খবর বা সামাজিক মাধ্যমের ফিড বারবার রিফ্রেশ করা হচ্ছে। গাজার আরেকটি ভিডিও। আরেকটি মৃত্যুর খবর। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে, হয়তো আরামদায়ক চাকরিও আছে, তথ্যের সহজলভ্যতাও আছে—তবুও বারবার মনে হচ্ছে, অর্থপূর্ণ কিছু করার ক্ষমতা আপনার নেই।
এই নিষ্পেষক মানসিক ভারটির আরবিতে একটি নাম আছে—ইজ্য।
‘ইজ্য’কে প্রায়শই ‘অপারগতা’ বা ‘অক্ষমতা’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়, কিন্তু এই অনুবাদগুলো এর গভীরতাকে ধরতে পারে না। এটি ‘কাস্ল’ বা আলস্য নয়; যখন আপনি অলস হন, তখন আপনার কিছু করার ইচ্ছা থাকে, কিন্তু মন সায় দেয় না।
কিন্তু ‘ইজ্য’ হলো যখন আপনি কাজ করতে চান, কিন্তু ব্যক্তিগত পরিস্থিতি (যেমন: অর্থ, সময় বা সম্পদের অভাব) কিংবা বাহ্যিক সীমাবদ্ধতা (যেমন: রাজনীতি, ভৌগোলিক দূরত্ব বা পদ্ধতিগত বাধা)—যে কোনো কারণেই হোক না কেন, নিজেকে পুরোপুরি শক্তিহীন বা অসহায় মনে করেন।
আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে, হয়তো আরামদায়ক চাকরিও আছে, তথ্যের সহজলভ্যতাও আছে—তবুও বারবার মনে হচ্ছে, অর্থপূর্ণ কিছু করার ক্ষমতা আপনার নেই।
অপরাগতা কখন দেখা দেয়
এটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অসংখ্য উপায়ে প্রকাশ পায়। নিম্নলিখিত পরিস্থিতিগুলোর কথা ভাবুন:
আপনি আপনার বয়স্ক পিতামাতার যত্ন নিতে চান, কিন্তু আপনি অন্য দেশে থাকেন।
আপনার কাছে মুসলিম উম্মাহর সেবায় লাগতে পারে এমন একটি দারুণ ব্যবসায়িক ধারণা আছে, কিন্তু শুরু করার মতো মূলধন নেই।
আপনি সুস্থ থাকতে দৌড়াতে চান, কিন্তু কোনো আঘাত আপনাকে তা করতে বাধা দিচ্ছে।
গাজা বা সুদান নিয়ে আপনি অসহায় বোধ করছেন, কিন্তু আপনার মনে হচ্ছে কিছুই করার নেই।
প্রশ্ন হলো, যখন আপনি ভালো কাজ করার সামর্থ্যে নিজেকে অপূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ মনে করেন, তখন কীভাবে আপনার আশা এবং উদ্দেশ্য ধরে রাখবেন? আসুন, আলাপ করা যাক।
নবীজির জীবনে ‘ইজ্য’-এর অভিজ্ঞতা
এই ধরনের অসহায়তার কথা মনে পড়লে যে বিষয়টি আমাকে সান্ত্বনা দেয়, তা হলো, আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-ও মক্কা জীবনে এমন অসহায় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন।
তেরোটি বছর ধরে তিনি দেখেছেন তাঁর সাহাবিদের ওপর নির্যাতন চলছে। তিনি দেখেছেন বিলাল (রা.)-কে জ্বলন্ত বালির ওপর টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেখেছেন, ইয়াসির ও সুমাইয়া (রা.)-কে ইমানের কারণে শহীদ হতে। দেখেছেন পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন হচ্ছে এবং বিশ্বাসীরা অপদস্থ হচ্ছে।
সেই মুহূর্তগুলোতে নবীজি (সা.) কী করতে পারতেন? তিনি ছিলেন একাকী একজন মানুষ—একটি শক্তিশালী নিপীড়ক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তিনি নির্যাতন থামাতে পারেননি, মৃত্যু ঠেকাতে পারেননি, কিংবা শক্তিশালী গোত্রীয় কাঠামো রাতারাতি উল্টে দিতে পারেননি।
আর পথভ্রষ্ট ব্যতীত কে তার রবের রহমত থেকে নিরাশ হয়?
