হিংসার ‘নজর’ যখন সফলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়
ক্যালেন্ডার, কাজের রুটিন কিংবা ডিজিটাল সিস্টেম—আধুনিক সময়ে কর্মদক্ষতা বলতে গেলে এসব বিষয় আমাদের মাথায় আসে। কিন্তু জীবনের সব সমীকরণ কি কেবল বাহ্যিক প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করে?
কখনো কি এমন হয়েছে যে সব প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ কাজের গতি থমকে গেছে কিংবা কোনো ব্যাখ্যাতীত কারণে আপনার দীর্ঘদিনের মনোবল ভেঙে পড়েছে?
কর্মক্ষমতার এই জাগতিক আলোচনার ভিড়ে আমরা অনেক সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক দিক এড়িয়ে যাই। সেটি হলো ‘কুনজর’ বা বদনজর ও ‘হিংসা’।
এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব কীভাবে এই অদৃশ্য শক্তিগুলো আমাদের পেশাদার ও ব্যক্তিগত জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এর থেকে বাঁচার উপায় কী।
হিংসা হলো একটি অন্ধকার অনুভূতি। এটি কেবল প্রশংসা নয়; বরং হিংসুক মনে মনে চায় আপনার নিয়ামতটি ছিনিয়ে নেওয়া হোক বা আপনি ক্ষতির শিকার হন।
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অদৃশ্য বাধা
অনেক বছর আগের একটি ঘটনা। আমি তখন স্থানীয় একটি মসজিদে পবিত্র কোরআন মুখস্থ করার ক্লাসে যেতাম। আল্লাহর রহমতে আমার মুখস্থ করার গতি ছিল বেশ ভালো।
একদিন ক্লাসের এক সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হলো। সে আমার অগ্রগতির কথা জানতে চাইল। আমি যখন তাকে জানালাম যে আমি কতটুকু মুখস্থ করেছি, তখন তার চেহারার অভিব্যক্তি বদলে গেল। সে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে হিংসা করি।’
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। ভাবলাম, হয়তো সে ইতিবাচক অর্থেই কথাটি বলেছে। কিন্তু সেই সাক্ষাতের পর পুরো এক সপ্তাহ আমি একটি আয়াতও মুখস্থ করতে পারিনি।
আমার শিক্ষক অবাক হলেন। যে ব্যক্তি দ্রুত মুখস্থ করার জন্য পরিচিত ছিলেন, তিনি হঠাৎ পুরোনো পড়াগুলোও মনে করতে পারছিলেন না। তখনই আমার সেই সহপাঠীর কথা মনে পড়ল। আমি বুঝতে পারলাম, হয়তো আমি বদনজরের শিকার হয়েছি। আমাকে আধ্যাত্মিক উপায়ে এর সমাধান খুঁজতে হবে।
কুনজর ও হিংসা: প্রোডাক্টিভিটির গোপন ঘাতক
আমাদের কর্মদক্ষতা যাচাইয়ের সংস্কৃতিতে আমরা কেবল বাহ্যিক বিষয়গুলোই বিশ্লেষণ করি। কিন্তু বদনজর ও হিংসা (হাসাদ) এমন বাস্তব শক্তি, যা আপনার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও কঠোর পরিশ্রমকে নিমেষেই ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। কোনো দামি কফি কিংবা নিখুঁত ক্যালেন্ডার এই সংকটের সমাধান করতে পারে না।
পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহে নজর বা হিংসাকে নিছক কুসংস্কার হিসেবে দেখা হয়নি। আল্লাহ তাআলা আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন আমরা যেন ‘হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই, যখন সে হিংসা করে।’ (সুরা ফালাক, আয়াত: ৫)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বদনজর সত্য। যদি কোনো কিছু তকদিরকে (ভাগ্যকে) অতিক্রম করতে পারত, তবে বদনজরই তা করত।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,১৮৮)
অনেক পেশাজীবী আধুনিক করপোরেট পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে এই আধ্যাত্মিক বাস্তবতাগুলোকে ‘সেকেলে’ বলে উড়িয়ে দেন, যা তাঁদের আরও বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়।
