স্বাধীনতার ইসলামি দর্শন

ছবি: পেক্সেলস

স্বাধীনতা মানব ইতিহাসের অন্যতম কাঙ্ক্ষিত প্রত্যয়। এটি কেবল ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক বন্ধনমুক্তির নাম নয়, বরং মানুষের আত্মিক বিকাশ ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। ইসলাম এই স্বাধীনতাকে এক গভীর দর্শন এবং জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

ইসলামি ভাবধারায়, প্রকৃত স্বাধীনতা হলো আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ করে দুনিয়ার সকল দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়া—যা মানুষকে ইহকাল ও পরকালে কল্যাণের পথে চালিত করে।

স্বাধীনতার ভিত্তি `তওহিদ'

ইসলামে স্বাধীনতার ধারণাটি সরাসরি তওহিদ বা একত্ববাদের মূলনীতির সঙ্গে যুক্ত। তওহিদ ঘোষণা করে যে, একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ উপাসনা বা আনুগত্য পাওয়ার যোগ্য নয়। এই ঘোষণার মাধ্যমেই মানুষ সৃষ্টিকুলের দাসত্ব, ভোগ-বিলাসের মোহ এবং প্রবৃত্তির তাড়না থেকে মুক্তি লাভ করে।

ইসলামের স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের মন-মগজ ও কর্মকে কেবল এক আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)

প্রকৃতপক্ষে, ইসলামের স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের মন-মগজ ও কর্মকে কেবল এক আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা। (ইবনে তাইমিয়া, মাজমুউল ফাতাওয়া, ২০/২৪, মাকতাবাতুল উবাইকান, রিয়াদ, ১৯৯৫)

আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ করাই মানুষকে অন্য সব কিছুর দাসত্ব থেকে চূড়ান্ত মুক্তি দেয়। কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, “সুতরাং যে তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ইমান আনে, সে যেন মজবুত হাতল ধরল, যা কখনো ভাঙার নয়।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৫৬)

এখানে ‘তাগুত’ হলো আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সব শক্তি, যা মানুষের স্বাধীনতার পথে বাধা। এদের অস্বীকার করাই প্রকৃত স্বাধীনতার প্রথম ধাপ।

আরও পড়ুন

আত্মিক স্বাধীনতা: প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি

ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতা হলো আত্মিক স্বাধীনতা, যা মানুষের ভেতরের অশুভ শক্তি, তথা নফস বা প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি। প্রবৃত্তির কাছে পরাজিত মানুষ বাইরে স্বাধীন হলেও আত্মিকভাবে সে পরাধীন। ভোগবাদ, লোভ, হিংসা এবং সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা মানুষকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে দেয়।

মহানবী (সা.) বলেছেন, “প্রকৃত বাহাদুর সেই ব্যক্তি, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬১১৪)

এই হাদিস স্পষ্ট করে যে, নিজের ভেতরের রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করাই হলো মানসিক স্বাধীনতার সর্বোচ্চ প্রকাশ। ইসলামি জীবন-বিধান—যেমন নামাজ, রোজা, জাকাত—মানুষকে শৃঙ্খলা ও আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়, যার মাধ্যমে সে প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে সত্যিকারের স্বাধীন সত্তায় রূপান্তরিত হতে পারে।

ইসলামি জীবন-বিধান মানুষকে শৃঙ্খলা ও আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়, যার মাধ্যমে সে প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে সত্যিকারের স্বাধীন সত্তায় রূপান্তরিত হতে পারে।

ন্যায়বিচার ও অধিকারের স্বাধীনতা

ইসলাম আত্মিক স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষের মৌলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজে ন্যায়বিচার (আদল) প্রতিষ্ঠা করা।

রাজনৈতিকভাবে, ইসলামি আইন (শরিয়াহ) মানুষের মৌলিক অধিকার—জীবন, সম্পদ, সম্মান ও ধর্মের নিরাপত্তা—নিশ্চিত করে। এই অধিকারগুলো রাষ্ট্র বা কোনো ব্যক্তি কেড়ে নিতে পারে না।

খলিফা ওমর (রা.)-এর একটি বিখ্যাত উক্তি ইসলামি রাষ্ট্রে স্বাধীনতার ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে, “তোমরা কবে থেকে মানুষকে দাস বানিয়েছ, অথচ তাদের মায়েরা তাদের স্বাধীন করে জন্ম দিয়েছে?” (মুহাম্মাদ হুসাইন হাইকল, আল-ফারুক উমর, ১/২২১, দারুল মাআরিফ, কায়রো, ১৯৪৪)

এই উক্তি প্রমাণ করে, মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন এবং এই স্বাধীনতাকে রাষ্ট্র বা শাসকগোষ্ঠী হরণ করতে পারে না। শাসকের সমালোচনা ও তার কাছে জবাবদিহি চাওয়ার অধিকার ইসলামের একটি মৌলিক রাজনৈতিক স্বাধীনতা।

অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও মুক্তি

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে ইসলামে সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখা থেকে মুক্তি এবং সকলের জন্য জীবনধারণের ন্যায্য সুযোগ নিশ্চিত করাকে বোঝায়। সুদ, মজুদদারি, শোষণ ও প্রতারণামূলক ব্যবসা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৫)

জাকাত ব্যবস্থা অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করার একটি কার্যকর পদ্ধতি। এটি ধনীদের সম্পদে গরিবদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, যাতে তারা দারিদ্র্যের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে আত্মমর্যাদার সাথে জীবনযাপন করতে পারে।

আরও পড়ুন

বাকস্বাধীনতা ও জ্ঞানচর্চার স্বাধীনতা

ইসলাম জ্ঞানচর্চা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়, তবে তা অবশ্যই সমাজের নৈতিক ভিত্তি এবং আল্লাহর বিধানের সীমারেখার মধ্যে হতে হবে।

মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা কেবল তার মৌলিক অধিকার নয়, বরং এটি সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। নবীজি (সা.) বলেছেন, “উত্তম জিহাদ হলো অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য বলা।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৩৪৫)

এই হাদিসটি সমাজের অন্যায় ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে আওয়াজ তোলার স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেয়। তবে এই স্বাধীনতা যেন অন্যের অধিকার খর্ব না করে, গুজব না ছড়ায় বা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে, ইসলাম সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেছে।

জ্ঞানার্জন করা প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪)

এই নির্দেশনার মাধ্যমে ইসলাম মানুষকে জ্ঞান, বিবেক এবং যুক্তির মাধ্যমে সত্যকে জানার স্বাধীনতা দিয়েছে। অন্ধ অনুকরণ বা গোঁড়ামিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কোরআনে বারংবার চিন্তা-গবেষণা (তাফাক্কুর), উপলব্ধি (তাআক্কুল) এবং পর্যবেক্ষণ (তাদাব্বুর) করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার প্রমাণ। (সুরা রুম, আয়াত: ৮)

যে সমাজ তওহিদের ভিত্তিতে এই আত্মিক মুক্তি অর্জন করতে পারে এবং সেই মুক্তিকে ন্যায় ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করতে পারে, সেই সমাজই সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ।

শর্তাধীন স্বাধীনতা: দায়িত্বের সঙ্গে সংহতি

পাশ্চাত্যের ব্যক্তি-কেন্দ্রিক স্বাধীনতার ধারণার সঙ্গে ইসলামের স্বাধীনতার একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামে স্বাধীনতা মানে শর্তহীন স্বেচ্ছাচারিতা নয়; এটি দায়িত্ব ও জবাবদিহির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একজন মুসলমানের স্বাধীনতা তখনই পূর্ণতা লাভ করে, যখন সে তার স্বাধীনতাকে অন্যের অধিকার ও সমাজের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করে।

ইসলামে, মানুষের স্বাধীনতা সীমাহীন নয়—এটি আল্লাহর দেওয়া বিধানের সীমারেখা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কারণ, সীমালঙ্ঘনকারী স্বাধীনতা সমাজে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

উদাহরণস্বরূপ, একজন মানুষ স্বাধীনভাবে মদ পান বা জুয়া খেলতে পারে না, কারণ এই কাজগুলো ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর এবং সামগ্রিক কল্যাণের পরিপন্থী। স্বাধীনতা এখানে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত, যেখানে ব্যক্তি তার স্বাধীনতা উপভোগ করতে গিয়ে যেন অন্যের বা সমাজের ক্ষতির কারণ না হয়।

শেষ কথা

স্বাধীনতা হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি এক আমানত এবং নেয়ামত। ইসলাম এই স্বাধীনতাকে কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং আত্মিক, নৈতিক ও আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করেছে। প্রকৃত স্বাধীনতা হলো একমাত্র আল্লাহর কাছে নতি স্বীকার করে বিশ্বের সব প্রকার দাসত্ব ও জুলুম থেকে মুক্ত হওয়া।

যে সমাজ তওহিদের ভিত্তিতে এই আত্মিক মুক্তি অর্জন করতে পারে এবং সেই মুক্তিকে ন্যায় ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করতে পারে, সেই সমাজই সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ।

আজকের বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে, মানুষের উচিত কেবল রাজনৈতিক শৃঙ্খলমুক্তির জন্য লড়াই না করে, বরং প্রবৃত্তির দাসত্ব এবং সৃষ্টিকুলের আধিপত্য থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ইসলামের প্রকৃত স্বাধীনতার পথে এগিয়ে আসা।

আরও পড়ুন