ইসলামি সভ্যতায় ডাকব্যবস্থার উৎপত্তি ও বিকাশ
আজকের ডিজিটাল যুগে ই–মেইল, মেসেজিং অ্যাপ আর ইন্টারনেট আমাদের যোগাযোগকে দ্রুত ও সহজ করেছে। তবু ডাকব্যবস্থা এখনো সমাজের সংযোগ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৮৭৪ সালে বিশ্ব ডাক সংস্থা প্রতিষ্ঠার স্মরণে প্রতিবছর ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক দিবস পালিত হয়। ২০২৫ সালে এই দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মানুষের সেবায় ডাক’। যোগাযোগের সেতু হিসেবে, উদ্ভাবনের প্রেরণা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে ডাকব্যবস্থার গুরুত্ব ছিল সীমাহীন।
ইসলামি সভ্যতায় ডাকব্যবস্থা ছিল শাসন, প্রশাসন ও জ্ঞানের আদান-প্রদানের একটি প্রধান স্তম্ভ।
ডাকব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনা ছিল রাষ্ট্র সুসংহত থাকার প্রতীক। যদি কোনো প্রদেশ থেকে ডাক আসা বন্ধ হতো, তা বিদ্রোহ বা অস্থিরতার লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হতো।
ইসলামি সভ্যতায় ডাকব্যবস্থার ইতিহাস
ইসলামি সভ্যতায় ডাকব্যবস্থা ছিল রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোর একটি মূল অংশ। এটি বিভিন্ন প্রদেশকে রাজধানীর সঙ্গে সংযুক্ত করত, খলিফার কাছে খবর পৌঁছে দিত এবং তাঁর নির্দেশ প্রদেশের শাসক ও কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছাত।
ডাকব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনা ছিল রাষ্ট্র সুসংহত থাকার প্রতীক। যদি কোনো প্রদেশ থেকে ডাক আসা বন্ধ হতো, তা বিদ্রোহ বা অস্থিরতার লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হতো। তাই ইসলামের প্রথম দিন থেকেই ডাকব্যবস্থার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
নবুয়তের যুগে ডাকব্যবস্থা
অনেকে মনে করতেন, ডাকব্যবস্থা উমাইয়া যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক একটি গবেষণা দেখা যায়, নবীজির (সা.) সময়েই এর শুরু হয়। হিজরতের পর মদিনায় এসে নবীজি (সা.) গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন, যাঁরা মক্কা থেকে খবর আনতেন।
তাঁদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর ছিলেন অন্যতম, যিনি গুহায় থাকা নবীজি (সা.) ও আবু বকর (রা.)-এর কাছে কুরাইশদের খবর পৌঁছে দিতেন।
ষষ্ঠ হিজরির শেষে নবীজি (সা.) আরব উপদ্বীপের বাইরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে বিভিন্ন রাজা ও শাসকদের কাছে চিঠি পাঠান। তিনি দিহিয়া ইবনে খালিফা আল-কালবিকে রোমের সম্রাটের কাছে, আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা সাহমিকে পারস্যের কিসরার কাছে, আমর ইবনে আসকে ওমানের শাসকের কাছে ও শুজা ইবনে ওয়াহাব আল-আসাদিকে গাসানের শাসকের কাছে পাঠান। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ৪/২৫৫, দারুল কুতুব, কায়রো, ১৯৫৫)
‘মাকাতিব আর-রাসুল’ বইয়ে বলা হয়, নবীজি (সা.) শতাধিক চিঠি পাঠিয়েছিলেন, অর্থাৎ ডাকব্যবস্থা তখনই ইসলাম প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল।
খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগ
খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়ে মুসলিম রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি পায় এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন বাড়ে। হজরত ওমর (রা.) ডাকের জন্য একটি আলাদা বিভাগ (দিওয়ান) প্রতিষ্ঠা করেন।
