মহানবীর (সা.) প্রতি সাহাবিদের সীমাহীন ভালোবাসা

ছবি: পেক্সেলস

জাহেলি যুগের অন্ধকারময় মরুভূমিতে যখন অন্যায়, হানাহানি আর রক্তপাত ছিল নিত্যসঙ্গী, তখন আল্লাহ তায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ পাঠালেন তাঁর মুহাম্মাদ (সা.)-কে। তিনি অন্ধ চোখে আলো দিলেন, বধির কানে সত্যের সুর শোনালেন।

সাহাবিরা তাঁর মধ্যে খুঁজে পেলেন পথের দিশা, অন্তরের তৃষ্ণা মেটানোর ঝরনা এবং এক অসীম স্নেহময় হৃদয়। কোরআনে বলা হয়েছে: ‘তোমাদের কাছে এসেছে একজন রাসুল, তোমাদেরই মধ্য থেকে, তোমাদের কষ্ট তাঁর কাছে কষ্টকর, তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি দয়ালু, করুণাময়।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ১২৮)

এই আয়াত সাহাবিদের হৃদয়ের কথা বলে দিল। তাঁরা নবীজিকে ভালোবাসলেন পুরো অন্তর দিয়ে—এমন ভালোবাসা যা দিন দিন বেড়েছে, ঝড়ঝাপ্টায়ও অটুট থেকেছে। এই ভালোবাসা শুধু আবেগ নয়, ইমানের অংশ সাব্যস্ত হয়েছে। আজ আমরা সেই অপূর্ব প্রেমের ছবি দেখলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হই।

বল, তোমাদের পিতা, সন্তান, ভাই, স্ত্রী, আত্মীয়, অর্জিত সম্পদ, যে ব্যবসা ক্ষতির ভয় করো, যে বাড়িঘর পছন্দ করো—যদি এসব আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও তাঁর পথে জিহাদের চেয়ে প্রিয় হয়, তাহলে অপেক্ষা করো আল্লাহর আদেশ আসা পর্যন্ত।
কোরআন, সুরা তাওবা, আয়াত: ২৪

সাহাবিদের এই গভীর প্রেমের কারণ কী ছিল?

প্রথমত, তাঁরা দেখেছেন নবীজির অসাধারণ চরিত্র, উদারতা আর সৌন্দর্য।

দ্বিতীয়ত, তাঁকে অনুসরণ করে তাঁরা পেয়েছেন দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণ। আর সবচেয়ে বড় কথা, কোরআন শিখিয়েছে যে, নবীপ্রেম ইমানের অংশ।

আল্লাহ বলেন, ‘বল, তোমাদের পিতা, সন্তান, ভাই, স্ত্রী, আত্মীয়, অর্জিত সম্পদ, যে ব্যবসা ক্ষতির ভয় করো, যে বাড়িঘর পছন্দ করো—যদি এসব আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও তাঁর পথে জিহাদের চেয়ে প্রিয় হয়, তাহলে অপেক্ষা করো আল্লাহর আদেশ আসা পর্যন্ত।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ২৪)

এই আয়াত সাহাবিদের মনে গেঁথে দিয়েছে যে, নবীজিকে ভালোবাসতে হবে সবার আগে।

আরও পড়ুন

একবার ওমর (রা.) নবীজির হাত ধরে বললেন, ‘আল্লাহর রাসুল, আপনি আমার কাছে সবকিছুর চেয়ে প্রিয়, শুধু নিজের প্রাণ ছাড়া।’ নবীজি বললেন, ‘না, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, ততক্ষণ পর্যন্ত না যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে নিজের প্রাণের চেয়েও প্রিয় হই।’ ওমর (রা.) তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, এখন আপনি আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়।’ নবীজি বললেন, ‘এখন হল, ওমর।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৬৩২)

এই হাদিস দেখায়, নিজেকে ভালোবাসা স্বাভাবিক, কিন্তু নবীপ্রেম একজন মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। আমরা নিজেকে ভালোবাসি বলেই তাঁকে ভালোবাসতে পারি, কারণ তিনি আমার জন্য সবচেয়ে ভালো চান।

এক সাহাবি বললেন, ‘আপনি আমার প্রাণ, পরিবার, সম্পদ, সন্তান—সবার চেয়ে প্রিয়। কিন্তু মৃত্যুর কথা ভাবি—আপনি জান্নাতে নবীদের সঙ্গে উচ্চতর অবস্থানে থাকবেন, আর আমি নীচে।

এই প্রেম এত গভীর ছিল যে, সাহাবিরা জান্নাতেও নবীজির সঙ্গ চাইতেন। এক সাহাবি বললেন, ‘আপনি আমার প্রাণ, পরিবার, সম্পদ, সন্তান—সবার চেয়ে প্রিয়। ঘরে থাকলে আপনার কথা মনে পড়ে, সহ্য করতে পারি না, ছুটে আসি আপনাকে দেখতে। কিন্তু মৃত্যুর কথা ভাবি—আপনি জান্নাতে নবীদের সঙ্গে উচ্চতর অবস্থানে থাকবেন, আমি নীচে। তখন কীভাবে দেখা হবে?’

