সংসদীয় কমিটির বৈঠক নিয়ে তাঁদের আগ্রহ কম

জাতীয় সংসদের ১০টি সংসদীয় কমিটির ১২৮টি বৈঠকের মধ্যে মাত্র ২টিতে সব সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো এমনিতেই নিয়মিত বৈঠক করে না। আবার অনিয়মিতভাবে যেসব বৈঠক হয়, সেসব বৈঠকেও সংসদ সদস্যদের বড় একটি অংশ অনুপস্থিত থাকেন। চলমান একাদশ জাতীয় সংসদের ১০টি সংসদীয় কমিটির মোট ১২৮টি বৈঠকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মাত্র ২টি বৈঠকে কমিটির সব সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ৮টি এবং বিষয়ভিত্তিক ২টি সংসদীয় কমিটির তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। যে ১০টি সংসদীয় কমিটির গত তিন বছরের ১২৮টি বৈঠকের তথ্য পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো, সেসব কমিটির সদস্য ১০৫ জন। এর মধ্যে ৩৬ জন সংসদ সদস্যের নিজ নিজ সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থিতি ছিল ৫০ শতাংশের কম।

আরও পড়ুন

মন্ত্রণালয়ভিত্তিক প্রতিটি সংসদীয় কমিটির সদস্য থাকেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ ১০ জন। বিষয়ভিত্তিক কমিটির সদস্যের সংখ্যা সাধারণত ১০ জনের চেয়ে বেশি হয়। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক যেসব কমিটির তথ্য পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বরাষ্ট্র; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান; মুক্তিযুদ্ধ; মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়; রেলপথ; যুব ও ক্রীড়া এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। আর বিষয়ভিত্তিক দুটি কমিটি হচ্ছে সরকারি হিসাব এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। প্রতিটি সংসদীয় কমিটি সাধারণত ১০টি বৈঠক করার পর জাতীয় সংসদে প্রতিবেদন দিয়ে থাকে।

গত জানুয়ারি মাসে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি জাতীয় সংসদে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১১ থেকে ২৩তম পর্যন্ত ১৩টি বৈঠকের কোনোটিতেই ছিলেন না জাতীয় পার্টির সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য সালমা ইসলাম। ওয়ার্কার্স পার্টির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য লুৎফুন নেসা খান ওই ১৩টি বৈঠকের মধ্যে মাত্র ৩টিতে অংশ নিয়েছেন। তা ছাড়া এই কমিটির সদস্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা এবং মো. শাহজাহান মিয়া চারটি করে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। কমিটির আরেক সদস্য সৈয়দা রাশিদা বেগম অংশ নিয়েছেন ছয়টি বৈঠকে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, সদস্যদের উপস্থিতি কম হওয়ার একটি বড় কারণ ২০২০ সালের মার্চ থেকে দুই বছর দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। সদস্যদের যাঁদের বয়স একটু বেশি, তাঁরা করোনার সময় একটু কম এসেছেন। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় সদস্যদের উপস্থিতিও বাড়বে

অবশ্য করোনার সংক্রমণের মতো কোনো দুর্যোগ ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালে ছিল না। ওই সময় দশম সংসদ ছিল। তখনো সংসদীয় কমিটির বৈঠকে সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি এখনকার মতোই ছিল। সংসদীয় কার্যক্রম নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদন পার্লামেন্ট ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, গত দশম সংসদেও সংসদীয় কমিটিতে সদস্যদের গড় উপস্থিতি ছিল ৫৫ শতাংশ। টিআইবি ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল।

অনেক সংসদ সদস্য হয়তো সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থাকার চেয়ে তাঁর অন্য কাজকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
নিজামউদ্দিন আহমদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক

জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে প্রতিটি সংসদীয় কমিটির মাসে অন্তত একটি বৈঠক করার বাধ্যবাধকতা আছে। এতে আরও বলা হয়েছে, কমিটির অনুমতি ছাড়া কোনো সদস্য পরপর দুটি বা তার চেয়ে বেশি বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে ওই সদস্যকে কমিটি থেকে পদচ্যুত করার জন্য সংসদে প্রস্তাব আনা যেতে পারে।