এই বিভাগের প্রধানকে ‘সাহিবুল বারিদ’ বলা হতো, যিনি চিঠি পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি প্রদেশের শাসকদের তদারক করতেন। প্রধান শহরগুলোতে ডাককেন্দ্র স্থাপিত হয়, ফলে রাষ্ট্রের প্রশাসন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
উমাইয়া যুগ
উমাইয়া যুগে ডাকব্যবস্থা আরও উন্নত হয়। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও বিজয় অভিযানের কারণে দ্রুত খবর আদান-প্রদানের প্রয়োজন বাড়ে। মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.) ডাক বিভাগ নতুন করে গড়ে তোলেন। যাতে খবর দ্রুত তাঁর কাছে পৌঁছায়।
একবার তিনি ইরাকের গভর্নরের কাছে এক লাখ দিরহাম পাঠানোর নির্দেশ দেন, কিন্তু চিঠি ছিল খোলা। এক ব্যক্তি তাতে দুই লাখ করে দেন। এ ঘটনার পর মুয়াবিয়া চিঠিতে সিল ব্যবহার শুরু করেন এবং ডাক বিভাগকে আরও সংগঠিত করেন। (ইবনে তাকতাকা, আল-ফাখরি ফিল আদাব আস-সুলতানিয়া, পৃষ্ঠা ৮৭, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৬৬)
আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের সময়ে ডাক বিভাগ আরও শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়। তিনি কাবিসা ইবনে জুয়াইবকে এর দায়িত্ব দেন এবং নির্দেশ দেন যে ‘সাহিবুল বারিদ’ যেকোনো সময় তাঁর কাছে প্রবেশ করতে পারবেন।
কারণ, তিনি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ খবর বহন করতেন। উমর ইবনে আবদুল আজিজের সময়ে ডাক রুটে খান (বিশ্রামাগার) ও পশুদের জন্য পানির ব্যবস্থা করা হয়।
একবার তিনি ইরাকের গভর্নরের কাছে এক লাখ দিরহাম পাঠানোর নির্দেশ দেন, কিন্তু চিঠি ছিল খোলা। এক ব্যক্তি তাতে দুই লাখ করে দেন। এ ঘটনার পর মুয়াবিয়া চিঠিতে সিল ব্যবহার শুরু করেন।
আব্বাসি যুগ
আব্বাসি যুগে ডাকব্যবস্থা রাষ্ট্রের একটি মূল স্তম্ভ হয়ে ওঠে। আবু জাফর আল-মনসুর বলতেন, রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভের একটি হলো ডাক বিভাগ, কেননা, বার্তাবহ খলিফার কাছে কর্মকর্তা ও জনগণের খবর সত্যতার সঙ্গে পৌঁছে দেন। (আল-মাকরিজি, খিতাত, ১/৯৮, দারুস সাদির, কায়রো, ১৮৫৩)
এই যুগে ডাক বিভাগকে ‘দিওয়ানুল খারাইত’ বলা হতো। এমনকি অশান্ত এলাকায় সেনা ও সাহায্য পৌঁছে দিতে ডাকের গাড়ি ব্যবহৃত হতো। তবে বুয়াইহিদের সময়ে ডাকব্যবস্থা দুর্বল হয়। কারণ, তারা খলিফার কাছ থেকে খবর লুকাতে ডাক বন্ধ করে দেয়।
মামলুক যুগ
মামলুক যুগে তাতারদের আক্রমণে বাগদাদ থেকে ডাক বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সুলতান বাইবারস ডাকব্যবস্থাকে নতুন করে সংগঠিত করেন। তিনি শরফুদ্দিন কালকাশান্দিকে ডাক বিভাগের দায়িত্ব দেন এবং নির্দেশ দেন যে তাতার ও ফ্রাঙ্কদের খবর তাৎক্ষণিক পৌঁছাতে হবে।
বাইবারসের জীবনীকার ইবনে শাদ্দাদ লিখেছেন, তিনি খাবার ফেলে রেখেও চিঠির জবাব দিতেন। এতটা গুরুত্ব ছিল ডাকের। (ইবনে শাদ্দাদ, সিরাত সুলতান বাইবারস, পৃষ্ঠা ১২৩, দারুল ফিকর, কায়রো, ১৯৮৩)
দিওয়ানুল বারিদ: কাঠামো ও দায়িত্ব
ইসলামি রাষ্ট্রে ডাক বিভাগ (দিওয়ানুল বারিদ) ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এটি প্রদেশ থেকে রাজধানীতে খবর পৌঁছে দিত, শাসকদের তদারক করত, সেনাবাহিনীর অগ্রগতি, যুদ্ধের খবর, বিদ্রোহ বা গোপন তৎপরতার তথ্য খলিফার কাছে পৌঁছাত। এমনকি কোনো শাসক মারা গেলে তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়োগের জন্যও ডাক ব্যবহৃত হতো।
