জ্ঞান-বিজ্ঞানে নারী ০২
মধ্যযুগে মুসলিম নারী স্বাস্থ্যকর্মীরা
ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই চিকিৎসা শাস্ত্রে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। চিকিৎসা, নার্সিং, ওষুধ তৈরি, এমনকি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় মুসলিম নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। মধ্যযুগে মুসলিম নারী চিকিৎসকদের ভূমিকা নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক রচনার আজ দ্বিতীয় পর্ব।
কায়রোর আল-মানসুরি হাসপাতালের প্রাঙ্গণে এক নারী দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, হাতে রোগীর চিকিৎসা নথি। তিনি শিহাবুদ্দিন আল-সায়িগের (মৃ. ১৬২৭ খ্রি.) মেয়ে, এই হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক। তাঁর নির্দেশে চিকিৎসক ও ধাত্রীরা ব্যস্তভাবে রোগীদের সেবা করছেন।
উমাইয়া, আব্বাসীয় ও আন্দালুসের যুগে মুসলিম নারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা শুধু রোগীদের সেবাই করেননি, বরং চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অবদান রেখেছেন। এই পর্বে আমরা দেখব মধ্যযুগে মুসলিমবিশ্বে নারীদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভূমিকা এবং সমাজে তাঁদের প্রভাব।
নারীরা শুধু চিকিৎসা দিতেন না, বরং ওষুধ তৈরি ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতেন।
মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্ব ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। আব্বাসীয় খলিফারা গ্রিক, পারসিক ও ভারতীয় চিকিৎসা গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বাগদাদের বায়তুল হিকমা এই জ্ঞানের কেন্দ্র ছিল।
এই সময়ে নারীরাও চিকিৎসা গবেষণা ও সেবায় অংশ নেন। ইমাম তাবারি (৮৩৮-৯২৩ খ্রি.) উল্লেখ করেন, বাগদাদের বিমারিস্তানে (হাসপাতাল) নারী চিকিৎসকেরা কাজ করতেন। (তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ৮/৩২১, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৮৫)
নারীরা শুধু চিকিৎসা দিতেন না, বরং ওষুধ তৈরি ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতেন।
ইসলামি শিক্ষা নারীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। কোরআনের আহ্বান, ‘আমার প্রভু, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।’ (সুরা তাহা: ১১৪) এবং মহানবী (সা.)-এর বাণী, ‘জ্ঞান অন্বেষণ প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ২২৪) নারীদের চিকিৎসা শিক্ষায় উৎসাহিত করেছিল।
আন্দালুসে আল-জাহরাভির (৯৩৬-১০১৩ খ্রি.) কন্যারা তাঁর কাছ থেকে চিকিৎসা শিখে প্রসূতি ও শিশু চিকিৎসায় কাজ করেন। (আল-জাহরাভি, আত-তাসরিফ, ৩০/৪৫৬, কায়রো: দারুল কুতুব, ১৯০৮)
মধ্যযুগে মুসলিম নারীরা চিকিৎসার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। এখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ও তাঁদের কাজ তুলে ধরা হলো:
আল-হাফিদ ইবনে জুহরের বোন ও কন্যারা (১০৯৪-১১৬২ খ্রি.): আন্দালুসে তাঁরা প্রসূতি ও শিশু চিকিৎসায় দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁরা শাসক আল-মানসুরের স্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। ইবনে জুহরের পরিবার পাঁচ প্রজন্ম ধরে চিকিৎসায় নেতৃত্ব দেয়। (আল-শাত্তি, তারিখুল তিব ওয়া আখলাকিয়াতুহু, পৃ. ২৫৬, দামেস্ক: দারুল ফিকর, ১৯৬০)
দুহন আল-লৌজ (মৃ. ১২১৬ খ্রি.): দামেস্কে তিনি চিকিৎসক ও মুসলিম পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর দক্ষতা চিকিৎসা ও ধর্মীয় শিক্ষায় সমানভাবে প্রশংসিত হয় (আল-সাঈদ, আল-তিব, পৃ. ২৩৪)।
নুরুদ্দিন জানকি ১১৫৬ খ্রিষ্টাব্দে আল-নুরি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিনত দুহন আল-লৌজের সময়ে চালু ছিল। এই হাসপাতালে নারী চিকিৎসকেরা প্রায়ই নারী রোগীদের চিকিৎসা করতেন, বিশেষ করে প্রসূতি ও গাইনোকোলজির ক্ষেত্রে।
উম্ম হাসান বিনত কাজি তানজালি (১৪ শতক): আন্দালুসে তিনি চিকিৎসা শিক্ষা ও অনুশীলনে বিখ্যাত ছিলেন। তিনি চিকিৎসা গ্রন্থ না লিখলেও তাঁর শিক্ষাদান কোরআনের তাজবিদ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রভাব ফেলে। তিনি বলতেন, ‘লেখকেরা লেখেন, কর্মীরা করেন।’ (আবু বকর ও আল-সাদি, আন-নিসা ওয়া মিহনাত আল-তিব, পৃ. ২১২, কায়রো: দারুল কুতুব, ১৯৯৯)
শিহাবুদ্দিন আল-সায়িগের কন্যা (মৃ. ১৭ শতক): কায়রোর আল-মানসুরি হাসপাতালে প্রধান চিকিৎসক ছিলেন। তিনি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে নারী ও পুরুষ চিকিৎসকেরা একযোগে কাজ করতেন। (আল-সাঈদ, আল-তিব ওয়া রায়িদাতুহু আল-মুসলিমাত, পৃ. ১৮৯, আম্মান: দারুল ফিকর, ১৯৮৫)।
এ ছাড়া আব্বাসীয় যুগে মাহবুবা (মৃ. ৮৬১ খ্রি.) বাগদাদে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন এবং তাঁর কাজ সমাজে প্রশংসিত হয়। (আল-সাঈদ, আল-তিব, পৃ. ২৪৫)
নারীরা গৃহে রোগী পরিদর্শনেও যেতেন। একজন পুরুষ চিকিৎসক এক নারী রোগীকে বলেন, ‘আমি চক্ষু চিকিৎসক, তবে আমাদের একজন নারী চিকিৎসক আপনার চিকিৎসা করবেন।’
মধ্যযুগে হাসপাতালগুলো ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের কেন্দ্র। বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডোভায় নারীরা হাসপাতালে কাজ করতেন। আল-মানসুরি হাসপাতালে নারী চিকিৎসকেরা প্রসূতি ও নারী রোগের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ ছিলেন। আন্দালুসে আল-জাহরাভি তাঁর গ্রন্থ আত-তাসরিফে প্রসূতি ও ধাত্রীবিদ্যার ১০টি অধ্যায় লেখেন, যা নারী চিকিৎসকদের শিক্ষার জন্য ব্যবহৃত হতো।
এ ছাড়া ইমাম তাবারি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক গ্রন্থে নারী চিকিৎসকদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এক স্থানে লিখেছেন, ‘নারীরা গৃহে রোগী পরিদর্শনেও যেতেন। উল্লেখ করেন, একজন পুরুষ চিকিৎসক এক নারী রোগীকে বলেন, ‘আমি চক্ষু চিকিৎসক, তবে আমাদের একজন নারী চিকিৎসক আপনার চিকিৎসা করবেন।’ (তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ৮/৩২১, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৮৫)
তুরস্কে পঞ্চদশ শতাব্দীতে শরফুদ্দিন সাবুনচুওগলু (১৩৮৫-১৪৬৮ খ্রি.) তাঁর গ্রন্থ সিরাহিয়্যাতুল হানিয়্যায় নারী শল্যচিকিৎসকদের চিত্র অঙ্কন করেন। তাঁরা গাইনোকোলজিকাল অস্ত্রোপচার, যেমন জরায়ুর ক্ষত সারানো বা অস্বাভাবিক প্রসব পরিচালনা করতেন। এই চিত্রগুলো নারীদের জটিল শল্যচিকিৎসায় অংশগ্রহণের প্রমাণ দেয়। (মুসলিম হেরিটেজ, ওমেন্স কন্ট্রিবিউশন টু ক্লাসিক্যাল ইসলামিক সিভিলাইজেশন, ৭ জুলাই ২০২০)
তাঁরা গাইনোকোলজিকাল অস্ত্রোপচার, যেমন জরায়ুর ক্ষত সারানো বা অস্বাভাবিক প্রসব পরিচালনা করতেন। এই চিত্রগুলো নারীদের জটিল শল্যচিকিৎসায় অংশগ্রহণের প্রমাণ দেয়।
নারী চিকিৎসকেরা শুধু রোগীদের সেবা করেননি, বরং সমাজের কাঠামো শক্তিশালী করেছেন। আল-মানসুরি হাসপাতালে শিহাবুদ্দিনের কন্যা চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেন। আন্দালুসে উম্ম হাসান শিক্ষাদানের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম তৈরি করেন।
এই নারীরা সমাজের নিম্নবর্গ, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের সেবায় অগ্রণী ছিলেন। মুসলিম সমাজে নারীদের চিকিৎসা পেশা পুরুষদের সমান মর্যাদা পেত। এই নারীরা পুরুষ-নারীনির্বিশেষে সমাজের সব স্তরে সেবা দিয়েছেন।
প্রথম পর্ব : ইতিহাসে মুসলিম নারী চিকিৎসক
(মুসলিম হেরিটেজ ডটকম অবলম্বনে)