সাহাবি ইবনে বিশরের অলৌকিক লাঠি

আব্বাদ ইবনে বিশর (রা.) ছিলেন মদিনার আনসার সাহাবিদের একজন। তিনি ছিলেন আওস গোত্রের সদস্য। ইসলামের প্রথম দিকে তিনি মুসআব ইবনে উমায়র (রা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন।

মদিনায় যাওয়ার আগে মক্কায় হজে অংশ নিতে আসা মদিনার নতুন মুসলিমদের গোপন ঘঁটিতে মহানবী (সা.) দুইবার বাইআত করেছিলেন, যাকে বলে ‘আকাবার বাইআত’, আব্বাদ তখন যোগ দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বাইআতে। বিশ্বাসঘাতক ইহুদি নেতা কাব ইবনে আশরাফকে হত্যার অভিযানেও তিনি বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪০৩৭)

আব্বাদ ইবনে বিশর (রা.) সাহস, ইমান ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা তাঁকে আনসার সাহাবিদের মধ্যে উজ্জ্বল করে তুলেছে।

তাঁর আল্লাহর প্রেম এত গভীর ছিল যে, যুদ্ধের ময়দানে পাহারার দায়িত্ব পালনকালেও তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। শত্রুর তির তাঁর শরীরে বিদ্ধ হলেও তাঁর নামাজে ছেদ ঘটত না।

কোরআনের প্রতি ভালোবাসা

আব্বাদ ইবনে বিশর (রা.) কোরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ নামাজ ও ইবাদতের প্রতি অসাধারণ নিষ্ঠার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি দীর্ঘ রাত অবধি নামাজে কোরআন তিলাওয়াত করে কাটাতেন। তাঁর আল্লাহর প্রেম এত গভীর ছিল যে, যুদ্ধের ময়দানে পাহারার দায়িত্ব পালনকালেও তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। শত্রুর তির তাঁর শরীরে বিদ্ধ হলেও তাঁর নামাজে ছেদ ঘটত না। রাসুল (সা.) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘আব্বাদ ইবনে বিশর তাঁদের অন্তর্ভুক্ত, যাঁদের নিয়ে ফেরেশতারা গর্ব করে।’ (ইবনে আবদিল বার্‌র, আল-ইস্তিআব, দারুল জিল, ৩/১১৬৭, বৈরুত, ১৯৯২)

আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) তাঁর ঘরে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করছিলেন। এ সময় আব্বাদ (রা.)-এর কোরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনে বললেন, ‘আয়েশা, এটা কি আব্বাদের আওয়াজ?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ, আব্বাদের ওপর রহম করুন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৬৫৫)

আরও পড়ুন

অলৌকিক লাঠির ঘটনা

আব্বাদ (রা.)-এর জীবনে একটি অলৌকিক ঘটনা ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন: ‘এক অন্ধকার রাতে দুজন ব্যক্তি রাসুলের কাছ থেকে বের হন। তাঁদের হাতে ছিল দুটি লাঠি। হঠাৎ তাঁদের লাঠি থেকে প্রদীপের মতো উজ্জ্বল আলো বের হয়। সেই আলোর সাহায্যে তাঁরা নিজ নিজ ঘরে পৌঁছে যান। তাঁদের একজন ছিলেন আব্বাদ ইবনে বিশর এবং অপরজন (সম্ভবত) উসায়েদ ইবনে হুজায়র (রা.)।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৬৫ ও ৩,৮০৫)

এ ঘটনা তাঁর ইমান ও আল্লাহর নৈকট্যের প্রতি সাক্ষ্য বহন করে।

এক অন্ধকার রাতে দুজন ব্যক্তি রাসুলের কাছ থেকে বের হন। তাঁদের হাতে ছিল দুটি লাঠি। হঠাৎ তাঁদের লাঠি থেকে প্রদীপের মতো উজ্জ্বল আলো বের হয়।

বিভিন্ন দায়িত্বে আব্বাদ

নবীজি আব্বাদকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি ‘মুজায়না’ ও ‘বনু সালিম’ গোত্রে জাকাত সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করেন এবং তাবুক যুদ্ধে নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর নেতৃত্ব, সাহস ও ইমান তাঁকে আনসার সাহাবিদের মধ্যে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছে। আনসারদের মধ্যে তিনজন ব্যক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, যাঁরা বনু আবদুল আশহাল গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত: সাআদ ইবনে মুআজ, উসায়েদ ইবনে হুজায়র এবং আব্বাদ ইবনে বিশর (রা.)। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৬৫৫)

