বুখারি শরিফের অপার মহিমা

সমরকন্দে ইমাম বুখারির সমাধি, উজবেকিস্তানছবি: উইকিপিডিয়া

মুসলমানদের জীবনে বুখারি শরিফের প্রভাব গভীর। নবম শতাব্দীতে সংকলিত এই গ্রন্থের পরিচিতি কেবল আজকে নয়, প্রতি যুগেই এর সুনাম ও সুখ্যাতি মানুষের মাঝে প্রচলিত ছিল।

৮০৮ খৃষ্টাব্দে (১৯৪ হিজরি) জন্মগ্রহণ করা প্রখ্যাত হাদিসবিদ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল (রহ.)–এর জন্ম ট্রান্সঅক্সিয়ানার প্রসিদ্ধ শহর বুখারায়। সেই সূত্রে তার নামের শেষে যুক্ত করা হয় বুখারি। আর তার সংকলিত হাদিসের কিতাবের বিশ্বব্যাপী পরিচিতি সহিহ বুখারি নামে।

হাদিসের পরিভাষায় বর্ণনাকারীদের মর্যাদার ভিত্তিতে সবচেয়ে উঁচু স্তরের যে হাদিস তাকে আখ্যায়িত করা হয় ‘সহিহ’ বলে। যদিও গ্রন্থটির পূর্ণ নাম আল জামিউল মুসনাদুস সমীহ আল মুখতাসারু মিন উমুরি রাসুলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়্যামিহি। প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি সর্বপ্রথম এই নামটি উল্লেখ করেন।

গ্রন্থটির পূর্ণ নাম আল জামিউল মুসনাদুস সমীহ আল মুখতাসারু মিন উমুরি রাসুলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়্যামিহি। প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি সর্বপ্রথম এই নামটি উল্লেখ করেন।

ইমাম বুখারি মাত্র ষোল বছর বয়সে নিজ শহর বুখারা ছেড়ে ইলমের অন্বেষণে বের হন। মক্কা থেকে সেই ভ্রমণের শুরু হলেও একে একে তিনি হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর আব্বাসি খেলাফতের পৃথিবীতে প্রসিদ্ধ সকল জ্ঞান-কেন্দ্র ভ্রমণ করেন। হেজাজেই কাটান টানা ছয় বছর, বসরায় গমন করেন চারবার, মিসরে ও সিরিয়ায় দুবার করে, আর কুফা ও বাগদাদে কত বার ভ্রমণ করেছেন তার কোন লেখাজোখা নেই৷

এই ভ্রমণের মাঝেই ষোল বছর ধরে মক্কা, মদিনা ও বুখারায় সংকলন করেন সহিহ বুখারি। তার নিজের বক্তব্য হচ্ছে এক লক্ষ হাদিস থেকে বাছাই করে এতে সংকলন করেছেন মাত্র সাত হাজার হাদিস।

আরও পড়ুন

হাফেজ ইবনুস সালাহের মতে সহিহ বুখারির হাদিস-সংখ্যা ৭২৭৫টি। কোনো কোনো হাদিস তিনি একাধিক অধ্যায়ে এনেছেন, যদি সেই পুনরুল্লেখকে হিসেবে না আনা হয় তাহলে সে সংখ্যা নেমে আসে চার হাজারে। আর হাফেজ ইবনে হাজারের গবেষণা বলছে, সহিহ বুখারির হাদিস-সংখ্যা সর্বমোট নয়শত বিরাশিটি। অবশ্য ইবনে হাজারের এই হিসেবে বুখারির মুআল্লাক ও মুতাবাআত (হাদিসের দুটি পরিভাষা) হাদিসসমূহও অন্তর্ভুক্ত।

এছাড়া সহিহ বুখারিতে এমন ষোলটি হাদিস আছে যেগুলোর সনদে ইমাম বুখারি থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর দূরত্ব মাত্র তিনজন বর্ণনাকারীর। প্রায় আড়াইশত বছরের কাল পরিক্রমায় মাত্র তিনটি স্তরে রাসুল (সা.) থেকে হাদিস বর্ণনা করা একদিকে যেমন একজন মুহাদ্দিসের সৌভাগ্যের প্রতীক তেমনি হাদিসের পেছন প্রবল অনুসন্ধিৎসা ও পরিশ্রমের পরিচায়কও বটে।

