যুদ্ধেও মানবিকতা মহানবী (সা.)–এর অনন্য শিক্ষা
মহানবী (সা.) ১৪০০ বছর আগে যুদ্ধের এমন নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ইসলামের মানবিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এই নিয়মগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিরক্ষামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসামরিক নাগরিক, সম্পত্তি ও পরিবেশের সুরক্ষার ওপর জোর দিয়েছে। চলুন, আমরা বিষয়টিতে একবার নজর বুলিয়ে আসি।
কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি
পবিত্র কোরআনে যুদ্ধের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সুরা হজ্জের ৪০-৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে তাদের যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কারণ তাদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে... যারা কেবল এই কথা বলার জন্য তাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে যে, ‘আমাদের প্রভু আল্লাহ’ — এবং যদি আল্লাহ কিছু মানুষের দ্বারা অন্যদের প্রতিহত না করতেন, তবে মঠ, গির্জা, সিনাগগ এবং মসজিদ ধ্বংস হয়ে যেত...”
মহানবী (সা.) যুদ্ধের এমন নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ইসলামের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটিয়েছে এবং বেসামরিক নাগরিক, সম্পত্তি ও পরিবেশের সুরক্ষার ওপর জোর দিয়েছে।
এই আয়াতে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের অনুমতির কথা বলা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য ইসলাম পালনের স্বাধীনতা রক্ষা করা। এটি সর্বজনীন ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিও ইসলামের প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে। ফলে এখানে মন্দির, গির্জা, সিনাগগ এবং মসজিদের সুরক্ষার বিষয়টিও স্পষ্ট করা হয়েছে।
মহানবী (সা.)-এর যুদ্ধের নিয়ম
মহানবী (সা.) যুদ্ধক্ষেত্রে আচরণের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম প্রদান করেছিলেন, যা মানবিকতা ও নৈতিকতার একটি উচ্চ মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছিল। তিনি যুদ্ধে বলা যায় কয়েকটি বাতলে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে ৬টি এমন:
১. বিশ্বাসঘাতকতা নিষিদ্ধ: যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা বা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া নিষিদ্ধ।
২. মৃতদেহের অবমাননা নিষিদ্ধ: শত্রুর মৃতদেহের অঙ্গচ্ছেদ বা অবমাননা করা যাবে না।
৩. শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের হত্যা নিষিদ্ধ: এদের উপর কোনো আক্রমণ করা যাবে না।
৪. গাছের ক্ষতি নিষিদ্ধ: ফলদায়ক গাছ পোড়ানো বা ধ্বংস করা নিষিদ্ধ।
৫. পশুদের হত্যা নিষিদ্ধ: খাদ্যের প্রয়োজন ছাড়া শত্রুপক্ষের পশুদের হত্যা করা যাবে না।
৬. সন্ন্যাসীদের উপর আক্রমণ নিষিদ্ধ: যারা ধর্মীয় জীবনের জন্য নিবেদিত, তাদের অব্যাহতি দেওয়া হবে।
(ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নববিয়্যাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ২০০৪, খণ্ড ২, পৃ. ২৩৪-২৩৬)
যদি আল্লাহ কিছু মানুষের দ্বারা অন্যদের প্রতিহত না করতেন, তবে মঠ, গির্জা, সিনাগগ এবং মসজিদ ধ্বংস হয়ে যেত।
অন্যান্য নিয়মগুলো, যেমন শত্রুর সঙ্গে চুক্তি রক্ষা করা, বন্দীদের প্রতি সদয় আচরণ করা, বেসামরিক লোকজনের সম্পত্তি রক্ষা করা এবং অত্যধিক শক্তি প্রয়োগ না করার মতো বিষয়গুলো বিভিন্ন হাদিসে ছড়িয়ে আছে (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৩১; সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২৬১৩)।
এই নিয়মগুলোর মধ্য দিয়ে যুদ্ধে মানবিক আচরণের একটি সম্পূর্ণ কাঠামো পাওয়া যায়।
উসামা বিন জায়েদের ঘটনা
নবীজি (সা.)-এর যুদ্ধের নিয়মের বাস্তব প্রয়োগ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনায় দেখা যায়। উসামা বিন জায়েদ একজন শত্রু সৈনিকের সঙ্গে মল্ল যুদ্ধে জয়ী হন। সৈনিকটি ক্ষমা প্রার্থনা করে ‘কালেমা’ পড়লেও উসামা তার কথা উপেক্ষা করে তাকে হত্যা করেন। কারণ, তার ধারণা ছিল, সৈনিকটি সত্যিকার অর্থে মুসলিম হতে নয়, বরং মৃত্যুর ভয়ে কালেমা পড়েছে।
এই ঘটনা জানার পর মহানবী (সা.) উসামার এই কাজকে ইসলামে যুদ্ধের নিয়মের বিরুদ্ধে বলে তিরস্কার করেছেন। কেননা, ক্ষমা প্রার্থনা করে কালেমা পড়ার পর সৈনিকের প্রাণ রক্ষা করা উচিত ছিল, কারণ তার বুক চিড়ে তো দেখা সম্ভব নয় যে, সে মিথ্যা বলেছে কি না। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪২৯৭)
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মানবিক আচরণ
নবীজি (সা.)-এর পরে তাঁর অনুসারীরা এই নিয়মগুলো কঠোরভাবে পালন করেছিলেন। খলিফা উমর (রা.) এবং পরবর্তীকালে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি জেরুসালেমে সে–সকল ইহুদির যথাযোগ্য অধিকার দিয়ে ফিরিয়ে দেন, যারা খ্রিষ্টান শাসনের অধীনে ছিল নিপীড়িত। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ২০১২, খণ্ড ৭, পৃ. ৫৬-৫৮)
ক্ষমা প্রার্থনা করে কালেমা পড়ার পর সৈনিকের প্রাণ রক্ষা করা উচিত ছিল, কারণ তার বুক চিড়ে তো দেখা সম্ভব নয় যে, সে মিথ্যা বলেছে কি না।
যুদ্ধবন্দীদের প্রতি মুসলিমদের আচরণও উল্লেখযোগ্য ছিল। ইসলামের ‘সমালোচক’ স্যার উইলিয়াম ম্যুর স্বীকার করেছেন যে, বন্দীদের ভালোভাবে খাওয়ানো হতো এবং তাদের মুক্তিপণ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নির্ধারিত হতো। দরিদ্র বন্দীদের জন্য মুক্তিপণ হিসেবে দশজন ছেলেকে লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। (ম্যুর, ডব্লিউ., দ্য লাইফ অব মুহাম্মদ, লন্ডন, ১৮৬১, পৃ. ৩৪৫)
মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর যুদ্ধের নিয়ম ইসলামের মানবিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর বর্ণিত নিয়ম শুধু বেসামরিক নাগরিক, সম্পত্তি এবং পরিবেশের সুরক্ষা নয়, বরং শান্তির জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার নির্দেশ দিয়েছে। এই নিয়মগুলো ইসলামের শান্তি ও ন্যায়ের প্রতি প্রতিশ্রুতির প্রতীক হিসেবে আজও প্রাসঙ্গিক।