
দোষে-গুণে মানুষ। মানবজীবনের ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার জন্য প্রয়োজন দোষ বা মন্দ গুণাবলি বর্জন ও ভালো গুণাবলি অর্জন। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘শপথ মানবসত্তার! এবং তাঁর, যিনি তা স্থিত করেছেন। অতঃপর তাতে দিয়েছেন অপরাধপ্রবণতা ও তার ভীতি। সফল তারা, যারা তা পবিত্র করে এবং ব্যর্থ তারা, যারা তা কলুষিত করে।’ (৯১: ৭-১০)। মানবচরিত্রের মন্দ স্বভাব বা নেতিবাচক গুণাবলিকে পরিভাষায় রাজায়েল বলা হয়। মৌলিক ১০টি বদগুণ হলো: হিরছ (লোভ), তমা (উচ্চাভিলাষ), রিয়া (প্রদর্শনেচ্ছা), কিবর (অহংকার), কিজব (মিথ্যা), গিবত (পরনিন্দা), হাছাদ (হিংসা), উজব (অহমিকা), কিনা (পরশ্রীকাতরতা) ও বুখল (কৃপণতা)। (তাসাউওফ তত্ত্ব)।
গিবত
‘গিবত’ অর্থ পরনিন্দা, পরচর্চা, পেছনে সমালোচনা ও দোষচর্চা ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায় ‘গিবত’ হলো কোনো ব্যক্তির সত্য অপরাধ বা দোষ–ত্রুটি তার অনুপস্থিতিতে বা অসাক্ষাতে আলোচনা করা বা বলা, যা শুনলে বা জানলে সে মনে কষ্ট পাবে বা মনঃক্ষুণ্ন হবে। ‘তুহমত’ অর্থ কারও চারিত্রিক স্খলনের অভিযোগ করা, কামাচার ও ব্যভিচারের জন্য দোষারোপ করা। ‘বুহতান’ হলো মিথ্যা অপবাদ বা অসত্য অভিযোগ। শিকায়েত মানে উপযোগ, অনুযোগ, অভিযোগ। সাধারণত ‘গিবত-শিকায়েত’ জোড়া শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গিবত করা আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমান। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা একে অন্যের গিবত কোরো না; তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করে? তা তোমরা অপছন্দই করো।’ (৪৯:১২)। কোরআন মজিদে আরও বলা হয়েছে: ‘দুর্ভোগ (জাহান্নাম) ওই সব ব্যক্তির জন্য, যারা পশ্চাতে ও সমুখে সমালোচনা করে; দোষ অনুসন্ধান ও নিন্দা চর্চা করে।’ (১০৪:১)। সাহাবায়ে কিরাম নবীজি (সা.)-কে বললেন, হুজুর! যদি সত্যিই তার মধ্যে সে দোষ থাকে তাহলেও কি তা বলা গিবত হবে? নবীজি (সা.) বললেন, সত্য সমালোচনাই ‘গিবত’ আর তা মিথ্যা হলে তো ‘তুহমত’ (যা গিবত অপেক্ষা আরও ভয়ংকর)। গিবত-শিকায়েত, তুহমত ও বুহতান ইত্যাদি হাক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হকের অন্তর্ভুক্ত।
হাছাদ
‘হাছাদ’ অর্থ হিংসা, দ্বেষ, বিদ্বেষ, রোষ, ঘৃণা ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায় ‘হাছাদ’ হলো কোনো ব্যক্তির সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তার ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টা করা। ‘হাছাদ’-এর সঙ্গে ‘ফাছাদ’ বা বিপর্যয়, ক্ষতি, ধ্বংস, হিংস্রতা ও সহিংসতার সংযোগ রয়েছে। কোরআন করিমে রয়েছে: আর আপনি বলুন, আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় নিই হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে। (১১৩:৫)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: হাছাদ বা হিংসা নেকি ও পুণ্যসমূহকে ছারখার করে দেয়; অগ্নি যেমন কাঠ ও লাকড়ি পুড়িয়ে ছাইভস্ম করে দেয়। (তিরমিজি)। হিংসা একপ্রকার আগুন, যা মানুষের নেকিসমূহকে নিঃশেষ করে দেয়, অন্তরকে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে দেয়। হিংসুটে ব্যক্তি সব সময় তুষের অনলে জ্বলতে থাকে। আমৃত্যু সে দহনযন্ত্রণা ভোগ করতে থাকে, পরকালেও জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবে। হাছাদ বা হিংসা একটি নেতিবাচক ক্রিয়া বা অপকর্ম, যাতে হিংসুক নিজের কোনো প্রাপ্তি ছাড়া অন্যের ক্ষতি সাধনে ব্রতী থাকে।
উজব
‘উজব’ অর্থ আত্মতুষ্টি, অহমিকা, অহংবোধ, আত্মাভিমান, খোদপছন্দি বা আত্মম্ভরিতা। উজব শব্দটি আজব (অবাক, চমৎকার), আজিব (আশ্চর্য, অস্বাভাবিক) ও তাজ্জব (অবাক হওয়া, চমৎকৃত হওয়া) শব্দের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ইসলামের পরিভাষায় উজব হলো নিজের গুণ
ও বৈশিষ্ট্যে নিজে অহংকার করা, নিজের তুলনায় অন্যদের হেয় ও তুচ্ছ জ্ঞান করা। ‘উজব’-এর সঙ্গে ‘কিবর’ বা অহংকারের সংযোগ রয়েছে। তাকাব্বুরি বা অহংকারের মূল হলো উজব। উজব অভ্যন্তরে সক্রিয় হলে তা কিবর বা অহংকাররূপে প্রকাশ পায়। উজব সম্পর্কে কোরআন করিমে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা জেনে রাখো, পার্থিব জীবন ক্রীড়া–কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক শ্লাঘা, ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততিতে প্রাচুর্যলাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত কিছুই নয়। এর উপমা হলো বৃষ্টি-বারি, যা দ্বারা উৎপন্ন শস্যসম্ভার কৃষকদের চমত্কৃত করে, অতঃপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তা পীতবর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে উহা খড়কুটায় পরিণত হয়। (অহংকারীদের জন্য) পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং (বিনয়ীদের জন্য পরকালে রয়েছে) আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার সামগ্রী ব্যতীত কিছুই নয়। (৫৭:২০)।
যারা উজব ব্যাধিতে আক্রান্ত, তারা সব সময় নিজের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করে; তাদের সম্মুখে অন্য কোনো জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির প্রশংসা তারা সহ্য করতে পারে না। উজবে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেকে সর্বেসর্বা, সব গুণের আধার ও সব কাজের কাজি মনে করে। উজবগ্রস্ত ব্যক্তিরা নিজেকে বড় দেখে, নিজেকে ছাড়া অন্য সবাইকে ছোট দেখে।
উজবে নিপতিত ব্যক্তিরা নিজেদের যত্সামান্য পরিমাণ বা কিঞ্চিত্কর নেক আমল ও ভালো কাজকে পাহাড়সম মনে করে, ফলে তাদের আমল বরবাদ হয়ে যায়, যা তারা বুঝতে বা অনুভব করতে পারে না। পরিণতিতে তারা ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উজব একটি কঠিন ও গুরুতর আত্মিক রোগ। এর নিরাময় ও উপশমের জন্য শুদ্ধ আত্মার সংস্পর্শ ও সংস্রব অতি জরুরি।