বর্তমান সংসদ যাত্রা শুরুর মাত্র ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ৫০টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি করা হয়েছিল। এসব কমিটির মধ্যে ৩৯টি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত। বাকি ১১টি কমিটি বিষয়ভিত্তিক। দ্রুততার সঙ্গে কমিটি গঠন করা হলেও বেশির ভাগ কমিটির তেমন তৎপরতা নেই। দুয়েকটি কমিটি ছাড়া কোনো কমিটি প্রতি মাসে বৈঠক করে না। এর মধ্যে ২০২১ সালে সংসদীয় কমিটিগুলোর বৈঠকের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাত্র আটটি সংসদীয় কমিটি সক্রিয় ছিল। এসব কমিটি হচ্ছে নৌপরিবহন, মহিলা ও শিশু, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন; বিদ্যুৎ–জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; পররাষ্ট্র এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

বৈঠক হলেও অনুপস্থিত তাঁরা

চলতি সংসদে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বৈঠক করেছে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। অবশ্য এই কমিটি এক দিনেই দুই থেকে তিনটি বৈঠক করে। এই কমিটির সদস্য ১৫ জন। সরকারি হিসাব কমিটির সর্বশেষ ২০টি (৫৩–৭২তম) বৈঠকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৫ সদস্যের মধ্যে ৭ জনই বৈঠকে অনেকটা অনিয়মিত। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর ২০টি বৈঠকের একটিতেও অংশ নেননি। বিএনপির সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের জহিরুল হক ভূঞা অংশ নিয়েছেন মাত্র একটি বৈঠকে।

জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তিনবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এরপর পবিত্র ওমরা হজ করতে গিয়েছিলেন। এ কারণে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে তাঁর উপস্থিতি কম ছিল। এখন থেকে নিয়মিত কমিটির বৈঠকে অংশ নেবেন।

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২০টি (১ম থেকে ২০তম) বৈঠকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই কমিটির ১০ সদস্যের মধ্যে ৫ জনেরই উপস্থিতি ৫০ শতাংশের নিচে। তাঁরা হলেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, এ কে এম রহমতুল্লাহ, রাজি উদ্দিন আহমেদ, এ বি তাজুল ইসলাম ও ওয়ারেসাত হোসেন। এর মধ্যে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ কোনো বৈঠকেই অংশ নেননি।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সংসদে যে ১২টি বৈঠকের বিষয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই কমিটির ১০ জন সদস্যের ৩ জন অনিয়মিত। এর মধ্যে দিদারুল আলম উপস্থিত হয়েছেন মাত্র দুটি বৈঠকে। আর মৃণাল কান্তি দাস ও ইকবাল হোসেন চারটি করে বৈঠকে অংশ নেন।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ১৩টি বৈঠকের মধ্যে এই কমিটির সদস্য শফিকুল ইসলাম ৫টিতে, নাছিমুল আলম চৌধুরী ৪টি এবং এইচ এম ইব্রাহিম ৬টি বৈঠকে অংশ নেন। কমিটির বাকি সাত সদস্যের উপস্থিতি ৬০ শতাংশের ওপরে। অবশ্য এই কমিটির একটি বৈঠকে সব সদস্য অংশ নিয়েছেন।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ১২তম থেকে ২০তম বৈঠকে তিনজন সদস্যের উপস্থিতি ৫০ শতাংশের নিচে ছিল। তাঁরা হলেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, আলী আজগর ও নুরুজ্জামান বিশ্বাস।

সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি প্রথম যে ১১টি বৈঠক করেছে, তাতে কমিটির ১০ সদস্যের মধ্যে ৩ জনের উপস্থিতি ৫০ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে ওমর ফারুক চৌধুরী অংশ নিয়েছেন মাত্র ১টি বৈঠকে। এ ছাড়া জিল্লুল হাকিম ৩টি এবং নারায়ণ চন্দ্র চন্দ উপস্থিত ছিলেন ৫টি বৈঠকে।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির প্রথম ১০টি বৈঠকের কোনোটিতেই অংশ নেননি বীরেন শিকদার। এই কমিটির সদস্য জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা উপস্থিত ছিলেন একটি বৈঠকে। বাকি ৮ জন সদস্যের উপস্থিতি ৫০ শতাংশের ওপরে।