তবুও তিনি কখনও হতাশ হননি। তিনি ধৈর্য ও দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁর মিশন চালিয়ে গেছেন, কারণ তিনি জানতেন—আল্লাহর পরিকল্পনা যথাসময়ে উন্মোচিত হবে, আমাদের আশা অনুসারে নয়।
অবস্থার পরিবর্তন রাতারাতি ঘটেনি। হিজরত করে মদিনায় যাওয়ার আগে তেরোটি বছর ধরে তাঁকে আপাত এমন অসহায়তার মধ্যে থাকতে হয়েছে। কিন্তু এই বছরগুলো নষ্ট হয়নি; এই সময়টা ছিল চরিত্র গঠন, বিশ্বস্ত অনুসারী সংগ্রহ এবং আমাদের উম্মাহর ভিত্তি স্থাপনের বছর। (সফিউর রহমান মোবারকপুরী, আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা: ৯৫-১০৫, আল মাকতাবা আস-সালাফিয়া, ভারত, ২০০২)
‘অপারগতা’র বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
যখন আমরা এমন অপারগাতর ভার অনুভব করি, ইসলাম আমাদের জন্য একটি স্পষ্ট পথনির্দেশ তৈরি করে দেয়:
১. আল্লাহর রহমত থেকে কখনো নিরাশ হবেন না
আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর পথভ্রষ্ট ব্যতীত কে তার রবের রহমত থেকে নিরাশ হয়?” (সুরা হিজর, আয়াত: ৫৬)
যে মুহূর্তে আমরা ভাবি, “এসব করে কী লাভ? আমি তো অর্থপূর্ণ কিছু করতে পারছি না”, তখনই আমরা হতাশার খুব কাছাকাছি চলে যাই। শয়তান ঠিক এটাই চায়; আমরা যেন ভালো কিছু করার ক্ষমতা না থাকার অজুহাতে সবকিছু ছেড়ে দিই।
গাজার ক্ষেত্রেও আমরা এটা দেখছি; অনেকে শুরুতে খুব আবেগপ্রবণ থাকার পর এখন অসহায়ত্বের এক ধরনের হতাশায় পৌঁছে গেছে। এই হতাশা হলো ইমানের একটি বড় পরীক্ষা।
২. ‘ইজ্য’ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা
মহানবী (সা.) নিয়মিত এই দোয়া করতেন, “হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই উদ্বেগ ও পেরেশানি থেকে, অক্ষমতা (ইজ্য) ও আলস্য থেকে, ভীরুতা ও কৃপণতা থেকে, ঋণের বোঝা ও মানুষের চাপ থেকে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৬৮)
লক্ষ্য করুন, নবীজি সুনির্দিষ্টভাবে ‘ইজ্য’ থেকে সুরক্ষা চেয়েছেন। এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে অক্ষমতার অনুভূতি একটি আধ্যাত্মিক চ্যালেঞ্জ, যা আমাদের সক্রিয়ভাবে দোয়া এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরতার মাধ্যমে প্রতিহত করা উচিত।
৩. আপনার সামর্থ্যের মধ্যে কাজ করা
নবী (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন, যদি কিয়ামত শুরু হতেও দেখো এবং তোমাদের কারো হাতে একটি খেজুর চারা থাকে, তবে সে যেন তা রোপণ করে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৪০৩৫)।
কিয়ামত শুরু হওয়ার চরম অসহায়ত্বের মুহূর্তেও আমাদের যতটুকু করার সামর্থ্য আছে, ততটুকুই করতে শেখানো হয়েছে। এটি আমাদের শেখায় যে, ফলাফল নয়, বরং প্রচেষ্টা এবং উদ্দেশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রচেষ্টা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়, যদিও আমাদের চোখে তা নগণ্য মনে হতে পারে।
অসহায়তাকে কর্মে রূপান্তরের কৌশল
আমরা কীভাবে একে কর্মে রূপান্তর করতে পারি, তা পূর্ববর্তী উদাহরণগুলোর মাধ্যমে দেখা যাক:
দূরত্বের কারণে বাবা-মায়ের যত্ন নিতে পারছেন না?
নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিত ভিডিও কল করুন।
স্থানীয় আত্মীয় বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের খোঁজখবর নিতে বলুন।
নামাজের সময় তাদের জন্য বিশেষ দোয়া করুন।
মূলধনের অভাবে ব্যবসা শুরু করতে পারছেন না?
এই সময়টিকে আপনার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা পরিমার্জন এবং কৌশল গঠনের কাজে লাগান।
অনলাইন কোর্স বা মেন্টরশিপের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করুন।
ছোট পরিসরে ধারণাটি পরীক্ষা করে দেখুন।
আঘাতের কারণে দৌড়াতে পারছেন না?
শরীরের ওপরের অংশের শক্তি প্রশিক্ষণে মনোযোগ দিন বা সাঁতার কাটুন।
দৌড়ানোর সঠিক কৌশল ও পুষ্টি নিয়ে পড়াশোনা করুন।
ফিজিওথেরাপিস্টের সঙ্গে একটি ‘ফিরে আসার’ পরিকল্পনা তৈরি করুন।
গাজা বা বিশ্বব্যাপী দুর্ভোগ নিয়ে অসহায় বোধ করছেন?
সামাজিক মাধ্যম ও আলোচনার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করুন।
আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী নিয়মিত অনুদান দিন।
বরকতময় সময়ে নির্যাতিতদের জন্য ধারাবাহিক দোয়া করুন।
আপনার সন্তানদের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে শিক্ষিত করুন।
অপারগতার সঙ্গে আপনার এই সংগ্রাম ব্যর্থতার লক্ষণ নয়; এটি এমন একটি হৃদয়ের লক্ষণ, যা গভীরভাবে ভালো কাজ করার জন্য যত্নশীল। কঠিন মাটিতেও বীজ রোপণ করতে থাকুন।
দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিকোণ
আমাদের এই অসহায়তা রাতারাতি দূর হবে না, আর এর মধ্যেই আল্লাহর প্রজ্ঞা লুকিয়ে আছে। নবীজি (সা.) তৎক্ষণাৎ মক্কাকে পরিবর্তন করতে পারেননি, কিন্তু তেরো বছরের সেই আপাত সীমাবদ্ধতা তাকে এবং তাঁর সম্প্রদায়কে ভবিষ্যতের বিজয়ের জন্য প্রস্তুত করেছিল।
আপনার বর্তমান সীমাবদ্ধতা হয়তো আপনাকে এমন ভবিষ্যতের সুযোগের জন্য প্রস্তুত করছে, যা আপনি এখনও কল্পনা করতে পারছেন না। আপনার ব্যবসায়িক ধারণার আজকের আর্থিক বাধা হয়তো আপনাকে সম্পদ ব্যবহারে দক্ষতা শেখাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আপনাকে আরও ভালো উদ্যোক্তা করে তুলবে।
মুসলিম উম্মাহ আজ গাজার ব্যাপারে যে অসহায়ত্ব অনুভব করছে, তা হয়তো দীর্ঘ ঘুম থেকে উম্মাহর জেগে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় এক বেদনাদায়ক সতর্কবার্তা।
অপারগতার সঙ্গে আপনার এই সংগ্রাম ব্যর্থতার লক্ষণ নয়; এটি এমন একটি হৃদয়ের লক্ষণ, যা গভীরভাবে ভালো কাজ করার জন্য যত্নশীল। কঠিন মাটিতেও বীজ রোপণ করতে থাকুন। দোয়া করতে থাকুন। আপনার জন্য উপলব্ধ ক্ষুদ্র পদক্ষেপগুলো নিতে থাকুন।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের জীবন এবং উম্মাহ থেকে সব ধরনের ‘ইজ্য’ দূর করে দিন। আমিন।