তওবা মানে অনুতাপ বা প্রত্যাবর্তন। সুরা তওবা পবিত্র কোরআনের নবম সুরা। এই সুরা মদিনায় অবতীর্ণ হয়। এতে রয়েছে ১৬ রুকু, ১২৯ আয়াত। এই সুরাকে ‘তওবা’র পাশাপাশি ‘বারাআত’ (দায়মুক্তি) নামেও ডাকা হয়। এ সুরায় বিশ্বাসীদের তওবা কবুল হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ জন্য এটিকে সুরা তওবা বলা হয়। বারাআত বলার কারণ হলো, বারাআত অর্থ সম্পর্ক ছিন্ন করা। এতে অবিশ্বাসীদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্কচ্ছেদ ও তাদের ব্যাপারে দায়মুক্তির কথা উল্লেখ রয়েছে।
পবিত্র কোরআনে শুধু এই সুরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লিপিবদ্ধ হয়নি। অনেকের মতে, এটি স্বতন্ত্র সুরা নয়, সুরা আনফালের শেষাংশ মাত্র। হজরত আলী (রা.)–এর মতে, এটি স্বতন্ত্র সুরা। কাফিরদের সঙ্গে তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য চুক্তি বাতিল করার ঘোষণা রয়েছে। অনেকের মতে, এ রকম ব্যাপারে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ব্যবহৃত হয় না।
ইসলাম যে জয়যুক্ত হবে, এ বিষয়ে বিশ্বাসীদের তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত করা হয়েছে। সুরা তওবার ২৯ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যাদের ওপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা আল্লাহ বিশ্বাস করে না ও পরকালেও না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা যারা নিষিদ্ধ করে না ও সত্যধর্ম অনুসরণ করে না, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে যে পর্যন্ত না তারা বশ্যতা স্বীকার করে আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ স্বেচ্ছায় জিজিয়া দেয়।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ২৯)
জাকাত প্রদানের আট খাত
আল্লাহ তাআলা এই সুরায় জাকাত প্রদানের খাত বর্ণনা করেছেন। যেমন ১. গরিব, যার নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। ২. মিসকিন, যার মালিকানায় কোনো সম্পদ নেই। ৩. ইসলামি সরকারের পক্ষ থেকে জাকাত সংগ্রহে নিয়োজিত ব্যক্তি। ৪. ইসলামের দিকে চিত্ত আকর্ষণের জন্য জাকাত দেওয়া। ৫. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। ৬. নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ দাস–দাসী। ৭. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী। ৮. মুসাফির, সফর অবস্থায় অভাবগ্রস্ত মানুষ। (সুরা তওবা, আয়াত: ৬০)
তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ
এই সুরার মাধ্যমে আল্লাহ মুসলমানদের তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ দেন। (সুরা তওবা, আয়াত: ৩৯)
৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের নবম হিজরিতে তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাবুক মদিনা ও দামেস্কের (সিরিয়া) মধ্যবর্তী একটি স্থান, যা মদিনা থেকে ৬৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ইসলামের বিরুদ্ধে আরবের অবিশ্বাসী ও মুনাফিক দলের শেষ চেষ্টা ছিল এই যুদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর দূত হারেস বিন উমায়ের (রা.)–কে হত্যার মধ্য দিয়ে তাবুক যুদ্ধের সূচনা হয়। রাসুল (সা.) দূতের মাধ্যমে জানতে পারলেন, মুতা যুদ্ধের (মুসলিম ও রোমানদের যুদ্ধ) প্রতিশোধ নিতে একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে রোম। নবীজি আদেশ করেন, হিরাক্লিয়াসের আক্রমণের আগে তিনি আক্রমণ করবেন। সবাইকে তৈরি হতে বলেন। এর আগে এমন রাজকীয় বাহিনীর মুখোমুখি তাঁরা কোনো দিন হননি।
এদিকে মদিনায় তখন প্রচণ্ড গরম, খেজুর পাকার মৌসুম। সময়মতো খেজুর ঘরে তুলতে না পারলে মদিনায় খাদ্যের অভাবও দেখা দেবে। কিন্তু সবকিছু পেছনে ফেলে রাসুল (সা.) ৩০ হাজার সাহাবির কাফেলা নিয়ে চললেন তাবুক প্রান্তের দিকে। অনেকে যুদ্ধে যেতে চাইলেন না, কপটতার (মুনাফিক) পরিচয় দেন। হিরাক্লিয়াস মুসলমানদের অভিযানের সংবাদ পেয়ে রণেভঙ্গ দেন।
