আয়েশা আল-হুররা: স্পেনের দুঃসাহসী নৌযোদ্ধা
তাঁর আসল নাম লাল্লা আয়েশা বিনতে আলী ইবনে রশিদ আল-আলমি। তাঁর বাবার নাম আলী ইবনে রশিদ এবং মায়ের নাম লাল্লা জোহরা ফার্নান্দেজ। ১৪৮৫ থেকে ১৪৯০ সালের মাঝামাঝি গ্রানাডায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৪৯২ সালে স্পেনের রাজ্য আরাগনের রাজা ফার্দিনান্দ ও কাস্তেইয়ের রানি ইসাবেলার হাতে গ্রানাডার পতন ঘটে। ফলে তাঁর পরিবার স্পেন থেকে মরক্কো চলে আসে। স্পেন ত্যাগ করার সময় আয়েশা ছিলেন নিতান্ত শিশু।
আয়েশার বাবা আলী ইবনে রশিদ ছিলেন গ্রানাডার প্রভাবশালী রশিদ বংশের প্রধান পুরুষ। গোত্রপতিই বলা চলে। এ কারণে স্পেনে মুসলিম বিতাড়ন শুরু হলে তিনি পরিবার ও বংশীয় লোকজন নিয়ে গ্রানাডা থেকে মরক্কোর তানজিয়ারে চলে আসেন। তানজিয়ারের উপকূলবর্তী এলাকা শেফশাউনে নতুন করে গড়ে তোলেন গোত্রীয় আবাস।
স্বামীর মৃত্যু আয়েশার জন্য সম্ভাবনার নতুন এক দুয়ার খুলে দেয়। যোগ্য কোনো উত্তরাধিকার না থাকায় তিনি নিজেকে তিতওয়ানের প্রশাসক ঘোষণা করেন।
স্পেন থেকে আরও যেসব মুসলিম পালিয়ে আসতেন, তাঁদেরও জায়গা হতো আলী ইবনে রশিদের আশ্রয়কেন্দ্রে। এভাবে কিছুদিনের মধ্যে শেফশাউন পরিণত হয় নতুন এক শহরে।
নতুন আবাস
নতুন আবাসে বাবা আলী ইবনে রশিদ সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষার কথা ভুলে যাননি। ছেলে ইবরাহিম ও মেয়ে আয়েশার দায়িত্ব দেন তৎকালীন প্রসিদ্ধ আলেম মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-ঘাজওয়ানিকে। এ ছাড়া শায়েখ উদজাল নামের আরেকজন ধর্মীয় ব্যক্তি ছিলেন তাঁদের ধর্মীয় দীক্ষাগুরু।
বিয়ে
আয়েশার বয়স যখন ১৬ তখন তাঁর বিয়ের পয়গাম এল পার্শ্ববর্তী তিতওয়ানের প্রশাসক আবুল হাসান আল-মান্দারির পক্ষ থেকে। আল-মান্দারি ও আয়েশার বয়সের ব্যবধান প্রায় ৩০ বছর। আয়েশা ইচ্ছা করলে এই প্রস্তাব নাকচ করে দিতে পারতেন, তাঁর বাবা তাঁকে সে সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আয়েশা আল-মান্দারিকেই বিয়ে করলেন।
আল-মান্দারি লোক হিসেবে ছিলেন চমৎকার। আয়েশাকে যোগ্য সম্মান দিতে তিনি কসুর করেননি। বিয়ের কিছুদিন পরই তিনি তাঁকে তিতওয়ানের রানি ঘোষণা করেন। উত্তর মরক্কো শাসন করতেন আহমদ আল-ওয়াত্তাসি। আল-মান্দারি ছিলেন আল-ওয়াত্তাসির অধীন। আয়েশার বিয়ের পর আল-ওয়াত্তাসি আয়েশার ভাই ইবরাহিমকে নিজের দরবারে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।
স্পেন থেকে তাঁর জ্ঞাতিগোষ্ঠী যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের অনেকেই ছিলেন গ্রানাডার নামকরা নাবিক। নতুন করে নির্মাণ করা হয় সর্বাধুনিক যুদ্ধজাহাজ।
রানি আয়েশা
১৫১৫ বা এর দু-এক বছর পর আল-মান্দারি মারা যান। স্বামীর মৃত্যু আয়েশার জন্য সম্ভাবনার নতুন এক দুয়ার খুলে দেয়। যোগ্য কোনো উত্তরাধিকার না থাকায় তিনি নিজেকে তিতওয়ানের প্রশাসক ঘোষণা করেন। যেহেতু তিনি দীর্ঘদিন রানি ছিলেন এবং তাঁর বাবাও ছিলেন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রভাবশালী, এ কারণে সবাই বিনাবাক্যে তা মেনে নেয়।
আয়েশা নিজেকে স্বাধীন রানি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। নামের সঙ্গে পদবি যুক্ত করেন ‘সাইয়িদা আয়েশা আল-হুররা’। যার অর্থ: সার্বভৌম স্বাধীন রানি আয়েশা। কিছুদিন পরই তিনি একটি সংগঠিত ও শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ার কাজে মন দেন।
স্পেন থেকে তাঁর জ্ঞাতিগোষ্ঠী যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের অনেকেই ছিলেন গ্রানাডার নামকরা নাবিক। নতুন করে নির্মাণ করা হয় সর্বাধুনিক যুদ্ধজাহাজ। নিয়োগ দেওয়া হয় উত্তর মরক্কোর ডাকসাইটে নৌ সেনা অধিপতিদের। এরপর সময়–সুযোগ বুঝে বেরিয়ে পড়েন ভূমধ্যসাগরের উত্তাল তরঙ্গে।
নৌযুদ্ধে
