হজের শিক্ষা ও হজ-পরবর্তী করণীয়

.
.

হজ ইসলামের পাঁচটি মূল ভিত্তির অন্যতম। কোরআন শরিফে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন: ‘আল্লাহর তরফ থেকে সেসব মানুষের জন্য হজ ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যঁারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখেন।’ (সুরা আলে ইমরান; আয়াত: ৯৭)। পবিত্র হজ আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ বিধান। আল্লাহ হজ পালনের মধ্যে মহান উদ্দেশ্য নিহিত রেখেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রকৃত হজের পুরস্কার বেহেশত ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যাঁরা হজ পালন করবেন আল্লাহ তাঁদের হজ কবুল করবেন এবং তাঁদের জন্য অফুরন্ত রহমত ও বরকত অবধারিত।
হজ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘সুবিদিত মাসসমূহে হজব্রত সম্পাদিত হয়। অতঃপর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য অশ্লীলতা, কুৎসা, অন্যায় আচরণ, ঝগড়া ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নয়।’ (সুরা বাকারা; আয়াত: ১৯৭)। তাই সর্বদা তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করে চলতে হবে। কারও ব্যবহার পছন্দ না হলেও রাগ করা যাবে না বা কটু কথা বলা যাবে না, কারও মনে কষ্ট দেওয়া যাবে না। কারও দ্বারা যদি কারও কোনো ক্ষতি হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। অন্যের বিপদে সর্বদা সাহায্য করার চেষ্টা করতে হবে। খেদমত নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা যাবে না; বরং খেদমত করাকে সৌভাগ্য ও গৌরবজনক মনে করতে হবে। সর্বত্র সর্বদা নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। দেহ ও মন সব সময় পবিত্র রাখতে হবে। সব সময় অজুর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করতে হবে এবং মনে মনে সব সময় আল্লাহর জিকির জারি রাখতে হবে। নিজের স্বার্থ আগে উদ্ধার করার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। নিজের আগে অন্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কোনো মুসলমান ভাইয়ের হক নষ্ট করা যাবে না। নফসকে নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধ, নম্রতা, ভদ্রতা ও উদারতা শিক্ষায় দীক্ষিত ও উন্নীত করতে হবে।

হজের দর্শন
মানুষের পরিচয় একটাই, সে মানুষ। পৃথিবীর সব মানুষ একই পিতা-মাতার সন্তান। তাই মানুষে মানুষে কোনো প্রকার ভেদাভেদ নেই, শুভ্রকায় ও কৃষ্ণকায় কোনো প্রভেদ নেই। বর্ণবৈষম্য ও বংশকৌলীন্য এগুলো মানুষের কৃত্রিম সৃষ্টি। পদ-পদবি ও অবস্থানগত পার্থক্য মানুষের মধ্যে যে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে, হজের মাধ্যমে তা দূর হয়। তাই হজকে মানবতার প্রশিক্ষণ বলা যায়। হজের পাঁচ দিন এই প্রশিক্ষণ কোর্সের মেয়াদকাল। ৭ জিলহজ তারিখে সব হাজি মিনার তাঁবুতে গণবিছানায় গিয়ে একাত্মতার ঘোষণা দেন। ৯ জিলহজ তারিখে হাজিরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে ঐক্যের অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেন; মিলিত হন আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে। ৯ জিলহজ সন্ধ্যা ১০ জিলহজের রাতে হাজিরা মুজদালিফায় গিয়ে সব কৃত্রিমতার অবসানের মাধ্যমে মানবতার পূর্ণতা ও আদি আসল প্রকৃত মানব রূপ লাভ করেন। সবার পদতলে মৃত্তিকা, মাথার ওপর উন্মুক্ত আকাশ, সবারই পরনে একই কাপড়। পোশাকে বাহুল্য নেই, খোলা মাথা, পাগড়ি, টুপি ও লম্বা চুলের আড়ম্বর নেই; সঙ্গে সেবক–কর্মচারী নেই, গন্তব্য এক হলেও রাস্তা জানা নেই—চেনা রাস্তাই যেন অচেনা, নিজের শক্তি-সামর্থ্য ও জ্ঞান-গরিমার প্রকাশ নেই, বুদ্ধি-বিবেচনা ও কৌশল প্রয়োগের সুযোগ নেই; শুধুই আল্লাহর ওপর ভরসা। এটিই মানবতার পূর্ণতা। এটিই হজের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও আসল শিক্ষা। এই হলো মানবতার প্রশিক্ষণ।

শয়তানকে পাথর মারা
শয়তানকে পাথর মারা একটি প্রতীকী বিষয়। দুই প্রকার শয়তানের কথা কোরআনের সর্বশেষ সুরায় সর্বশেষ আয়াতে উল্লেখ আছে; এরা হলো জিন শয়তান ও মানুষ শয়তান। (সুরা নাস, আয়াত: ৬)। এ ছাড়া রয়েছে নফস শয়তান। এই ত্রিবিধ শয়তানের প্ররোচনা ও তাড়না থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং মনোজগতে শয়তানি শৃঙ্খল বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার এবং সব ধরনের শয়তানি ভাব ও প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে একমাত্র বিবেকের অনুসরণে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলার ইবাদত তথা আনুগত্য করাই হলো শয়তানকে পাথর মারার মূল উদ্দেশ্য।

পশু কোরবানি
প্রিয়তমের জন্য অন্য সবকিছু বিসর্জন দেওয়াই কোরবানির মূল প্রতিপাদ্য। পশু কোরবানি একটি প্রতীক মাত্র। নিজের মনের মধ্যে যে পশুবৃত্তি বিদ্যমান রয়েছে, তাকে পরাভূত ও পরাজিত করাই হলো পশু জবাই বা পশু কোরবানির আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। এর মাধ্যমে আপন মনের সব কুপ্রবৃত্তিকে চিরতরে বিদায় করা এবং নিজ চরিত্রের সব কুস্বভাব পরিত্যাগ করাই আসল উদ্দেশ্য।

হজের সুফল
সব দেশের, সব বর্ণের, সব পেশার, সব শ্রেণির, সব মতের মানুষ একই ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করেন। এতে ভিন্নমতসহ ঐক্যের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ সহাবস্থান করেন বলে ভাষার দূরত্ব দূর হয়ে মনের নৈকট্য অর্জন হয় এবং প্রকৃত মানবিক অনুভূতি জাগ্রত হয়। মনের সংকীর্ণতা দূর হয়; দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়, চিন্তার বিকাশ সাধিত হয়। একদেশদর্শী মনোভাব দূর হয়ে বহুদর্শিতা ও দূরদর্শিতা অর্জন হয়।
প্রকৃত হাজি তাঁরা, যাঁরা হজের শিক্ষা লাভ করে ধন্য হন। তাঁরা হজকে জীবন পরিবর্তনের অপূর্ব সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং হজ-পরবর্তী জীবনে হজের শিক্ষা বজায় রেখে জীবন পরিচালনা করেন। এ রকম হাজির সংখ্যা বাড়লে দেশ ও জাতির মঙ্গল সাধিত হবে, জনমানুষের কল্যাণ হবে; অন্যথা অর্থের অপচয়, সময়ের অপচয়, শক্তি-সামর্থ্যের অপব্যবহার ও নফসের গোলামি বা আত্মপূজাই সার হবে।
নামের সঙ্গে হাজি বিশেষণ যুক্ত করা
হজ শুধুই ইবাদত। এটি কোনো সার্টিফিকেট কোর্স নয় বা অর্জিত পদ-পদবিও নয়। তাই হজ করার পর নিজ থেকেই নামের সঙ্গে হাজি বিশেষণ যোগ করা সমীচীন নয়। অন্য কেউ তা করলে কিছু করার নেই। প্রসঙ্গত, একবার হজ করলে ‘হাজি’, তিনবার হজ করলে ‘আলহাজ’ এ ধরনের কোনো পরিভাষা আরবি ভাষা ও ব্যাকরণে নেই এবং এটি ইসলামি শরিয়া বিধান তথা কোরআন, হাদিস ও ফিকহের কোথাও নেই।

হজ-পরবর্তী করণীয়
কবুল হওয়া বা না হওয়ার নিরিখে হজ তিন প্রকার। যথা হজে মাবরুর, হজে মাকবুল ও হজে মারদুদ। হজে মাবরুর মানে হলো সর্বোত্তম হজ। হজে মাবরুর হলো যে হজ সব মানদণ্ডে শতভাগ মানোত্তীর্ণ হয়; হজে মাকবুল মানে হলো যে হজ কবুল হয়েছে বা কবুল হজ। হজে মাকবুলও মানোত্তীর্ণ হজ। হজে মারদুদ মানে হলো রদ তথা পরিত্যাজ্য বা পরিত্যক্ত তথা বাতিলকৃত হজ। অর্থাৎ যে হজ কবুল হয়নি বা বাতিল হয়েছে। হজ বাতিল হতে পারে নিয়ত বিশুদ্ধ না হলে বা উদ্দেশ্য সঠিক না থাকলে। হজের অর্থ হালাল না হলে বা বৈধ উপার্জন না হলে। হজের ফরজ, ওয়াজিব তথা আরকান-আহকাম সঠিকভাবে আদায় করা না হলে এবং হজের সময় নিষিদ্ধ কোনো কর্ম সম্পাদন করলে। সর্বোপরি হজের শিক্ষা অর্জন না করলে বা হজের উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হলে সেই হজ বাতিল হয়।

হজ কবুলের আলামত
হজ কবুল হলো কি হলো না, তা জানেন শুধু আল্লাহ তাআলা। তবে হজ কবুলের কিছু বাহ্যিক আলামত বা নিদর্শন রয়েছে। যেমন: যাঁরা হজের পরে কাজকর্মে, আমলে-আখলাকে, চিন্তাচেতনায় পরিশুদ্ধি অর্জন করবেন বা আগের চেয়ে উন্নতি লাভ করবেন, তাঁরাই হবেন প্রকৃত হাজি। কিন্তু যাঁরা হজ করার পরও কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন বা উন্নতি সাধনে ব্যর্থতার পরিচয় দেবেন, তাঁরা হলেন হজে মারদুদ সম্পাদনকারী। হজ করা বড় কথা নয়; জীবনব্যাপী হজ ধারণ করাই আসল সার্থকতা।
নবী করিম (সা.) বলেন, হজ ও ওমরাহর জন্য গমনকারী ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার বিশেষ মেহমান। তিনি দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করেন। কবুল হজের মাধ্যমে মানুষ নিষ্পাপ হয়ে যায়। (মুসলিম, তিরমিজি, মিশকাত)। যাঁর হজ কবুল হবে, হজের পরও ৪০ দিন পর্যন্ত তাঁর দোয়া কবুল হবে; এমনকি যত দিন তিনি গুনাহে লিপ্ত না হবেন, তত দিন তাঁর সব দোয়া কবুল হতেই থাকবে।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com