মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন সত্তা। চিন্তা, বিশ্বাস, মতপ্রকাশ ও সিদ্ধান্ত—এসবই মানুষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তি, সমাজ বা জাতি নিজের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের উপর কর্তৃত্ব হারায়, তখন সেই অবস্থাকে বলা হয় পরাধীনতা।
পরাধীনতা শুধু রাজনৈতিক শাসনের বিষয় নয়; এটি মানসিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও চিন্তাগতও হতে পারে। অনেক সময় মানুষ বাহ্যিকভাবে স্বাধীন থেকেও ভেতরে ভেতরে পরাধীন হয়ে পড়ে।
প্রতিটি পরাধীনতার ভিন্ন ভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব থাকলেও ইসলামের দৃষ্টিতে নৈতিক ও আত্মিক পরাধীনতাই সবচেয়ে ভয়ংকর।
পরাধীনতার অর্থ ও ব্যাপ্তি
পরাধীনতা মানে অন্যের অধীনে থাকা, নিজের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা না থাকা। এটি কয়েকটি স্তরে দেখা যায়:
প্রথমত, রাজনৈতিক পরাধীনতা—যেখানে একটি জাতি অন্য শক্তির শাসন বা নিয়ন্ত্রণে থাকে। ইতিহাসে উপনিবেশবাদ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক পরাধীনতা—যখন ব্যক্তি বা রাষ্ট্র নিজের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, ঋণ, শোষণ বা বৈষম্যের মাধ্যমে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত, সাংস্কৃতিক ও চিন্তাগত পরাধীনতা—যেখানে মানুষ নিজের ভাষা, মূল্যবোধ ও চিন্তাকে তুচ্ছ মনে করে অন্যের সংস্কৃতিকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে।
চতুর্থত, নৈতিক ও আত্মিক পরাধীনতা—যখন মানুষ প্রবৃত্তি, ভয়, লোভ বা সামাজিক চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
প্রতিটি পরাধীনতার ভিন্ন ভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব থাকলেও ইসলামের দৃষ্টিতে এই শেষ প্রকার পরাধীনতাই সবচেয়ে ভয়ংকর।
ইসলামে পরাধীনতার ধারণা
ইসলাম মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতাকে সংজ্ঞায়িত করেছে এক কথায়—আল্লাহর দাসত্ব। কারণ মানুষ যদি আল্লাহর দাস না হয়, তবে সে অবশ্যই অন্য কিছুর দাস হবে—মানুষের, ক্ষমতার, অর্থের বা প্রবৃত্তির। আল্লাহ বলেন, “তারা কি আল্লাহ ছাড়া অন্যকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করেছে?” (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৩৯)
এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয়, আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে মাথা নত করাই পরাধীনতা।
রাসুল (স.) বলেন, “দীনার ও দিরহামের দাস ধ্বংস হোক।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৮৮৭)
পরাজয় ও পরাধীনতা মানুষের চরিত্রে দাসত্বের ছাপ ফেলে।
তখনকার সময়ের স্বর্ণমুদ্রাকে বলা হতো দিনার এবং রৌপ্যমুদ্রাকে বলা হতো দিরহাম। হাদিসে দিনার ও দিরহাম বলে আসলে অর্থবিত্তকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ সম্পদ ও ভোগের দাসত্বও এক ধরনের পরাধীনতা।
পরাধীনতার মানসিক প্রভাব
পরাধীনতা মানুষের আত্মসম্মান ধ্বংস করে। একজন পরাধীন ব্যক্তি ধীরে ধীরে। নিজের মত প্রকাশে ভীত হয়ে পড়ে
ন্যায়কে অন্যায়ের কাছে সমর্পণ করে। সত্য বলার সাহস হারায়। দাসসুলভ মানসিকতায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। এই মানসিকতা প্রজন্মের পর প্রজন্মে সঞ্চারিত হলে পুরো সমাজ স্থবির হয়ে পড়ে।
ইবন খালদুন বলেছেন, “পরাজয় ও পরাধীনতা মানুষের চরিত্রে দাসত্বের ছাপ ফেলে।” (আল-মুকাদ্দিমাহ, ১/২৮৭, দারুল ফিকর, বৈরুত, ২০০৪)
কোরআনের আলোকে মুক্তির পথ
কোরআন বারবার মানুষকে ভীতিহীন, দৃঢ় ও স্বাধীনচেতা হতে আহ্বান করেছে। আল্লাহ বলেন, “অতএব মানুষের ভয় করো না, আমাকে ভয় করো।” (সুরা মায়িদাহ, আয়াত: ৪৪)
আবার বলেন, “আল্লাহ ছাড়া কারও সামনে নত হয়ো না।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬৪)
এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে, আল্লাহভীতি মানুষকে অন্য সব ভয় থেকে মুক্ত করে।
ইতিহাসে পরাধীনতা থেকে মুক্তির দৃষ্টান্ত
বিলাল (রা.)-এর জীবন পরাধীনতা ভাঙার এক অনন্য উদাহরণ। দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি হয়েও তিনি বলেছিলেন, “আহাদ, আহাদ।” অর্থাৎ এক আল্লাহই আমার প্রভু। তাঁর এই ইমানই তাঁকে প্রকৃত স্বাধীনতা দিয়েছিল।
উমর (রা.) বলেছিলেন, “আমরা এমন এক জাতি, যাকে আল্লাহ ইসলাম দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আমরা যদি অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্মান চাই, আল্লাহ আমাদের লাঞ্ছিত করবেন।” (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭/১৩১, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৯৮)
পরাধীনতা এখন ভোগবাদী সংস্কৃতির দাসত্ব, মিডিয়ার চিন্তানিয়ন্ত্রণ, ভোক্তা মানসিকতা, নৈতিক আপসকামিতা, আত্মপরিচয়ের সংকট—এমন নানারূপে হাজির হয়েছে।
পরাধীনতা থেকে মুক্তির উপায়
প্রথমত, সঠিক আকিদা। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় না করা
দ্বিতীয়ত, জ্ঞান। অজ্ঞতা পরাধীনতার প্রধান উৎস
তৃতীয়ত, আত্মসম্মান ও নৈতিক দৃঢ়তা
চতুর্থত, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে অবস্থান
পঞ্চমত, দায়িত্বশীল স্বাধীনতা—যেখানে স্বাধীনতা মানে সীমাহীন ভোগ নয়, বরং দায়িত্বশীল জীবন
আধুনিক যুগে পরাধীনতার নতুন নতুন রূপ দেখা যায়। আজ পরাধীনতা শুধু শাসকের চাবুক নয়। পরাধীনতা এখন ভোগবাদী সংস্কৃতির দাসত্ব, মিডিয়ার চিন্তানিয়ন্ত্রণ, ভোক্তা মানসিকতা, নৈতিক আপসকামিতা, আত্মপরিচয়ের সংকট—এমন নানারূপে হাজির হয়েছে।
এ যুগের সবচেয়ে বিপজ্জনক পরাধীনতা হলো চিন্তার পরাধীনতা, যেখানে মানুষ নিজের মতো ভাবতেই ভুলে যায়।
পরাধীনতা মানুষের মর্যাদা ও আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করে। ইসলাম মানুষকে শিখিয়েছে, আল্লাহর দাসত্বই প্রকৃত স্বাধীনতা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে নত হয়, সে আর কোনো শক্তির কাছে নত হয় না।
ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র—সব স্তরে পরাধীনতা ভাঙতে হলে ইমান, জ্ঞান ও নৈতিক সাহসের কোনো বিকল্প নেই।