ডাক বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়োগে কঠোর নীতি অনুসরণ করা হতো। ইবনে কুদামা বলেন, ডাক কর্মকর্তাকে অবশ্যই বিশ্বস্ত হতে হবে, খলিফার কাছে নির্ভরযোগ্য হতে হবে। এই পদের জন্য গভীর পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন ছিল না; বরং বিশ্বস্ততা ও গোপনীয়তা ছিল মূল শর্ত। (ইবনে কুদামা, আল-মুগনি, ১০/৩২৫, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৫)
এ ছাড়া তাঁদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, প্রদেশ ও এর ভাষার জ্ঞান, ঘোড়া ও কবুতরের প্রকৃতি বোঝার ক্ষমতা এবং শত্রুর হাতে ধরা পড়লেও গোপনীয়তা রক্ষার দৃঢ়তা থাকতে হতো।
ডাকবিভাগের কাঠামো
ডাকবিভাগের কাঠামো ছিল সুশৃঙ্খল:
সাহিবুল বারিদ: খলিফা নিজে তাঁকে নিয়োগ করতেন। তিনি খলিফার চিঠি পৌঁছে দিতেন, প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করতেন এবং শত্রু ও শাসকদের খবর সংগ্রহ করতেন। তিনি ছিলেন খলিফার চোখ-কান।
প্রদেশের ডাক কর্মকর্তা: তাঁরা প্রদেশে শাসক ও জনগণের খবর সংগ্রহ করতেন।
ফুরাঙ্কিন: ফারসি শব্দ ‘ব্রঙ্ক’ থেকে এসেছে, যার অর্থ গাইড। তাঁরা ডাক রুট ও কেন্দ্র পরিদর্শন করতেন।
সায়া বা বারিদি: হেঁটে চিঠি বহনকারী দ্রুতগামী দূত।
এজেন্ট ও গোয়েন্দা: প্রদেশে খবর সংগ্রহে সহায়তা করতেন।
রাষ্ট্রদূত: বিদেশি শাসকদের কাছে চিঠি পৌঁছে দিতেন।
ডাক কর্মকর্তাকে অবশ্যই বিশ্বস্ত হতে হবে, খলিফার কাছে নির্ভরযোগ্য হতে হবে। এই পদের জন্য গভীর পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন ছিল না; বরং বিশ্বস্ততা ও গোপনীয়তা ছিল মূল শর্ত।
ডাকের মাধ্যম
ডাক পরিবহনের জন্য বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহৃত হতো:
ঘোড়ার ডাক (ওয়ালাক): প্রতি চার মাইল অন্তর ঘোড়া প্রস্তুত রাখা হতো। প্রথম দিকে উট ব্যবহৃত হলেও ঘোড়ার গতির জন্য এটি জনপ্রিয় হয়। জরুরি সময়ে সেনা পরিবহনেও এটি ব্যবহৃত হতো। ডাক রুটে বিশ্রামাগার ও পানির ব্যবস্থা ছিল।
পায়ে হাঁটা ডাক: বুয়াইহি যুগে দ্রুতগামী দূতরা এ কাজ করতেন। ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে এর বিবরণ দিয়েছেন। (ইবনে বতুতা, রিহলা, পৃষ্ঠা ১৮৫, দারুস সাদির, কায়রো, ১৯০৪)
কবুতরের ডাক: ‘বারিদ মুজান্নাহ’ নামে পরিচিত। প্রশিক্ষিত কবুতরের ডানায় বা লেজে চিঠি বেঁধে পাঠানো হতো। জাহিজ এই কবুতরের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন—তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সতর্কতা, দ্রুত ওড়ার ক্ষমতা। নিরাপত্তার জন্য একই চিঠি দুটি কবুতরে পাঠানো হতো, দুই ঘণ্টার ব্যবধানে। (জাহিজ, কিতাবুল হায়াওয়ান, ৪/১২৭, দারুল জিল, বৈরুত, ১৯৬৬)
ইসলামি সভ্যতায় ডাকব্যবস্থা ছিল রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি। এটি প্রদেশ ও রাজধানীর মধ্যে সেতু তৈরি করত, শত্রু ও বিদ্রোহীদের খবর পৌঁছে দিয়ে রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখত। এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, বিশ্বস্ত কর্মকর্তা ও উন্নত পরিবহনব্যবস্থা ইসলামি সভ্যতার প্রশাসনিক দক্ষতার প্রমাণ।
আজকের ডিজিটাল যুগেও ডাকব্যবস্থার এই ঐতিহ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যোগাযোগ কীভাবে সমাজকে একসূত্রে বাঁধে।