নবীজি চুপ করে রইলেন। তখন জিবরাইল (আ.) ওহি আনলেন, ‘যারা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করে, তারা থাকবে নবী, সত্যবাদী, শহিদ ও সৎকর্মশীলদের সঙ্গে।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ৬৯)

এই আয়াত সাহাবিদের মনে নতুন করে আশার আলো জ্বালিয়ে দিল। তাঁদের প্রেম শুধু দুনিয়ার নয়, আখেরাত পর্যন্ত বিস্তৃত।

প্রেমের আরেক রূপ দেখা যায় ত্যাগে। হিজরতের পথে আবু বকর (রা.) নবীজির সঙ্গে গুহায় যাচ্ছিলেন। তিনি কখনো সামনে, কখনো পেছনে হাঁটছিলেন। নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কী করছ?’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘পেছনের দিকে শত্রুর ভয় আছে মনে হলে পেছন দিকে যাই, সামনের দিকে উঁচু জায়গা থেকে নজরদারির ভয় আছে মনে হলে আবার আপনার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।’

নবীজি বললেন, ‘যদি কিছু হয়, তুমি চাও আমার বদলে তা তোমার হোক?’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, যিনি আপনাকে সত্য দিয়ে পাঠিয়েছেন, কোনো বিপদ হলে আমার হোক, আপনার নয়।’ গুহায় পৌঁছে তিনি প্রথমে ঢুকে সব দেখে নিলেন, এমনকি গর্তে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলেন যেন কোনো বিষাক্ত প্রাণী না থাকে। তারপর বললেন, ‘আসুন, হে আল্লাহর রাসুল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৯০৫)

আরও পড়ুন

এই প্রেমের ফল কী? নবীজি বলেছেন, ‘তুমি যাকে ভালোবাসো, তার সঙ্গে থাকবে।’ আনাস (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেন, এক লোক নবীজিকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেয়ামত কবে?’ নবীজি বললেন, ‘তার জন্য কী প্রস্তুতি নিয়েছ?’ লোকটি বলল, ‘বেশি নামাজ-রোজা-সদকা নাই আমার, কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসি।’ নবীজি বললেন, ‘তুমি যাকে ভালোবাসো, তার সঙ্গে থাকবে।’

আনাস (রা.) বলেন, ‘এই কথায় আমরা এত খুশি হয়েছি, আর কোনো কথায় এত খুশি হইনি। আমি নবীজি, আবু বকর, ওমরকে ভালোবাসি, আশা করি তাঁদের সঙ্গে থাকব, যদিও তাঁদের মতো আমল করতে পারি না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৬৩১)

এই হাদিস বলে, নবীপ্রেম আমলের ঘাটতি পূরণ করতে পারে। কেননা, যাকে ভালোবাসি, কেয়ামতে তার সঙ্গে থাকব। তাই সতর্ক হয়ে ভালোবাসার তালিকা ঠিক করুন।

পাপ করলেও যদি নবীপ্রেম থাকে তবে তা হৃদয় থেকে মুছে যায় না যায় না, যদি অনুতাপ করে তবে পাপা মাফ হবে। কিন্তু বারবার পাপ করলে তা হৃদয় কঠিন করে দিতে পারে।
ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.), ফাতহুল বারি

এই প্রেম এমনকি গুনাহগারকেও রক্ষা করে। ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজির যুগে এক লোক ছিল, নাম আবদুল্লাহ, ডাকনাম হিমার। সে নবীজিকে হাসাত। কিন্তু মদ খেয়ে ধরা পড়ত। একবার আবার ধরা পড়ল, শাস্তি হলো। একজন বলল, ‘আল্লাহ, তাকে অভিশাপ দিন, কতবার ধরা পড়ে!’ নবীজি বললেন, ‘তাকে অভিশাপ দিয়ো না। আল্লাহর শপথ, আমি জানি সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮০)

ইবনে হাজার বলেন, পাপ করলেও যদি নবীপ্রেম থাকে তবে তা হৃদয় থেকে মুছে যায় না যায় না, যদি অনুতাপ করে তবে পাপা মাফ হবে। কিন্তু বারবার পাপ করলে তা হৃদয় কঠিন করে দিতে পারে। (ইবনে হাজার, ফাতহুল বারি, ১২/১২৫, দারু রায়য়ান লিত তুরাস, কায়রো, ১,৯৮৭)

তাই নবীপ্রেম রক্ষা করা এবং পাপ থেকে বাঁচাতে উভয়টা জরুরি।

এই প্রেম শুধু সাহাবীদের নয়, পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও সত্য। নবীজি বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবে যারা আমার পরে আসবে, তারা চাইবে পরিবার-সম্পদ দিয়ে হলেও আমাকে দেখতে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮৩)

আমরা যারা নবীজিকে দেখিনি, তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ করে, তাঁকে ভালোবেসে তাঁর সঙ্গ লাভ করতে পারি।

শেষ কথা, সাহাবিদের নবীপ্রেম আমাদের শেখায়—প্রেম মানে ত্যাগ, মানে আখেরাতের আশা, মানে আমলের পথ। এই প্রেম হৃদয়কে আলোকিত করে, জীবনকে অর্থময় করে। আসুন, আমরাও নবীজির আদর্শে চলি, তাঁকে ভালোবাসি, যেন জান্নাতে তাঁর সঙ্গ পাই। এই প্রেমই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।

আরও পড়ুন