উম্মে সালামা (রা.): অনন্য সাহসী

ছবি: ফ্রিপিক

ইসলাম আগমনের প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছিলেন উম্মে সালামা (রা.)। ইসলামের সত্যতা ও অনিবার্যতা বুঝে নিতে সামান্য সময়ক্ষেপণ হয়নি তাঁর। এটা নিঃসন্দেহে উম্মে সালামার বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও তাঁর অসীম সাহসিকতার পরিচায়ক।

কারণ, তিনি যেই সময়ে ইসলাম কবুল করেছেন, সেই সময়কার অবস্থা যে মোটেও মুসলমানদের অনুকূলে ছিল না, প্রত্যহ তাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছিল সমূহ বিপদের, সেটা তাঁর অজানা ছিল না।

তবু সত্য গ্রহণে যে তিনি পিছপা হননি এবং কালবিলম্ব করেননি বাহ্যত সেই অগ্নিমাল্য বরণ করে নিতে, এটাই প্রমাণ করে, তিনি আপস করবার মানুষ ছিলেন না!

ইসলাম সত্য। রাসুল সত্য। সত্য তাঁর আনীত মহান দ্বীন। সুতরাং তা কবুলে ও তার বিস্তারে ভয় কিসের—এমনই ছিল উম্মে সালামার মানসিকতা! এবং বাস্তবিক অর্থেও ইসলাম কবুলের পর থেকেই তাঁর সাহস ও মানসিক শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়ে গেছেন তিনি আমৃত্যু।

বাস্তবিক অর্থেও ইসলাম কবুলের পর থেকেই তাঁর সাহস ও মানসিক শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়ে গেছেন তিনি আমৃত্যু।

আবিসিনিয়ার প্রথম হিজরত, দ্বিতীয় হিজরত, একা মদিনার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া এবং শতেক বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে মদিনা অবধি পৌঁছা—এর সবই ছিল দ্বীন ও সত্যের জন্য তাঁর সাহসিকতার একেকটি দাস্তান!

এরপর যখন তিনি জড়িয়ে গেলেন নবীজীবনের সঙ্গে, নিজেকে আসীন করলেন উম্মুল মুমিনিনের (মুমিনদের মা) উচ্চকিত মর্যাদায়—তাঁর সাহসিকতা যেন অনন্য মাত্রা লাভ করল। অধিকার প্রতিষ্ঠায়, নিজের প্রাপ্য আদায়ে কিংবা দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের জন্য জিজ্ঞাসা, প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখে চলেন।

আরও পড়ুন

ভয় কিংবা শঙ্কা—এ সবের কোনো কিছুই দ্বীনের নতুন কিছু জানবার ব্যাপারে তাঁর সম্মুখে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে না। দ্বীনের আপাত-জটিল কোনো সমস্যার সমাধানে রাসুলের মুখোমুখি হতে অযাচিত আড়ষ্টতা তাঁকে কখনো আটকে রাখতে পারে না! বিনয়-আদব-শিষ্টাচার ও সাহসিকতার বিরল মূর্তি ছিলেন উম্মে সালামা (রা.)।

এ ক্ষেত্রে আমরা সেই ঘটনাটি মনে করতে পারি। সাহাবায়ে কেরাম হাদিয়া-তোফা কেবল আয়েশার ঘরেই পাঠাতেন। নবীজির অন্য স্ত্রীগণ এতে কিছুটা মনোযাতনার মুখোমুখি হন। সাহাবিরা কেন একজনকেই কেবল হাদিয়া দেবেন, তাঁরাও তো রাসুলেরই সহধর্মিণী!

তখন রাসুলকে এ বিষয়টি অবগত করাবার জন্য তাঁরা প্রতিনিধি হিসেবে উম্মে সালামাকেই বেছে নেন। কারণ, আর কারও বুকে অতটা সাহস সঞ্চার হচ্ছিল না যে আয়েশার ব্যাপারে কথা বলতে রাসুলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন।

উম্মে সালামার সাহসিকতার উপলব্ধিতে আমরা আরেক দিনের আরেকটি ঘটনা স্মরণে আনতে পারি। একবার নবীজি তাঁর স্ত্রীদের প্রতি কোনো কারণে মনঃক্ষুণ্ন হন এবং সবার থেকে আলাদা হয়ে একাকী থাকতে শুরু করেন। হজরত ওমর (রা.)–এর কন্যাও (হাফসা) ছিলেন তাঁদের একজন।

একান্ত পারিবারিক ব্যাপারে ওমরের এমন অযাচিত প্রবেশ তিনি ভালোভাবে নিতে পারেন নি এবং পেছনে তাঁর কাজের সমালোচনা না করে সামনেই বলে দেন।

ওমর (রা.) নবী-পরিবারের এই সমস্যার মীমাংসায় উদ্যোগী হয়ে নবীজির বাড়িতে এলেন। কন্যা হাফসাকে খানিক ধমকাধমকির পর গেলেন উম্মে সালামার কাছে। তাঁর কাছে গিয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলতেই উম্মে সালামা তাঁকে বলে ওঠেন, ‘কী আশ্চর্য হে খাত্তাবপুত্র, সবখানে নাক গলাতে গলাতে এখন নবী-পরিবারেও নাক গলাতে চলে এসেছেন!’ এমন কথার পর ওমরের আর কী থাকে বলার মতো! (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪,৯১৩)

উম্মে সালামার চিন্তা ছিল—যা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ দাম্পত্য জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, স্বামী-স্ত্রীর মান-অভিমান। প্রতিটি পরিবারেরই এমন নিজস্ব কিছু অভিমানভরা গল্প থাকে। থাকে কিছু হাসি, আনন্দ ও বেদনার কোলাহল। এগুলো একান্তই আন্তরিক ও স্বামী-স্ত্রীর নিজস্ব বিষয়। ওমর কেন সেই একান্ত গল্পের অযাচিত চরিত্র হতে যাবে! তিনি কেন অন্যের দাম্পত্যের মতো একদমই আন্তরিক বিষয়ে মতামত দিতে আসবে!