পুরো জাতি যদি তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তবে তারা ততটুকুই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর তারা যদি তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়, তবে ততটুকুই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার ভাগ্যে লিখে রেখেছেন।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৫১৬
বদনজর ও হিংসার মধ্যে পার্থক্য
বদনজর বা কুনজর সাধারণত ঘটে যখন কেউ আপনার কোনো নিয়ামত বা অর্জনের প্রতি তীব্রভাবে মুগ্ধ হয়। এটি কোনো প্রিয়জনের কাছ থেকেও আসতে পারে।
যেমন পরিবারের কোনো সদস্য বা ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আপনার পদোন্নতির কথা শুনে মুগ্ধ হলেন, কিন্তু আল্লাহর নাম নিতে ভুলে গেলেন। এতে অজান্তেই আপনি বদনজরের শিকার হতে পারেন।
এমনকি “নিজের অর্জনে নিজে বেশি মুগ্ধ হয়ে ‘মাশা আল্লাহ’ বলতে ভুলে গেলে মানুষ নিজের বদনজরের শিকারও হতে পারে। (ইবনুল কাইয়িম জাওজি, জাদ আল–মাআদ ফি হাদ্ই খাইরিল ইবাদ, ৪/১৬৪, মুআসসাসাতুর রিসালাহ, বৈরুত, ১৯৮৬)
অন্যদিকে হিংসা হলো একটি অন্ধকার অনুভূতি। এটি কেবল প্রশংসা নয়; বরং হিংসুক মনে মনে চায় আপনার নিয়ামতটি ছিনিয়ে নেওয়া হোক বা আপনি ক্ষতির শিকার হন। যখন কোনো সহকর্মী আপনার সাফল্যে কেবল মুগ্ধ নন; বরং আপনার পতন কামনা করেন, তখনই সেটি হিংসা।
পেশাদার জীবনে এর প্রভাব
বদনজর কেবল ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকে না। কর্মক্ষেত্রে এর প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে:
১. কর্মক্ষমতা হঠাৎ কমে যাওয়া: আপনি খুব ভালো কাজ করছিলেন, টার্গেট পূরণ করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। যে কাজগুলো সহজ ছিল, তা এখন পাহাড়সম মনে হচ্ছে। আপনার বস ও সহকর্মীরা আপনার এই পরিবর্তন দেখে বিস্মিত হচ্ছেন।
২. উদ্দেশ্যহীন ক্লান্তি: সফলভাবে কোনো প্রজেক্ট শেষ করার পর বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের সাফল্যের কথা শেয়ার করার পর যদি দেখেন আপনার পরবর্তী কাজে আর কোনো স্পৃহা নেই, তবে এটি কুনজরের সংকেত হতে পারে। আপনি মনের ভেতর একধরনের ভারী ভাব অনুভব করবেন।
৩. দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা: একটি চমৎকার টিম, যারা দীর্ঘ সময় ধরে সফলভাবে কাজ করছে, তারা হঠাৎ তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হতে শুরু করে। সহযোগিতার মনোভাব যেন রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায়।
৪. মানসিক বাধা: কোনো রিপোর্ট লেখা বা অ্যাপ তৈরির কাজ দারুণ গতিতে চলছিল। কিন্তু হঠাৎ আইডিয়া আসা বন্ধ হয়ে গেল এবং আপনি নিজের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করলেন।
৫. প্রযুক্তিগত বিভ্রাট: এটি অনেকের কাছে কাকতালীয় মনে হতে পারে, কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় গুরুত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশনের ঠিক আগমুহূর্তে নিখুঁত টেকনিক্যাল সেটআপটি কাজ করছে না। সব যান্ত্রিক বিভ্রাটই র্যানডম বা এলোমেলো নয়।
নিজেকে রক্ষার চারটি উপায়
রাসুল (সা.) আমাদের কুনজর ও হিংসা থেকে রক্ষার জন্য কার্যকর নির্দেশনা দিয়ে গেছেন:
১. ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা: আপনার সব সাফল্য বা নিয়ামতের কথা জনসমক্ষে প্রচার করবেন না। সাফল্যগুলো বেছে বেছে নির্ভরযোগ্য মানুষের সঙ্গে শেয়ার করুন। পদোন্নতি বা নতুন ব্যবসায়িক পরিকল্পনার কথা সবাইকে জানানোর প্রয়োজন নেই।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রয়োজনগুলো গোপনীয়তার মাধ্যমে সফল করতে সাহায্য নাও। কারণ, প্রতিটি নিয়ামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিই হিংসার শিকার হয়।’ (তাবারানি, আল–মুজামুল কাবির, ২০/৯৪, মাকতাবাতু ইবনু তাইমিয়্যাহ, কায়রো, ১৯৮৩)