ইমাম বুখারি তার এই বিরাট সংকলনে বিরল কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। যতগুলো হাদিস এনেছেন তার সকল বর্ণনাকারীর অবস্থা যাচাই করে হাদিসের মানে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই তাদের বর্ণিত হাদিসকে এই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

একটি হাদিস লেখার আগে পাক পবিত্র হয়ে নামাজ পড়ে ইস্তেখারা করতেন। এমনকি রোজা রাখতেন বলেও বর্ণনা আছে। বিশেষ বিশেষ স্থান যেমন কাবা ঘরের সামনে, রাসুল (সা.) এর রওজার পাশে রিয়াজুল জান্নাহতে বসে কিছু কিছু অংশ লিখেছেন।

এই যাচাই বাছাইয়ে দুটি বিষয় লক্ষ্য করতেন, বর্ণনাকারী সঠিক মানে উন্নীত কিনা আর নিশ্চিতভাবে সেই বর্ণনাকারী নিজ কানে শুনেছে কি না। এছাড়া এমন বর্ণনাকারীর হাদিসই তিনি গ্রহণ করতেন যারা তাদের বর্ণিত হাদিসের ওপর আমল করেন। এ জন্য কোন ভ্রান্ত বিশ্বাসীর বর্ণনা তিনি আনেননি।

এছাড়া একটি হাদিস লেখার আগে পাক পবিত্র হয়ে নামাজ পড়ে ইস্তেখারা করতেন। এমনকি রোজা রাখতেন বলেও বর্ণনা আছে। বিশেষ বিশেষ স্থান যেমন কাবা ঘরের সামনে, রাসুল (সা.) এর রওজার পাশে রিয়াজুল জান্নাহতে বসে কিছু কিছু অংশ লিখেছেন।

এভাবে তার এই সংকলনটি বাস্তবিক ও আধ্যাত্মিক মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে।

আরও পড়ুন
সহিহ বুখারির একটি কভার
ছবি: উইকিপিডিয়া

এই সতর্কতা ও নিয়মনিষ্ঠর ফলে এটি প্রথম সহিহ হাদিসের সংকলন হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। কোরআনের পর সবচেয়ে বিশুদ্ধ কিতাব, এমন একটি প্রবাদপ্রতিম অভিধা এর মিলেছে।

যেকোনো কিতাবের গ্রহণযোগ্যতার আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে ব্যাখ্যাগ্রন্থ তৈরি হওয়া। বুখারির অসংখ্য গ্রহণযোগ্য ও বৃহৎ কলেবরের ব্যাখ্যা গ্রন্থ যুগের পর যুগ ধরে লিখিত হচ্ছে। তার মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি হচ্ছে:

১. ই’লামুস সুনান, আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আল খাত্তাবী (মৃত্যু ৩২৮ হিজরি)। এটি সর্বপ্রথম লিখিত ব্যাখ্যাগ্রন্থ।

২. শারহুল বুখারি, আবুল হাসান আলী ইবনে খালফুল গারবী (মৃত্যু ৪৪৯ হিজরি)।

৩. শারহুল বুখারি, ফখরুল ইসলাম আলী মুহাম্মদ আয যাদুবি (মৃত্যু ৪৮২ হিজরি)।

৪. শারহুল বুখারি, আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনুল আরাবী (মৃত্যু ৪৪৯ হিজরি)।

৫. ফাতহুল বারী, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (মৃত্যু ৮২৮ হিজরি)।

৬. উমদাতুল কারী, হাফেজ বদরুদ্দীন আইনি (মৃত্যু ৮৫৫ হিজরি)।

হিজরি তৃতীয় শতকের আগের যেসব হাদিসের সংকলন পাওয়া যায় সেগুলোতে সহিহ, জয়িফ, মাওজু সব পর্যায়ের হাদিস পাওয়া যেত।