কিনা
‘কিনা’ অর্থ পরশ্রীকাতরতা, গোপন শত্রুতা, সংকীর্ণমনা বা পরের সুখে দুঃখ পাওয়া। ইসলামের পরিভাষায় কিনা হলো অন্যের প্রাপ্তি বা সফলতায় দুঃখিত বা কাতর হওয়া। ‘কিনা’র সঙ্গে ‘হাছাদ’ বা হিংসার সংযোগ রয়েছে। কিনা হাছাদ বা হিংসা অপেক্ষা সূক্ষ্মতর বিষয়। হাছাদ বা হিংসার মূল হলো কিনা। কিনা অন্তরে সঞ্চারিত হলে তা হাছাদ বা হিংসারূপে প্রকাশ পায়। কিনা হলো মনের সংকীর্ণতার ফল বা ক্ষুদ্র মানসিকতার প্রভাব, যা কিছু কিছু নিম্নশ্রেণির ইতর প্রাণীর সহজাত স্বভাব। কিনা দোষে দুষ্ট ব্যক্তি সবকিছুই নিজের জন্য চায় এবং সর্বদা অন্যের অপ্রাপ্তি ও ব্যর্থতা কামনা করে। হাদিস শরিফে আছে: ‘প্রকৃত মুসলমান সে, যে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, অন্যের জন্যও তা-ই পছন্দ করে।’ (মুসলিম)।
বুখল
‘বুখল’ অর্থ কৃপণতা বা কার্পণ্য। ইসলামের পরিভাষায় বুখল বা কার্পণ্য হলো পরোপকার থেকে বিরত থাকা ও ব্যয়কুণ্ঠ হওয়া। ইসলামি পরিভাষায় ‘বুখল’ হলো ফরজ জাকাত ও ওয়াজিব সদাকাত প্রদান না করা এবং কর্তব্যকর্ম সম্পাদনে বিমুখ থাকা। বখিল অর্থ কৃপণ ব্যক্তি। এর স্ত্রীলিঙ্গ হলো ‘বখিলা’। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আর যে কৃপণতা করল ও অহংকার করল এবং সত্য ও সুন্দরকে অস্বীকার করল; আমি তার জীবনকে কঠিন করে দেব।’ (৯২:২৮-৩০)। ‘অচিরেই কিয়ামতের দিনে আমি তাদের গলায় তওক (ফাঁস) বানিয়ে দেব, যা তারা কার্পণ্য করেছে। যারা আল্লাহ তাদের যা দিয়েছেন তাঁর অনুগ্রহে তাতে কার্পণ্য করছে, তারা যেন মনে না করে যে তা তাদের জন্য কল্যাণকর।’ (৩:১৮০)। ‘যখন তাদের কাছে তাঁর (আল্লাহর) অনুগ্রহ এল, তারা তাতে কার্পণ্য করল আর তারা মুখ ফিরিয়ে এড়িয়ে গেল।’ (৯:৭৬)। ‘তুমি তাদের ডাকছ, যাতে তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের মধ্যে এমনও রয়েছে যারা কৃপণতা করে। যারা কার্পণ্য করে প্রকৃতপক্ষে তারা নিজের প্রতি কার্পণ্য করে; আল্লাহ ধনবান. তোমরা সবাই অভাবী।’ (৪৭:৩৭-৩৮)। ‘যারা নিজেরা কৃপণতা করে ও মানুষকে কৃপণ হতে নির্দেশ করে এবং আল্লাহ সানুগ্রহে তাদের যা দিয়েছেন তা গোপন করে।’ (৪:৩৭)। ‘যারা কৃপণতা করে ও মানুষকে কৃপণ হতে নির্দেশ করে আর যারা বিমুখ হয়; তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা অমুখাপেক্ষী ও প্রশংসিত।’ (৫:২৪)। ‘আপনি কি তাদের দেখেছেন, যারা কর্মফল অবিশ্বাস করে? আর তারা পরোপকারে বিরত থাকে।’ (১০৭:১/৭)।
হাদিস শরিফে আছে: কৃপণ আল্লাহ থেকে দূরে, মানুষ থেকে দূরে, বেহেশত থেকে দূরে এবং দোজখের কাছে। উদার ব্যক্তি আল্লাহর নিকটে, মানুষের নিকটে, বেহেশতের নিকটে ও দোজখ থেকে দূরে। কৃপণ ইবাদতকারী অপেক্ষা একজন সাধারণ উদার মনের মানুষ আল্লাহর বেশি প্রিয়। (তিরমিজি শরিফ)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com