কমিটিগুলোর মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্যদের উপস্থিতি তুলনামূলক ভালো। প্রথম থেকে দশম বৈঠকের বিবরণী নিয়ে সংসদে দেওয়া এই কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, একজন সদস্যের উপস্থিতি ৫০ শতাংশের নিচে ছিল। তিনি আফছারুল আমিন। এই কমিটির একটি বৈঠকে ১০ সদস্যের সবাই উপস্থিত ছিলেন।

যেসব কমিটি নিয়মিত বৈঠক করছে, তার একটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। এই কমিটির সদস্যদের বৈঠকে অংশগ্রহণ তুলনামূলক ভালো। তবে ২১তম থেকে ৩০তম—এই ১০টি বৈঠকের মধ্যে কমিটির সদস্য এম আবদুল লতিফ ১টি বৈঠকেও ছিলেন না। আরেক সদস্য মাহফুজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন ৩টি বৈঠকে। অবশ্য এম আবদুল লতিফ দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। এর আগে তিনি কমিটির বৈঠকে মোটামুটি নিয়মিত ছিলেন।

আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, করোনার আগে থেকে তিনি প্রায় দুই বছর অসুস্থ ছিলেন। চলাফেরা করতে পারেননি। এখন সুস্থ হয়েছেন। তাই আগের মতোই নিয়মিত সব বৈঠকে অংশ নেবেন।

মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সংসদীয় কমিটির প্রধান দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা, অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা। বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেওয়া বা সুপারিশ করাও সংসদীয় কমিটির কাজ। বিল পরীক্ষার কাজটি করা হলেও মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কমিটিগুলোকে খুব একটা সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ও আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে।

সংসদীয় কমিটির বৈঠক করা সংসদ সদস্যদের নিয়মিত কাজের অংশ। সংসদ-সদস্য (পারিতোষিক ও ভাতাদি) আদেশ ১৯৭৩ অনুযায়ী, সংসদীয় কমিটির বৈঠকের জন্য সদস্যরা ভাতা পেয়ে থাকেন। এই ভাতার মধ্যে আছে যাতায়াত ভাতা ও অবস্থানকালীন ভাতা। কমিটির বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য নিজের এলাকা থেকে বৈঠকে আসার জন্য রেল, বিমান, স্টিমার বা লঞ্চের সংক্ষিপ্ত রুটের প্রথম শ্রেণির ভাড়ার দেড় গুণ অর্থ পান। আর সড়কপথে যাতায়াত হলে প্রতি কিলোমিটারের জন্য ১০ টাকা হারে মাইলেজ ভাতা পান। এর বাইরে একজন সদস্য ‘দায়িত্বরত অবস্থানকালে’ (সাধারণত ঢাকায় থাকলে) প্রতিদিনের জন্য ৭৫০ টাকা হারে দৈনিক ভাতা এবং ৭৫ টাকা হারে যাতায়াত ভাতা পান। সংসদীয় কমিটির বৈঠকের ক্ষেত্রে এ অবস্থানকালের মেয়াদ কমিটির বৈঠকের দুই দিন আগে থেকে বৈঠক শেষ হওয়ার পরবর্তী দুই দিন পর্যন্ত। তবে কোনো সংসদ সদস্য সংসদীয় কমিটির বৈঠকে অংশ না নিলে তিনি এসব সুবিধা বা ভাতা পাবেন না।

সংসদ বিষয়ে গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজামউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান সংসদকে এক অর্থে বিরোধী দলবিহীন সংসদ বলা যায়। এ কারণে সংসদের মতো সংসদীয় কমিটিগুলোও তেমন কার্যকর নয়। শক্ত বিরোধী দল থাকলে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার সুযোগ থাকলে হয়তো কমিটির বৈঠকে সদস্যরা বেশি আগ্রহী হতেন।

এই গবেষক বলেন, সংসদীয় কমিটির আলোচ্যসূচিতেও এখন তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকে না। শক্তভাবে বক্তব্য দেন এমন সদস্যের সংখ্যাও এই সংসদে তুলনামূলক কম। এসব মিলিয়ে অনেক সংসদ সদস্য হয়তো সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থাকার চেয়ে তাঁর অন্য কাজকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।