তাবুক থেকে ফেরার পথে জু–আওয়ান নামক স্থানে ‘মসজিদে জিরার’ বলে অভিহিত ষড়যন্ত্রকারীদের একটি স্থাপনা ধ্বংস করে দেন তিনি। মূলত মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্য খ্রিষ্টান পাদরি আবু আমিরের উসকানিতে কিছু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণের ভান করে ওই মসজিদ বানিয়েছিল। তাবুক থেকে ফেরার পথে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ আয়াত নাজিল করেন, ‘আর যারা মসজিদ তৈরি করেছে ক্ষতিসাধন, কুফুরি আর মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, আর যে ব্যক্তি আগে থেকেই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তার ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের নিমিত্তে, তারা অবশ্যই শপথ করবে যে, আমাদের উদ্দেশ্য সৎ ব্যতীত নয়। আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তারা নিশ্চিত মিথ্যাবাদী।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ১০৭)
বিশ্বাসী ও কপটদের বৈশিষ্ট্য
সুরা তওবায় তাবুক যুদ্ধে অংশ না নেওয়া মুনাফিকদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ১. মিথ্যা অজুহাত পেশ করে। ২. টালবাহানা করে। ৩. হাস্যকর কথা বলে জিহাদে না যাওয়ার অনুমতি আদায় করে। ৪. মুসলিম সমাজে অনিষ্ট ছড়ায়। ৫. মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা–বিদ্বেষ ছড়ায় ও মুসলমানদের বিপদে আনন্দ প্রকাশ করে। ৬. মিথ্যা শপথ করে। ৭. সম্পদ পেলে আনন্দ পায়, না পেলে ক্ষোভ প্রকাশ করে। ৮. আল্লাহর মহব্বত, আল্লাহর জিকির ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধশূন্য অন্তর। ৯. নবীজি (সা.)–কে গালমন্দ করে। ১০. একে অপরকে মন্দ কাজের আদেশ দেয়, ভালো কাজ থেকে নিষেধ করে। ১১. কৃপণ। (সুরা তওবা, আয়াত: ৪২ থেকে ৫৯)
আল্লাহ বিশ্বাসীদের কিছু গুণের কথাও বলে দিয়েছেন। যেমন ১. যারা তওবা করে। ২. উপাসনা করে। ৩. আল্লাহর প্রশংসা করে। ৪. রোজা রাখে। ৫. রুকু করে। ৬. সিজদা করে। ৭. ভালো কাজের নির্দেশ দেয়। ৮. অসৎকর্মে নিষেধ করে। ৯. আল্লাহর সীমারেখা মেনে চলে। (সুরা তওবা, আয়াত: ১১২)
তবে তিনজন সাহাবি, যাঁরা মুনাফিক নন, কিন্তু অলসতাবশত তাবুকে অংশগ্রহণ করেননি, তাঁদের সঙ্গে বর্জনের নির্দেশ দিয়েছিলেন রাসুল (সা.)। তাঁরা হলেন, কা’আব ইবনে মালিক, হিলাল ইবনে উমাইয়া ও মুরারা ইবনে রুবাই। আল্লাহ তাআলা তাঁদের ক্ষমার ঘোষণা দেন এই সুরায়, ‘আর তিনি অপর তিনজনকেও ক্ষমা করলেন, যাদের পেছনে ফেলে আসা হয়েছিল। পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য তা ছোট হয়ে আসছিল এবং তাদের জীবন তাদের জন্য দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে আল্লাহ ছাড়া কোনো আশ্রয় নেই। পরে আল্লাহ তাদেরকে অনুগ্রহ করলেন, যাতে তারা অনুতপ্ত হয়। আল্লাহ তো ক্ষমাপরবশ, পরম দয়ালু।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ১১৮)
আবু লুবাবার (রা.) তওবা
মসজিদে নববির ভেতরে কয়েকটি স্তম্ভ রয়েছে, সেগুলোকে রহমতের স্তম্ভ বা খুঁটি বলা হয়। উস্তুওয়ানা আবু লুবাবা (তওবা স্তম্ভ) উফুদের পশ্চিম পাশে রওজায়ে জান্নাতের ভেতর অবস্থিত। একটি ভুল করার পর তিনি নিজেকে এই স্তম্ভের সঙ্গে বেঁধে বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত হুজুরে পাক (সা.) নিজে না খুলে দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এর সঙ্গে বাঁধা থাকব।’ রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে আল্লাহ আদেশ না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত খুলব না।’ এভাবে দীর্ঘ ৫০ দিন পর এই সুরার আয়াত নাজিল হয় এবং তাঁর ক্ষমার ঘোষণা আসে, ‘আর কিছু লোক নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেছে, ওরা এক ভালো কাজের সঙ্গে আরেক খারাপ কাজ মিশিয়ে ফেলেছে। আশা করা যায়, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ ( সুরা তওবা, আয়াত: ১০২–৩)
অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে তাঁর বাঁধন খুলে দেন।