মহানবী (সা.) কীভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন

মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর মুসলমানরা আশা করেছিলেন, মক্কার কুরাইশরা তাদের বিরুদ্ধে বৈরিতা পরিত্যাগ করবে। কিন্তু কুরাইশ নেতৃবৃন্দ মদিনায় ইসলাম ও মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে নিজেদের জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। এই পরিস্থিতিতে মদিনায় গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়। মহানবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর অসাধারণ দূরদর্শিতা, কূটনৈতিক দক্ষতা এবং নাগরিকত্বের চেতনার মাধ্যমে এই সংকট নিরসন করেন, মদিনাকে একটি শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ সমাজে রূপান্তরিত করেন।

  মক্কার উদ্বেগের কারণ

 মুসলমানদের মদিনায় হিজরত মক্কার কুরাইশদের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ সৃষ্টি করে। তাদের আশঙ্কার প্রধান কারণগুলো ছিল এ রকম।

 মদিনার কৌশলগত অবস্থান: মদিনা সিরিয়া অঞ্চলের বাণিজ্যিক কাফেলার পথে অবস্থিত ছিল। মুসলমানদের শক্তিশালী হওয়া মক্কার বাণিজ্যিক প্রাধান্যের জন্য হুমকি ছিল। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা: ২৫২-২৫৪)

 প্রতিশোধ ও সম্পদের ভয়: কুরাইশরা আশঙ্কা করত, মুসলমানরা মক্কায় ফিরে তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে পারে এবং মক্কায় নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে পারে।

 ইসলামের প্রচার: নবী (সা.) ও তাঁর সাহাবিদের দাওয়াত অব্যাহত থাকলে মক্কার ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক নেতৃত্ব বিপন্ন হতে পারত। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/১৬০-১৬২)

মদিনার গোত্রীয় শক্তি: মদিনার প্রধান গোত্র আওস ও খাজরাজ একত্রিত হলে মদিনা একটি শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত হতে পারত। (তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ১/১৯০-১৯২)

ইহুদি সম্প্রদায়ের সম্ভাব্য সমর্থন: মদিনার ইহুদি গোত্রগুলো (বনু কাইনুকা, বনু নাদির, বনু কুরাইজা) শেষ নবীর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল। তারা ইসলাম গ্রহণ করে নবী (সা.)-এর সঙ্গে তাদের সম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যোগ দিতে পারত। (তাফসিরে ইবন কাসির, ১/৫২৮-৫৩০; সুরা বাকারা, আয়াত ২১৭)

এই আশঙ্কা থেকে কুরাইশরা মদিনার উদীয়মান শক্তিকে ধ্বংস করতে রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল অবলম্বন করে।

আরও পড়ুন

মদিনায় গৃহযুদ্ধের ষড়যন্ত্র

কুরাইশরা মদিনার অভ্যন্তরীণ বিভেদকে কাজে লাগিয়ে গৃহযুদ্ধ উসকে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা মদিনার প্রভাবশালী নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলকে হুমকিমূলক বার্তা পাঠায়। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই, যিনি মদিনার নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন, নবী (সা.)-এর আগমনে হতাশ ছিলেন এবং ইসলামের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করতেন। কুরাইশদের বার্তা ছিল: ‘তোমরা আমাদের লোককে আশ্রয় দিয়েছ। আমরা আল্লাহর শপথ করে বলছি, যদি তুমি তার সঙ্গে যুদ্ধ না করো বা তাকে বহিষ্কার না করো, তাহলে আমরা সবাই তোমাদের কাছে আসব এবং তোমাদের পুরুষদের হত্যা করব এবং তোমাদের নারীদের নিয়ে যাব!’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৩৪৪)

এই বার্তা পেয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মদিনার মুশরিক ও মুনাফিকদের একত্র করেন। তিনি তার গোত্র খাজরাজ এবং তাদের শতাব্দী প্রতিদ্বন্দ্বী আওস গোত্রের মুশরিকদের নিয়ে নবী (সা.) ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২৩,৮১৪)

আরও পড়ুন

নবীজি (সা.)–এর কূটনৈতিক পদক্ষেপ

এই সংকটময় মুহূর্তে মহানবী (সা.) অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তিনি মদিনার মুশরিকদের কাছে গিয়ে বলেন, ‘কুরাইশের হুমকি তোমাদের প্রভাবিত করেছে। তারা তোমাদের যতটা ক্ষতি করতে পারত, তা তোমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করবে। তোমরা কি তোমাদের ছেলে এবং ভাইদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাও?’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৩৪৪)

এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর বক্তব্য মদিনাবাসীদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে। নবী (সা.) ধর্মীয় বক্তব্য এড়িয়ে তাদের নাগরিকত্ব, পারিবারিক বন্ধন এবং মদিনার ঐক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বোঝান যে, কুরাইশদের হুমকির প্রতি সাড়া দিয়ে তারা নিজেদের গোত্র ও পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে, যা মদিনার জন্য ধ্বংসাত্মক হবে। তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম ছিল: ‘আপনারা এখন নিজেরাই যা করছেন—একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং একে অপরকে হত্যা করে—তা কুরাইশরা যা হুমকি দিয়েছিল তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক।’

এই কথা শুনে মদিনার মুশরিকরা শান্ত হয়ে যায় এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি ত্যাগ করে। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/১৬০-১৬২)

আরও পড়ুন

নাগরিকত্বের শক্তি

 নবী (সা.)-এর এই পদক্ষেপ নাগরিকত্বের শক্তির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি ইসলামের দাওয়াত বা আল্লাহর আদেশের ওপর জোর না দিয়ে মদিনার বাসিন্দাদের সাধারণ পরিচয় এবং ভাগ করা ভবিষ্যতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি গৃহযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক পরিণতি এড়াতে পারিবারিক ও গোত্রীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দেন। এই কৌশল মদিনার মুসলিম, মুশরিক ও মুনাফিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত প্রতিরোধ করে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এই ঘটনা মদিনা সনদের (মিসাক-ই-মদিনা) ভিত্তি তৈরিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল, যেখানে মুসলিম, মুশরিক ও ইহুদিদের মধ্যে সহাবস্থানের নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/১৬০-১৬২)

নবী (সা.) গৃহযুদ্ধের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মুসলমানদের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারতেন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা। তিনি সর্বদা ধৈর্য, কূটনীতি এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বেছে নিতেন, এবং শুধু অনিবার্য পরিস্থিতিতে যুদ্ধের আশ্রয় নিতেন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি মদিনাকে একটি স্থিতিশীল, বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধ সমাজে রূপান্তরিত করতে সহায়তা করে।

মহানবী (সা.)–এর কৌশল

 আওস ও খাজরাজের ঐক্য: আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে শতাব্দীব্যাপী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, যা বুয়াসের যুদ্ধে চরম আকার ধারণ করেছিল। ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে এই গোত্রদ্বয়ের মুসলমানেরা ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তবে মুশরিক ও মুনাফিকরা এই শত্রুতাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিল। নবী (সা.)-এর হস্তক্ষেপ এই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে।

মুনাফিকদের ভূমিকা: আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল মদিনার মুনাফিকদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নবী (সা.)-এর আগমনে তাঁর নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ হওয়ায় তিনি কুরাইশদের হুমকিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। নবী (সা.)-এর কৌশলগত হস্তক্ষেপ তাঁর পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে।

 ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রেক্ষাপট: মদিনার ইহুদি গোত্রগুলো এ ঘটনায় সরাসরি জড়িত না হলেও তাদের সম্ভাব্য সমর্থন কুরাইশদের উদ্বেগ বাড়িয়েছিল। এটি কুরাইশদের মদিনায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করে। মহানবী (সা.) জাতীয় ঐক্য তৈরি করে তাদের চাপের মুখে রাখেন।

 সত্যের বিরোধীদের ঐক্য: আশ্চর্যজনকভাবে, আওস ও খাজরাজের মুশরিকরা তাদের পারস্পরিক শত্রুতা ভুলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছিল। এটি সত্যের বিরোধীদের একত্রিত হওয়ার প্রবণতাকে নির্দেশ করে। কোরআনে বলা হয়েছে: ‘আর যারা কাফির, তারা একে অপরের বন্ধু। যদি তোমরা এটা না করো, তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা ও বড় ধরনের ফাসাদ সৃষ্টি হবে।’ (সুরা আনফাল, আয়াত: ৭৩; তাফসিরে ইবনে কাসির)

 নবী মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা নিরসনে তাঁর অসাধারণ নেতৃত্ব, কূটনৈতিক দক্ষতা এবং নাগরিকত্বের চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ধর্মীয় বক্তব্যের পরিবর্তে সামাজিক ঐক্য ও পারিবারিক বন্ধনের ওপর জোর দিয়ে মদিনার মুসলিম, মুশরিক ও মুনাফিক সম্প্রদায়কে একত্রিত করেন। তাঁর এই পদক্ষেপ শুধু গৃহযুদ্ধ প্রতিরোধই করেনি, বরং মদিনাকে একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল এবং বৈচিত্র্যময় সমাজে রূপান্তরিত করেছে। এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে সংকটময় মুহূর্তে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় নাগরিকত্বের চেতনা অপরিহার্য।

 সূত্র: তাফসিরে ইবন কাসির, দার তাইয়্যিবা, রিয়াদ, ১৯৯৯; তাবাকাতে ইবনে সা’দ, দার সাদির, বৈরুত, ১৯৬৮; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮; সিরাতে ইবনে হিশাম, দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যা, বৈরুত, ২০০০।

আরও পড়ুন