পর্তুগিজ ও স্প্যানিশরা তখন আরব, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারতবর্ষে তাদের রকমারি ব্যবসার পসরা সাজাতে ব্যস্ত। পণ্য আনা–নেওয়ার জন্য ভূমধ্যসাগর ছিল তাদের জাহাজের আবশ্যিক রুট। ১৫১৫ সালের পর এই রুটে জিব্রাল্টার প্রণালির সরু খাঁড়িতে হামলা শুরু করেন আল-হুররা। দ্রুত হামলা করে ধনসম্পদ নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার গায়েব হয়ে যেতেন তাঁরা।
সাগরে দস্যিপনার প্রয়োজন ছিল না তাঁর। স্বামীর অঢেল সম্পদে সুখেই ছিলেন তিনি। কিন্তু ছোটবেলার সেই দুঃসহ স্মৃতি, মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়ার অপমানজনক অধ্যায় ভুলতে পারেননি তিনি।
তবে তাঁরা শুধু স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ জাহাজে হামলা করতেন, কোনো মুসলিম বা আফ্রিকান জাহাজে নয়। কিছুদিনের মধ্যে এই ‘জলদস্যুদের’ কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মুখে মুখে রটে যায়, এক নারী জলদস্যু কবজা করেছেন পশ্চিম ভূমধ্যসাগর।
এ সময়টাতে ভূমধ্যসাগরের আলজিয়ার্স অঞ্চলের আধিপত্য ছিল দুর্ধর্ষ নৌযোদ্ধা খায়রুদ্দিন বারবারোসা ও তার ভাই উরুজ রেইসের। ভাগ্যাহত স্প্যানিশ মুসলিমদের প্রতি উরুজ রেইস ছিলেন অত্যন্ত সহমর্মী। সাইয়িদা আল-হুররা হাত মেলান উরুজ রেইসের সঙ্গে। কিছুদিনের মধ্যে ভূমধ্যসাগরে পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ জাহাজের ঘুম হারাম করে দেন আয়েশা আল-হুররা।
একদিকে আয়েশা যেমন ছিলেন তিতওয়ানের রানি শাসক, তেমনি ছিলেন সাগরের দুঃসাহসী নৌযোদ্ধা। তবে সাগরে দস্যিপনার প্রয়োজন ছিল না তাঁর। স্বামীর অঢেল সম্পদে সুখেই ছিলেন তিনি। কিন্তু ছোটবেলার সেই দুঃসহ স্মৃতি, মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়ার অপমানজনক অধ্যায় ভুলতে পারেননি তিনি। তা ছাড়া মরক্কোর তখন রাষ্ট্রীয় কোনো নৌবাহিনী ছিল না বলে তাদের নৌবাহিনীর কাজও আনজাম দিতেন আল-হুররার নৌসেনারা।
সাইয়িদা আয়েশা আর বিয়ে করেননি। প্রায় ২৫ বছর তিনি শাসন করেন তিতওয়ান এবং এ সময় আক্রমণ করেন শত শত পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ জাহাজে। স্পেন, পর্তুগাল, রোম তো বটেই, তিউনিস, আলজিয়ার্স, আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। এ অঞ্চলের সহায়হীন মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে গণ্য হতে থাকেন তিনি।
তিনি শর্ত দেন, বিয়ের জন্য কনে নয়, বরকেই আসতে হবে কনের বাড়িতে। আয়েশা আল-হুররার শর্ত মেনে নিয়ে রাজকীয় বিয়ের বরাত নিয়ে তিতওয়ানে আসেন রাজা।
১৫৪০ সালে উত্তর মরক্কোর শাসক আহমদ আল-ওয়াত্তাসি সাইয়িদা আয়েশা আল-হুররার কাছে বিয়ের পয়গাম পাঠান। দুজনেরই বয়স হয়েছিল। রাজ্যের ঐক্যের জন্য এটা ছিল অনেকটা রাজনৈতিক বিয়ে। আল-হুররা পয়গাম কবুল করেন। তবে তিনি শর্ত দেন, বিয়ের জন্য কনে নয়, বরকেই আসতে হবে কনের বাড়িতে। আয়েশা আল-হুররার শর্ত মেনে নিয়ে রাজকীয় বিয়ের বরাত নিয়ে তিতওয়ানে আসেন রাজা।
বিয়ের দুই বছর পর ১৫৪২ সালে সাইয়িদা আল-হুররার জামাতা আহমদ আল-হাসান আল-মান্দারি তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর কাছ থেকে তিতওয়ানের শাসনকার্য ছিনিয়ে নেন এবং তাঁকে তাঁর পৈতৃক নিবাস শেফশাউনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে পাঠানো হয়। এই বিশ্বাসঘাতকতার পেছনে পর্তুগিজদের এবং দক্ষিণ মরক্কোর শাসক সাদির হাত ছিল বলে ধারণা করা হয়।
উত্তর ও দক্ষিণ মরক্কো ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী দুই সালতানাত। প্রায়ই দুই মরক্কোর মধ্যে যুদ্ধ-কলহ তৈরি হতো। এর জেরেই সাইয়িদা আল-হুররাকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে নির্বাসনে যেতে হয়।
শেফশাউনে সাইয়িদা আয়েশা আল-হুররা ২০ বছর নির্বাসনে কাটান। অবশেষে ১৫৬১ সালের ১৪ জুলাই নির্বাসনেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
সূত্র: সিস্টার–হুড ডটকম