জগন্নাথের রথযাত্রা

আরও পড়ুন

শ্রীকৃষ্ণের অনেক নামের একটি হচ্ছে জগন্নাথ। ‘জগন্নাথ’ শব্দের অর্থ ‘জগতের নাথ বা প্রভু’। পুরাণ বলে, কৃষ্ণের বোন সুভদ্রা বাপের বাড়ি এলে তিনি দুই দাদার কাছে নগরভ্রমণের ইচ্ছার কথা জানান। কৃষ্ণ ও বলরাম তখন সুভদ্রার সঙ্গে রথে ঘুরতে বের হন। এর পর থেকেই নাকি রথযাত্রার সূচনা।

আরেক কাহিনি মতে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাশে গুণ্ডিচা মন্দিরে কৃষ্ণের মাসির বাড়ি। তাঁদের মাসি তিন ভাইবোনকেই বাড়ি আসার আমন্ত্রণ জানান। তারপরই রথযাত্রা করে কৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রা সাত দিন, মতান্তরে দশ দিনের জন্য মাসির বাড়ি ঘুরতে যান।

রথযাত্রা নিয়েও ভিন্নমত রয়েছে। শ্রীচৈতন্যদেবের মতে, শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় আসার পর ব্রজগোপীরা তাঁর দর্শনে মথুরায় এসে ঐশ্বর্য ও বৈভবের কারণে তাঁর সঙ্গে ভালোভাবে মেলামেশার সুযোগ না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান। শ্রীকৃষ্ণ এ খবর পেয়ে বিচলিত হয়ে বছরে একবার রাজ–ঐশ্বর্য ছেড়ে বৃন্দাবনে এসে পৌর্ণমাসীর কুঞ্জে বিরাজ করেন। এটিই নাকি রথযাত্রা।

আরও পড়ুন

অন্য মতে, মামা কংস কুমতলবে কৃষ্ণ ও বলরামকে মথুরায় নিয়ে আসার জন্য রথসহ অক্রূরকে বৃন্দাবনে পাঠান। তাঁরা রথে করে মথুরায় আসার সময় কৃষ্ণভক্তরা শোভাযাত্রা করে সেই রথের সঙ্গে যাচ্ছিলেন। সে ঘটনাই রথযাত্রা। রথযাত্রার শুধু দেবতার নয়, ভক্তেরও। দেবতার প্রতি ভালোবাসার টান থেকেই তো ভক্তরা তাঁর রথকে নিয়ে এগিয়ে চলেন।

সাধারণভাবে রথ বলতে আমরা পৌরাণিক বাহন বুঝি। যাতায়াতের কাজ ছাড়াও মূলত ঘোড়ায় টানা এই বাহনের বহুল ব্যবহার দেখা যায় যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু রথযাত্রার রথের পরিপ্রেক্ষিত পুরাণের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। এ রথে নেই কোনো অস্ত্রের ঝনঝনানি। নেই সামান্যতম বৈরিতার সুর। এই রথেও আছে জয়ের বার্তা। সে জয় শান্তি, মৈত্রী ও প্রেমের।

আরও পড়ুন

রথে আসীন বলরাম, সুভদ্রাসহ প্রভু জগন্নাথ। এই তিন মূর্তি নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অনেক পণ্ডিতের মতে, এই তিন মূর্তির রূপকল্পে অনন্তের ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে। বিচিত্র এই রূপের কারণেই বৈষ্ণব থেকে শুরু করে শৈব—সব ধর্মই আপন করে নিয়েছে জগন্নাথকে। তিনি তাই হয়ে ওঠেন শৈবের শিব, বৈষ্ণবের বিষ্ণু। শাক্তমতে তিনি দেবী বিমলার ভৈরব। বৌদ্ধশাস্ত্রে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা যথাক্রমে বুদ্ধ, সংঘ ও ধর্মেরই প্রতিরূপ। জৈনমতে, এই তিন বিগ্রহ তাঁদের ধর্মের আদি প্রবর্তক ঋষভ দেব প্রচারিত সম্যক জ্ঞান, সম্যক চরিত ও সম্যক দৃষ্টির প্রতীক। দেখা যাচ্ছে, নানা ধর্মের নানা মতকে এক সুতায় বেঁধেছেন জগন্নাথ।

রথযাত্রা নিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন:

রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,

ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।

পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,

মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।

আরও পড়ুন

কবিগুরু তাঁর কবিতায় রথযাত্রা নিয়ে যে কথা বলেছেন, তার গূঢ় অর্থ আমরা কতটা জানি? এ প্রসঙ্গে কঠোপনিষদ স্মরণ করতে হয়। কঠোপনিষদে বলা হয়েছে, ‘আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।/ বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মন: প্রগ্রহমেব চ।।’ (১/৩/৩) এর অর্থ হচ্ছে, ‘এই দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী। ঈশ্বর থাকেন অন্তরে। তার মানে দাঁড়ায়, ঈশ্বর আমাদের অন্তরে থাকেন। তাঁর কোনো রূপ নেই। তিনি সর্বত্র বিরাজিত।’

মানুষের জীবনে সব উৎসবের মূল ভিত্তি হলো মানুষের সুখে থাকা, সমৃদ্ধিতে থাকা ও শান্তিতে থাকা। রথযাত্রা জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রার সংসর্গে অর্থ, সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তির প্রতীক হয়ে ধরা দেয়।

রথের আরাধ্য দেবতার রূপ যেমনই হোক না কেন, ভক্তের কাছে তা ভালোবাসার নির্ভরতা ও আত্মনিবেদনের। রথযাত্রা বাঙালি সমাজের কাছে প্রাণের আনন্দযাত্রা। রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে। মেলা মানে মিলন। এর মূল সুর সর্বধর্মের সমন্বয়।

রথযাত্রা শুধু উৎসব বা মেলা নয়, রথ গতি ও এগিয়ে চলার প্রতীক। তাই পরিবর্তনশীল বিশ্বে বারবার যুগান্তরের প্রতীক হিসেবে কবির কলমে উঠে আসে, ‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী।/ হে চিরসারথী, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি...।’

আরও পড়ুন