ইমাম বুখারির উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত সহিহ হাদিস সমূহকে আলাদা করে একত্র করা। তাঁর শিক্ষকগণও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। একই সঙ্গে উদ্দেশ্য ছিল, হাদিস থেকে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান নির্ণয় করা। এর ফলে তিনি বহু শিরোনাম দিয়ে তার এই সংকলনে হাদিস এনেছেন। একেকটি শিরোনাম ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ ও সমস্যার দিকে আলোকপাত করে, আর তার সমাধান হিসেবে ইমাম বুখারি উপযুক্ত হাদিস উল্লেখ করেন।

আরও পড়ুন
ইমাম বুখারি তার গ্রন্থটি নব্বই হাজারের বেশি ছাত্রকে পড়িয়েছেন বলে এর নুসখা সংখ্যাও বহু।

প্রাচীনকালে ছাপাখানা না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ কোন বই কারো প্রয়োজন হলে মূল শিক্ষক কিংবা সেই কিতাবের উস্তাদের সান্নিধ্যে গিয়ে লিখে আনতেন। কখনো একবার লিখিয়ে নিয়ে কয়েকবছর পর আবার পরিমার্জনের জন্য অবস্থান করতেন। এটিকে বলা হয় নুসখা তৈরি করা। এই নুসখা ছাত্রের ছাত্রত্বের প্রমাণও বটে।

ইমাম বুখারি তার গ্রন্থটি নব্বই হাজারের বেশি ছাত্রকে পড়িয়েছেন বলে এর নুসখা সংখ্যাও বহু। তবু এর মধ্যে চারজনের নুসখা সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। ১. নাসাফি ২. বাযদবি ৩.হাম্মাদ ইবনে শাকের ৪. আল ফেরাবরি।

এঁদের মধ্যে ফেরাবরির (২৩১-৩১০ হিজরি) নুসখা সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয়৷ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত নুসখাগুলো ফেরাবরির। যা তিনি ইমাম বুখারির কাছ থেকে দুবার শুনিয়ে লিখে নিয়েছেন।

প্রাচ্যবিদ মানজানা বলেন, আল জামের হাতে লেখা সবচেয়ে পুরাতন নুসখা যেটি পাওয়া গেছে, তা ৩৭০ হিজরি মোতাবেক ৯৮৪ খৃষ্টাব্দে লিখিত। সেই নুসখাটি আল মিরওয়াজির সূত্রে ফেরাবরি বর্ণিত। আর সবচেয়ে পুরাতন ছাপা কপিটি ইসামের করা। তুরস্কে ৫৫০ হিজরি মোতাবেক ১১৫০ খৃষ্টাব্দে এটি ছাপা হয়েছিল৷

এমন বিখ্যাত যে হাদিস বিশারদ তিনিও যুগের শাসকবর্গের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে পারেননি। সমসাময়িক পণ্ডিতদের সঙ্গে জ্ঞানগত মতবিরোধ তো আছেই, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বুখারার শাসক খালেদ ইবনে আহমদ যুহলির দুর্ব্যবহার। ইমাম বুখারি ছিলেন ইলমের মর্যাদা সম্পর্কে সদা সজাগ সতর্ক মানুষ।

ক্ষমতার সামনে ইলমের মর্যাদা বিলিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় শেষ জীবনে বুখারায় ফিরে যে হাদিসের দরস (পঠনপাঠন) তিনি শুরু করেছিলেন তা বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ এমনকি ইমাম বুখারি জন্মস্থান বুখারা ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী শহর সমরকন্দের দিকে রওয়ানা হন৷ অবশ্য সে শহরে পৌঁছার আগেই খরতঙ্গ নামক স্থানে তিনি অবস্থান করেন।

২৫৬ হিজরির পয়লা শাওয়াল সেখানেই এই মহান মনীষীর ইন্তেকাল হয়।

আরও পড়ুন