ইয়ামামার যুদ্ধে বীরত্ব ও শাহাদাত

আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘বুজাখা যুদ্ধের পর আব্বাদ বলেছিলেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমার জন্য আকাশ খুলে দেওয়া হয়েছে, তারপর তা বন্ধ হয়ে গেছে। ইনশাআল্লাহ, এটি আমার শাহাদাতের ইশারা।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহর শপথ, আপনি সুন্দর স্বপ্ন দেখেছেন।’ (ইবনে সা‘দ, তাবাকাতে ইবনে সা‘দ, ২/২৩৪, দারুল কুতুব, বৈরুত, ১৯৯০)

ইয়ামামার যুদ্ধে (১১ হি./৬৩২ খ্রি.) তাঁর বীরত্ব প্রবাদপ্রতিম হয়ে ওঠে। এমনকি বনু হানিফার লোকজনও তাঁর সাহসের কথা ভোলেনি। তাঁরা তাঁদের যোদ্ধাদের জখম দেখে বলতেন, ‘এই জখম আব্বাদের জখমের মতো।’ (আবদুল্লাহ আল-মাদানি, আল-আনসার ফিল আহদির রাশিদি, পৃ. ১৮৬, দারুল মা‘আরিফ, রিয়াদ, ১৯৮৫)

ইয়ামামার যুদ্ধে আব্বাদ ইবনে বিশরের বীরত্বের চূড়ান্ত নজির স্থাপন করেন। তিনি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে ডেকে বলেন, ‘আমি আব্বাদ ইবনে বিশর, হে আনসার, আমার কাছে চলে এসো।’

আরও পড়ুন

আব্বাদ ইবনে বিশরের ডাকে সাড়া দিয়ে আনসার সাহাবিরা তাঁর কাছে জড়ো হন। তিনি তাঁর তরবারির খাপ ভেঙে ফেলেন এবং আনসার সাহাবিদের তরবারির খাপ ভাঙতে উদ্বুদ্ধ করেন, যা ছিল শত্রুর বিরুদ্ধে শেষপর্যন্ত লড়াইয়ের প্রতীক। তিনি বলেন, ‘আমাকে অনুসরণ করো এবং কঠিন আক্রমণ চালাও!’

তাঁর শরীরে এত আঘাত ছিল যে তাঁকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। কেবল শরীরের একটি বিশেষ চিহ্নের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হয়।

আব্বাদ ইবনে বিশর ‘বনু হানিফা’র বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করেন। শত্রুরা তাঁদের আক্রমণের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে হাদিকাতুল মাউত (মৃত্যুর বাগান) নামক বাগানে পালিয়ে যায় এবং দরজা বন্ধ করে দেয়। মুসলিম বাহিনী দরজা ভেঙে ফেললে আব্বাদ (রা.) তাঁর বর্ম দরজার ওপর ছুঁড়ে মারেন এবং তরবারি হাতে বাগানে প্রবেশ করে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এভাবে এক সময় তিনি শহীদ হন। তাঁর শরীরে এত আঘাত ছিল যে তাঁকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। কেবল শরীরের একটি বিশেষ চিহ্নের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪৫ বছর। (ইবনে সা‘দ, তাবাকাতে ইবনে সা‘দ, ২/২৩৪, দারুল কুতুব, বৈরুত, ১৯৯০; ইবনে হাজার, আল-ইকতিফা, ৩/৫৩, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

ইয়ামামার যুদ্ধে বিদ্রোহী বনু হানিফার প্রায় ২১ হাজার যোদ্ধা নিহত হন, আর মুসলিম বাহিনীর প্রায় ১ হাজার ২০০ মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন, যাঁদের মধ্যে ৭০ জন ছিলেন কোরআনের হাফেজ।

আব্বাদ ইবনে বিশর (রা.) ছিলেন ইমান, সাহস ও ইবাদতের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবন থেকে আমরা আল্লাহর প্রতি অবিচল ভালোবাসা, কোরআনের প্রতি নিষ্ঠা এবং ইসলামের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার শিক্ষা পাই। তাঁর শাহাদাত ইসলামের ইতিহাসে এক অমর কাহিনি হিসেবে রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন