[জ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্ত এমন খুবই কম সংখ্যক বাংলাদেশি ব্যক্তি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অধ্যাপক মীজান রহমান তেমনই এক ব্যক্তি, যিনি আজীবন জ্ঞানচর্চায় সম্পৃক্ত ছিলেন। মূলত তিনি গণিতবিদ। তবে গণিতবিদ্যা ছাড়াও বাংলাদেশের যে কয়জন একাডেমিয়ার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষাবিদ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন, বাংলাদেশকে পরিচিত করতে পেরেছেন দর্পভরে বিশ্বের অঙ্গনে তার মধ্যে মীজান রহমান অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন তিনি; এরপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এমএ) এবং কানাডার ব্রান্সউইকে (পিএইচডি)। তারপর সেই ১৯৬৫ সালে কানাডার অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন, সেখানে একটানা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের গণিতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা শিক্ষকের সম্মানসহ বহু সম্মানেই তিনি ভূষিত হয়েছেন।
শুধু শিক্ষক হিসেবে তিনি খ্যাতিমান তা নন, শিক্ষায়তনে সাফল্য পেতে হলে যা যা দরকার, সবই তাঁর ঝুলিতে ছিল। গণিতের বিখ্যাত জার্নালগুলোতে খুঁজলেই যে কেউ পাবেন তাঁর অসংখ্য গবেষণাপত্রের হদিস; পাশাপাশি কিছুদিন আগে গণিতশাস্ত্রের পণ্ডিত জর্জ গ্যাসপারের সঙ্গে লিখেছেন মহামূল্যবান একটি পাঠ্যপুস্তক বেসিক হাইপারজিওমেট্রিক সিরিজ (১৯৯০) শিরোনামে, যেটা প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই গণিতের ছাত্রদের জন্য অবশ্যপাঠ্য পুস্তক হিসেবে বিবেচিত।
ড. মীজান বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক আলবার্তো গুনবাম এবং নেদারল্যান্ডসের গণিতবিদ এরিখ কোয়েলিংক প্রমুখের সঙ্গেও গণিতবিষয়ক বহু গবেষণা করেছেন। গণিতে তাঁর অবদান এতটাই বিস্তৃত ছিল যে ১৯৯৮ সালে কানাডার ওই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তাঁকে ‘ইমেরিটাস অধ্যাপক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক মীজান পরে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘Distinguished Research Professor’-এর খেতাবও পেয়েছিলেন। উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড এশকি নাকি তাঁকে সিম্বলিক ক্যালকুলেশনের ক্ষেত্রে ‘মাস্টার’ হিসেবে ডাকতেন। গণিত বিষয়ে বাংলাদেশের কিংবদন্তির তালিকা কেউ বানাতে বসলে মীজান রহমানকে বাদ দিয়ে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু গণিতের কাঠখোট্টা জগতের বাইরেও তাঁর আরেকটা পরিচিতি ছিল। তিনি ছিলেন সুসাহিত্যিক। তাঁর প্রথম দিককার উপন্যাস লাল নদী (২০০১) পড়ে আলোড়িত হয়েছিলাম সে সময় যা এক সমাজসচেতন প্রগতিশীল সুলেখকের প্রতিচ্ছবি। আরও কিছু বই রয়েছে তীর্থ আমার গ্রাম, প্রসঙ্গ নারী, অ্যালবাম, অন্যান্য আমার দেশ, আনন্দ নিকেতন, দুর্যোগের পূর্বাভাস, ভাবনার আত্মকথন, শুধু মাটি নয় প্রভৃতি। (তাঁর সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন অভিজিত্ রায়ের ‘অধ্যাপক মীজান রহমান: এক নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ’)। অধ্যাপক মীজান রহমান শুধু একজন গণিতবিদ ও শিক্ষাবিদ ছিলেন না। তিনি একই সঙ্গে মুক্তচিন্তক ও সমাজসচেতন। প্রতিচিন্তার প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। দূর থেকে এ উদ্যোগের তিনি একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। মৃত্যুর ছয় মাস আগে প্রতিচিন্তার জন্য তিনি এ লেখাটি পাঠিয়েছিলেন। প্রতিচিন্তা মূলত সমাজবিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল। তাই তাঁর লেখাটি ছাপার ব্যাপারে আমাদের দ্বিধা ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর এই লেখাটি ছাপার মধ্য দিয়ে তাঁর বহুমাত্রিক জ্ঞান অনুশীলনের প্রতি রইল, আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। সম্পাদক]