাঁকেই স্থানীয় মাদক নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক করেছেন বজলুর রহমান। জয়নালের হাতে ছিল চনপাড়ার ৬ নম্বর ইউনিটের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ।
এসব বিষয়ে ইউপি সদস্য বজলুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এক দশেকর বেশি সময় ধর তিনি চনপাড়ার জনপ্রতিনিধি। এলাকায় তাঁর পক্ষ-বিপক্ষ আছে। এলাকায় বিভিন্ন অপরাধী বাহিনীও আছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাঁদের মধ্যে গন্ডগোল হয়। তারাই খুনসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটাচ্ছে। চনপাড়া ঘনবসতি হওয়ার কারণে মাদক এখানকার মূল সমস্যা। মাদক ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় না দিয়ে তিনি নির্মূলে প্রশাসনকে সহায়তা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে করা অস্ত্র আইনের মামলাটি ভুল–বোঝাবুঝি ছিল। আর স্থানীয় যুবদল নেতা চান মিয়া হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।
আমি একজন ইউপি সদস্য। এটা করার ক্ষমতা আমার নেই। মাদক নির্মূলে কমিটি সবাই মিলে করেছেন। পরে মন্ত্রী মহোদয় (গোলাম দস্তগীর গাজী) অনুমতি দিয়েছেন।বজলুর রহমান
মাদক ব্যবসায়ীকে স্থানীয় মাদক নির্মূল কমিটির সভাপতি বানানোর বিষয়ে বজলুর রহমান বলেন, ‘আমি একজন ইউপি সদস্য। এটা করার ক্ষমতা আমার নেই। মাদক নির্মূলে কমিটি সবাই মিলে করেছেন। পরে মন্ত্রী মহোদয় (গোলাম দস্তগীর গাজী) অনুমতি দিয়েছেন।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। তবে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ভয়ের পরিবেশ
৯ সেপ্টেম্বর চনপাড়ায় গিয়ে স্থানীয় ১২ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলছে প্রথম আলো। তাঁদের একজনও নাম উদ্ধৃত হয়ে বজলুর রহমানকে নিয়ে কিছু বলতে চাননি।
বজলুর বিষয়ে স্থানীয় বিএনপির নেতারা অভিযোগ করেছেন, গত দুই মাসে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ১৩ জন নেতা-কর্মীকে তুলে নিয়ে জিম্মি করে অর্থ আদায় করেছেন বজলুর রহমান। টাকা না দিলে মাদক মামলায় জড়ানো হবে, এমন হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করেছেন তিনি। একেকজনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির নেতারা।
অবশ্য বিএনপির এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বজলুর রহমান। তাঁর দাবি, ষড়যন্ত্র করে তাঁর বিরুদ্ধে এসব কথা রটানো হচ্ছে।
এলাকার লোকজন তাঁর (বজলুর) ভয়ে সত্য কথা বলতে পারেন না। কিছু বললেই দলবল নিয়ে মানুষের ওপর নির্যাতন করেন। এমনকি আওয়ামী লীগের লোকজনের ওপরও জুলুম–নির্যাতন করা হচ্ছে। মন্ত্রীর লোক হওয়ায় তাঁকে কেউ কিছু বলতে পারছেন নাইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামসুল আলম
তবে বজলুরকে টাকা দিয়েছেন, বিএনপির এমন ১০ জন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা কেউই পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। তাঁরা বলেছেন, বজলুকে নিয়ে কথা বললে পরিবার নিয়ে এলাকায় থাকতে পারবেন না। এর মধ্যে চনপাড়ার বিএনপির একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ আগস্ট তাঁকে বজলুর লোকজন ধরে নিয়ে ইয়াবা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখায়। পরে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তিনি ছাড়া পান।
সর্বশেষ গত রোববার বজলুর দেহরক্ষীরা ‘চনপাড়া মোড়’ (অটোরিকশাস্ট্যান্ড) থেকে রূপগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলামকে তুলে নিয়ে যায়। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় ওই দিনই রাতে তাঁকে ছেড়ে দেন বজলুর।
রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বজলুর ভয়ে প্রায় এক মাস ধরে তিনি এলাকার বাইরে ছিলেন। রোববার এলাকায় ফিরে এলে বজলুর তাঁকে অপহরণ করে একটি কক্ষে আটকে রাখেন। সেখানে তাঁকে নির্যাতন করা হয়। মুক্তিপণ হিসেবে পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে বজলুর। বিষয়টি সবাই জেনে যাওয়ায় রাতে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
পুলিশের কাছে অভিযোগ করেননি কেন, জানতে চাইলে রফিকুল বলেন, ‘এখন তো আমার পরিবার এলাকায় থাকতে পারছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে পুরো পরিবারকে এলাকাছাড়া করবে।’
স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকে অপহরণ করার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বজলুর একজনকে নিয়ে (রফিকুল) গেছেন, এমন তথ্য তাঁরা পেয়েছিলেন। পরে ওই ব্যক্তিকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেছে পুলিশ। তবে এ ঘটনায় কেউ অভিযোগ করেননি। কেউ অভিযোগ করলে সেটি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইউপি সদস্য বজলুর বিষয়ে গত সপ্তাহে চনপাড়ায় গিয়ে স্থানীয় পাঁচজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। একজনও নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে চাননি। সবার একই কথা, বজলুর বিরুদ্ধে চনপাড়ায় কারও কথা বলার সাহস নেই।
পরে ঢাকা থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলো কথা বলেছে চনপাড়া যে ইউনিয়নের আওতাভুক্ত, সেই কায়েতপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামসুল আলমের সঙ্গে। তবে তিনি এখন আর চনপাড়ায় থাকেন না। থাকেন ডেমরার সারুলিয়ায়।
আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে আমরা সঠিক কথা বলতে পারি না। শুধু চনপাড়া নয়, পুরো কায়েতপাড়া ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণ করা হয় চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে। দেশের সব অঞ্চলের অপরাধীরা সেখানে আশ্রয় নেয়। এসবের নিয়ন্ত্রক বজলুর। তাঁকে ইউপি সদস্য করা হয়েছে, প্যানেল চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এখানে মাদকের কারবার চলে প্রকাশ্যে।’
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, এলাকার লোকজন তাঁর (বজলুর) ভয়ে সত্য কথা বলতে পারেন না। কিছু বললেই দলবল নিয়ে মানুষের ওপর নির্যাতন করেন। এমনকি আওয়ামী লীগের লোকজনের ওপরও জুলুম–নির্যাতন করা হচ্ছে। মন্ত্রীর লোক হওয়ায় তাঁকে কেউ কিছু বলতে পারছেন না।