একান্ত পারিবারিক ব্যাপারে ওমরের এমন অযাচিত প্রবেশ তিনি ভালোভাবে নিতে পারেন নি এবং পেছনে তাঁর কাজের সমালোচনা না করে সামনেই বলে দেন। এমনই ছিলেন উম্মে সালামা।

আরও পড়ুন

উম্মে সালামার অসীম সাহসিকতার আরেকটি দৃষ্টান্ত এখানে আমরা হাজির করতে পারি। এটা রাসুলের ইন্তেকালের বহুকাল পরের ঘটনা। তখন হিজরি ৩৬ সাল। মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে লজ্জাজনক ও বেদনাদায়ক বছর। এ বছরেই সংঘটিত হয় জঙ্গে জামাল বা উষ্ট্রীর যুদ্ধ।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ যুদ্ধে মুসলমানের রক্ত ঝরে তারই জ্ঞাতিগোষ্ঠী মুসলমানের হাতে। আশারায়ে মুবাশশারা তালহা ও জুবাইরের মতো বুজুর্গ সাহাবি শাহাদাতবরণ করেন এই নির্মম ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধেই। বসরার মাটি ১০ হাজার মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হয়।

এই নির্মমতার পেছনের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছিল ইসলামবিরোধী একটি মহল। খলিফা ওসমানের মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনাকে পুঁজি করে তাঁরা ভাইয়ে ভাইয়ে এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সফল মঞ্চায়নে সমর্থ হয়।

তার চেয়েও বড় ঘটনা হলো—ভুল–বোঝাবুঝির শিকার হয়ে হজরত আয়েশা (রা.) ২০ হাজার মুসলিমের এক বাহিনী নিয়ে বসরা অভিমুখে রওনা হয়ে যান। ঘটনার বাস্তবতা অবহিত করে আয়েশাকে কেউ ফেরাবে, সে সাহস আর কার! পরিস্থিতি এমনই ঘোলাটে হয়ে যায়, আয়েশার সামনে এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলবে, সে হিম্মতই হয় না কারোর।

রাসুল (সা.) যদি জানতেন, নারী জিহাদ করবে, তাহলে সে দায়িত্ব আপনাকেই দিতেন। আপনি কি জানতেন না, তিনি আপনাকে দ্বীনের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করতে নিষেধ করেছেন?

তখন উম্মাহর সেই দুঃখজনক সময়ে উম্মে সালামা উদ্যোগী হন। প্রয়াসী হন নিজের উপলব্ধিটুকু আয়েশা (রা.)–কে অবগত করিয়ে তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে ফেরাবার। আয়েশা (রা.)-এর প্রযত্নে লিখে ফেলেন তিনি তাঁর সেই ঐতিহাসিক পত্রটি। সেই পত্রে উম্মে সালামার সাহসিকতার স্ফুরণ যেমন ছিল, তেমন ছিল আয়েশা ও পুরো উম্মাহর জন্য হৃদয়নিংড়ানো দরদ। ঐতিহাসিক সেই পত্রটির ভাষ্য ছিল—

“নবীপত্নী উম্মে সালামার পক্ষ থেকে উম্মুল মুমিনিন আয়েশার প্রতি।

আমি আল্লাহর প্রশংসা করছি, যিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নাই।

পরকথা এই যে, আপনি আল্লাহর রাসুল ও তাঁর উম্মতের মধ্যকার একটি সেতু ভেঙে দিয়েছেন। তা একটা সম্মানের পর্দা। আপনার আঁচল কোরআন সংরক্ষণ করেছে; বসরা-যাত্রার মাধ্যমে তা টেনে ছিন্ন করবেন না। আল্লাহ তাআলা আপনার গৃহ ও অঙ্গনকে সুস্থির করেছেন, তা মরুভূমিতে পরিণত করবেন না। আপনারা কোথায় কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন? আল্লাহ তাআলা আছেন এই উম্মতের সঙ্গে।

রাসুল (সা.) যদি জানতেন, নারী জিহাদ করবে, তাহলে সে দায়িত্ব আপনাকেই দিতেন। আপনি কি জানতেন না, তিনি আপনাকে দ্বীনের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করতে নিষেধ করেছেন? দ্বীনের স্তম্ভ ঝুঁকে পড়লে তা নারীদের দ্বারা সোজা হবে না। তা ফেটে গেলে নারীদের দিয়ে তার নির্মাণ হবে না।

নারীদের জিহাদ হলো—দৃষ্টি অবনত রাখা, আঁচল সংবরণ করা আর ভালোবাসা, মায়া ও মমতার প্রাসাদ নির্মাণ করা। আপনাকে যদি এই মরুভূমির কোনো এক কূপ থেকে আরেক কূপে সরে আসা কোনো জন্তুর মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে আপনি আল্লাহর রাসুলকে কী জবাব দেবেন?

আগামীতে তো রাসুল (সা.)–এর সামনে দাঁড়াবেন। আমাকে যদি বলা হতো, হে উম্মে সালামা, জান্নাতে প্রবেশ করো। কসম করে বলছি, আমি আমার ওপর বিধৃত পর্দাকে লঙ্ঘন করে আল্লাহর রাসুলের সামনে দাঁড়াতে লজ্জা পেতাম।” (ইমাম জাহাবি, আ’লামুন নিসা, ৫/২২৫)

আহমাদ সাব্বির : আলেম ও লেখক

আরও পড়ুন