ইসলাম কি কোনো ধর্ম নাকি জীবনবিধান?

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম ইসলাম। ইসলামের বর্তমান অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২০০ কোটি, যা বর্তমান বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ। (‘হোয়াই ইসলাম ইজ দ্য ওয়ার্ল্ড ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং রিলিজিয়ন’, পিউ রিসার্চ সেন্টার, মাইকেল লিপিকা অ্যান্ড কনরড হাসিকেট)

ইসলাম মূলত কী? এটা কি কোনো ধর্ম, নাকি জীবনবিধান? নাকি কোনো দর্শন বা সংস্কৃতি? ইসলাম আরবি শব্দ। মূল ধাতু ‘সিলমুন’ থেকে শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে। কোনো কোনো অভিধানকারের মতে, ইসলামের শাব্দিক অর্থ ‘শান্তি’ ও ‘আত্মসমর্পণ’। (হোয়াট ইসলাম ইজ অল অ্যাবাউট, ইয়াসির ক্বাদি, অনুবাদ: আলী আহমদ মাবরুর, গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ১১৭) কোনো কোনো অভিধানকার বলেছেন, ইসলাম শব্দের বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে আছে ‘অনুগত হওয়া’ বা ‘আনুগত্য করা’, ‘মেনে নেওয়া’, ‘বিনম্র হওয়া’, ‘নিরাপত্তা’ এবং ‘সমর্পণ’ ইত্যাদি।

আরও পড়ুন

শরিয়তের পরিভাষায় ইসলাম হলো, ‘তাওহিদের স্বীকৃতি প্রদান করার মাধ্যমে আল্লাহ–তাআলার কাছে আত্মসমর্পণ করা এবং একমাত্র তাঁর আনুগত্য গ্রহণ করা। বিনাদ্বিধায় তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা এবং তাঁর প্রদত্ত জীবনবিধান অনুসারে জীবন যাপন করা।’ (শারহুল আকাইদিন নাসাফিয়্যা, পৃষ্ঠা ৯১) আর ইসলামি জীবনবিধান মোতাবেক যিনি বা যাঁরা জীবন যাপন করেন, তিনি বা তাঁরা হলেন ‘মুসলিম’। (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ৩৩)

আভিধানিকভাবে ইমানের সম্পর্ক বিশ্বাসের দিকে বা সঙ্গে আর ইসলামের সম্পর্ক কর্মের দিকে বা সঙ্গে। (কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ২৭)

আল্লাহ–তাআলার পক্ষ থেকে মুহাম্মদ (সা.) অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে আদর্শ ও বিধিবিধান নিয়ে এসেছেন, তা মনে-প্রাণে বিশ্বাস ও অনুসরণ করার নাম ইসলাম (কাওয়াইদুল ফিকহ, মুফতি আমীমুল এহসান, পৃষ্ঠা ১৭৭)

আরও পড়ুন

আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘বলুন! আমার নামাজ, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও মরণ জগৎসমূহের মালিকের উদ্দেশ্যে। তাঁর কোনো শরিক নেই। আর আমি এ জন্যই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম মুসলিম।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৬২-১৬৩)

ইসলামের সংজ্ঞা বা পরিচয়ের বিষয়টি সবচেয়ে সহজভাবে বিখ্যাত হাদিসে জিব্রাইল থেকে পাওয়া যায়। হজরত জিব্রাইল (আ.) একবার মানুষের বেশে উপস্থিত হয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, হে মুহাম্মদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন! রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ–তাআলা ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ বা ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল—এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা, নামাজ কায়েম করা, জাকাত আদায় করা, রমজান মানে রোজা রাখা এবং সামর্থ্যবানের জন্য হজ পালন করা, এটাই হলো ইসলাম।’ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উত্তর শুনে জিব্রাইল (আ.) বললেন, ‘আপনি সত্য বলেছেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৮)

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণনায় আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। স্তম্ভগুলো হলো—১. আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ বা ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল, এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা। ২. নামাজ কায়েম করা। ৩. জাকাত আদায় করা। ৪. রমজান মাসে রোজা রাখা এবং ৫. সামর্থ্য হলে হজ পালন করা। (মুসলিম, হাদিস: ১৬)

আরও পড়ুন

ইসলাম আল্লাহ–তাআলার পক্ষ থেকে নাজিল হওয়া একমাত্র মনোনীত ও চূড়ান্ত বা পরিপূর্ণ ধর্ম। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম কেউ গ্রহণ করতে চাইলে তা কবুল বা গ্রহণযোগ্য হবে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ–তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘ইসলাম আল্লাহ–তাআলা কর্তৃক মনোনীত একমাত্র দ্বীন বা ধর্ম।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯)

এ ব্যাপারে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৩)

প্রসিদ্ধ তাফসির–বিশারদ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘এই আয়াত পবিত্র কোরআন নাজিলের শেষ দিককার আয়াত। এরপর বিধিবিধান–সম্পর্কিত আর কোনো আয়াত নাজিল হয়নি। হজরত আদম (আ.)-এর যুগ থেকে যে সত্য ধর্ম ও খোদায়ি নিয়ামতের অবতরণ ও প্রচলন শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তী প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক ভূখণ্ডের অবস্থা অনুযায়ী আদম সন্তানের মধ্যে নিয়ামত বণ্টনের যে ধারা অব্যাহত ছিল, আজ সে নিয়ামত ও ধর্ম পরিপূর্ণ আকারে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর উম্মতকে প্রদান করা হলো।’ (তাফসীরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফী, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা ৩০৯)

আরও পড়ুন

পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল হবে না। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫)

বস্তুত ইসলাম সব নবী-রাসুলের অভিন্ন ধর্ম। প্রথম নবী আদম (আ.) থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সবাই এ ধর্ম বা জীবনবিধানের দিকে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন। (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ৩৩) মোট কথা, আল্লাহর প্রেরিত সব নবী-রাসুলের প্রচারিত ধর্মে মৌলিকভাবে কোনো পার্থক্য ছিল না। তবে প্রত্যেক নবী-রাসুলকে আলাদা বা ভিন্ন শরিয়ত দান করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ–তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা শরিয়ত ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি। (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৪৮)

হজরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বপ্রথম নিজ ধর্মকে ‘ইসলাম’ নামে এবং তাঁর অনুসারীদের ‘উম্মতে মুসলিমা’ নামকরণে অভিহিত করেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের মিল্লাত। তিনি আগে তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৭৮)

আরও পড়ুন

ইসলামই মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। দ্বীনে ফিতরাত বা সহজাত জীবনবিধান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক শিশু স্বভাবসুলভ সহজাত প্রকৃতির (ইসলামের) ওপর জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার পিতামাতা তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান বা আগুনপূজারি বানায়। (বুখারি, হাদিস: ১৩৫৮)

হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন নবী-রাসুলের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের যে ধারা যুগে যুগে অনুসৃত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে সে ধারার পরিপূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটেছে। তিনিই সর্বশেষ নবী। আখেরি রাসুল। তারপরে আর কোনো নবী বা রাসুলের আগমন এ ধরাতে ঘটবে না এবং তাঁর মাধ্যমে পূর্ববর্তী সব নবী-রাসুলের শরিয়ত বা জীবনবিধান রহিত হয়েছে। সুতরাং বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে—কিয়ামত পর্যন্ত ইসলাম বলতে রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক আনীত দ্বীন তথা জীবনবিধানকে বোঝা হবে। (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ৩৪)

মিরাজ রহমান: লেখক ও গবেষক

আরও পড়ুন