২. আল্লাহর প্রশংসা করা: নিজের বা অন্যের কোনো কিছু ভালো লাগলে অবশ্যই ‘মাশা আল্লাহ লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ (আল্লাহ যা চেয়েছেন! আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো শক্তি নেই) বলবেন।
কোনো সহকর্মীর প্রশংসা করার সময় ‘বারাকাল্লাহু লাকা/লাকি’ (আল্লাহ তোমার ওপর বরকত দান করুন) বলার অভ্যাস করুন। এটি কেবল সৌজন্য নয়; বরং এটি অন্যের ক্ষতি এড়ানোর একটি আধ্যাত্মিক শিষ্টাচার।
যদি আপনি হঠাৎ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন বা রহস্যজনক বাধার সম্মুখীন হন, তবে নিজের ওপর ‘রুক্ইয়াহ’ করুন। সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস পাঠ করে পানিতে ফুঁ দিয়ে তা পান করা বা গায়ে মাখা যেতে পারে।
৩. দৈনন্দিন জিকির: সকাল ও সন্ধ্যার জিকিরগুলো বদনজর থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে বড় ঢাল। হিসনুল মুসলিম বা এমন দোয়া সংকলন থেকে ফজর ও আসরের পর অন্তত ১০–১৫ মিনিট সময় নিয়ে এই জিকিরগুলো করা উচিত। (ইমাম নববি, আল–আজকার, পৃষ্ঠা ৮০, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৪)
৪. গুরুত্বপূর্ণ সময়ের প্রস্তুতি: বড় কোনো প্রেজেন্টেশন বা ইন্টারভিউর আগে নিজের ওপর ‘রুকইয়াহ’ (পবিত্র কোরআনের আয়াত পড়ে ফুঁ দেওয়া) করুন। অজু অবস্থায় কাজে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করুন এবং সেই দিনটিতে বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করুন।
আক্রান্ত হলে সমাধান কী?
যদি আপনি হঠাৎ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন বা রহস্যজনক বাধার সম্মুখীন হন, তবে নিজের ওপর ‘রুক্ইয়াহ’ করুন। সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস পাঠ করে পানিতে ফুঁ দিয়ে তা পান করা বা গায়ে মাখা যেতে পারে।
কুনজর ও হিংসা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার অর্থ এই নয় যে আমরা সারাক্ষণ আতঙ্কিত থাকব। আমাদের সব ব্যর্থতাকে কুনজরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। অনেক সময় অতিরিক্ত কাজের চাপ, মানসিক চাপ বা বিরতির অভাবেও প্রোডাক্টিভিটি কমতে পারে। আমাদের কাজ হবে আধ্যাত্মিক ঢালগুলো বজায় রাখা এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করা।
রাসুল (সা.) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)–কে একটি চমৎকার উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘হে যুবক, আমি তোমাকে কিছু কথা শেখাব; তুমি আল্লাহর বিধানের প্রতি যত্নশীল হও, আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করবেন। জেনে রেখো, পুরো জাতি যদি তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তবে তারা ততটুকুই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর তারা যদি তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়, তবে ততটুকুই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার ভাগ্যে লিখে রেখেছেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৫১৬)
বদনজর ও হিংসা সত্য হলেও আল্লাহর সুরক্ষা তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ইহসানের সঙ্গে কাজ করুন, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সাফল্যের কথা শেয়ার করুন এবং নিজের আধ্যাত্মিক প্রতিরক্ষা বজায় রাখুন। ইনশা আল্লাহ, কোনো হিংসুক হৃদয় আপনার বরকত বা কল্যাণ কেড়ে নিতে পারবে না।
সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম অবলম্বনে