আল্লামা শিবলি নোমানির ভাবনায় আধুনিক শিক্ষা
১৮৫৭ সালের ৪ জুন ভারতের আজমগড়ের বান্দলে জন্ম নেন দেওবন্দি মতাদর্শের প্রসিদ্ধ আলেম আল্লামা শিবলি নোমানি (রহ.)। ১৮ নভেম্বর ১৯১৪ সালে তাঁর ইন্তেকাল হয়৷ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ: ২/৩৮৩–৩৮৪)
এত সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি যে অসাধারণ কাজ করেছেন, তা বর্ণনাতীত। তিনি সর্বাঙ্গীণ প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন। সাহিত্য, ইতিহাস, জীবনী, গবেষণা–সমালোচনা এবং শিক্ষা ও ধর্ম প্রচার—যেকোনো ক্ষেত্রে তিনি যুগশ্রেষ্ঠ ছিলেন। তাঁর জ্ঞানচর্চা ও জাতীয় সেবা এর প্রমাণ। তিনি মুসলমানদের শিক্ষাকে অত্যন্ত জরুরি মনে করতেন।
শিবলি নোমানি তাঁর যুগের মুসলমানদের শিক্ষার প্রতি উদাসীনতা দেখে ভীষণ চিন্তিত ছিলেন। তাঁর রচনায় মুসলমানদের অতীত শিক্ষার মাধ্যমে তাদের সোনালি যুগের কৃতিত্ব স্মরণ করিয়ে দেন—কীভাবে তারা জ্ঞান ছড়িয়েছিল, কোন কোন বিদ্যা উদ্ভাবন করেছিল এবং কীভাবে তা উচ্চতায় পৌঁছেছিল। (বিপান চন্দ্র, হিস্ট্রি অব মডার্ন ইন্ডিয়া, পৃ. ৩২২–৩২৩)
নারীর জন্য শিক্ষা
সমগ্র জীবনে তিনি শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত ছিলেন। তবে তিনি শুধু লেখালেখিই করেননি, মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রতি উদ্দীপনা ছড়িয়েছেন। তাঁর শিক্ষাভাবনা এত বিস্তৃত ছিল, তিনি নারীদের উচ্চশিক্ষারও প্রবল সমর্থক ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে এমন একটি পাঠ্যসূচি হওয়া উচিত, যা ছেলেমেয়ের জন্য সমান।
একবার এক চিঠিতে মাওলানা হাবিবুর রহমান খান শেরওয়ানিকে তিনি লিখেছিলেন যে তিনি মুম্বাইয়ে নারী শিক্ষার বিস্ময়কর উদাহরণ দেখেছেন। রোম, মিশর ও সিরিয়া ভ্রমণের সময় তুরস্কে নারীর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দেখে তিনি তুর্কি জনগোষ্ঠীর প্রশংসা করেন। (আল্লামা সাইয়িদ সুলাইমান নদভি, মাকালাতে শিবলী: ৮/৭৮)
মুসলমানদের জন্য কেবল ইংরেজি শিক্ষা যথেষ্ট নয়, ঠিক তেমনি শুধু প্রাচীন আরবি মাদ্রাসার শিক্ষা পুরোপুরি সঙ্গী হতে পারে না। আমাদের রোগের চিকিৎসা হলো একটি সংমিশ্রণ।আল্লামা শিবলি নোমানি (রহ.)
আধুনিক শিক্ষার অনুরাগী
তাঁর বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল শিক্ষা ও ধর্ম। তিনি শিক্ষাবিজ্ঞানে গভীর মনোযোগী ছিলেন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লক্ষ্ণৌর নদওয়াতুল ওলামার শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি বিপুল ত্যাগ ও সাধনা করেছিলেন। কেবল ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে নয়; বরং তিনি সারা বিশ্বে ইসলামের শিক্ষাগত চাহিদা ও অবস্থা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।
প্রাচীন শিক্ষাপন্থাকে তিনি সমর্থন করলেও আধুনিক বিজ্ঞান ও শিক্ষার কার্যকর বিষয়গুলোও গ্রহণ করেন। (বারবারা মেটকাফ, ইসলামিক রিভাইবল ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া–দেওবন্দ: পৃ. ৩৪১–৩৪২)
নদওয়ায় দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তিনি আদ–দুরুসুল উলা ফিল ফালসাফাতিত তাবিয়্যাহ পাঠ্য করেন, যা ১৮৮২ সালে বৈরুত থেকে প্রকাশিত খ্রিষ্টান পণ্ডিত জ্যাকসনের লেখা। এতে পদার্থবিদ্যা, গতি, মহাকর্ষ, তরল, অপটিকস, বিদ্যুৎপ্রবাহ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি বইটি পড়ানোর জন্য আল্লামা মুহাম্মদ হামিদুদ্দিন ফারাহি ও মির্জা মুহাম্মদ হাদি রসওয়াকে নিযুক্ত করেন।
১৯০১ সালে তিনি নদওয়ায় মাত্র ১৫ রুপি মাসিক বেতনে একজন ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগ করেন। এখান থেকে ইংরেজি শিখেই মাওলানা আবদুল বারি নদভি অনেক আধুনিক দর্শনের বই অনুবাদ করতে সক্ষম হন।
১৯০১ সালে তিনি নদওয়ায় মাত্র ১৫ রুপি মাসিক বেতনে একজন ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগ করেন। এখান থেকে ইংরেজি শিখেই মাওলানা আবদুল বারি নদভি অনেক আধুনিক দর্শনের বই অনুবাদ করতে সক্ষম হন।
শিবলির এ পাঠ্য উদ্যোগ ছিল এক বিপ্লবী পদক্ষেপ। যদিও ১৯১৩ সালে তিনি পদত্যাগ করার পর এ বইগুলো পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়া হয়।
প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়
তাঁর নিজের শিক্ষা অর্জন হয়েছিল প্রাচীন ধাঁচের মাদ্রাসায়। তিনি তাঁর সময়ের জ্ঞানী ও দক্ষ ব্যক্তিদের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। আধুনিক শিক্ষিত ব্যক্তিদের সঙ্গেও সম্পর্কিত ছিলেন। তাই আধুনিক শিক্ষার ভাবনা ও নীতিগুলো তাঁর কাছে অপরিচিত ছিল না।
তিনি মুসলমানদের প্রাচীন শিক্ষার ইতিহাস, পাঠ্যক্রম সংস্কার ও পরিবর্তনের বিস্তারিত অধ্যয়ন করেছিলেন। এ ছাড়া আধুনিক শিক্ষার নতুন প্রবণতা ও ধারা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষার সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা বোঝেন এবং তা সমন্বয়ের চিন্তাভাবনা করতেন। তিনি চাইতেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্ভাবনী চিন্তা ও উদ্যোগের মানসিকতা তৈরি করবে।
যারা প্রাচীন শিক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে অপ্রয়োজনীয় মনে করত, তারা তাঁর মতের সঙ্গে একমত ছিল না। ফলে তিনি ‘প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এতে তিনি আধুনিক শিক্ষিত গোষ্ঠীকে প্রত্যাখ্যান করেন, যারা প্রাচীন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন না।
তাঁর মূল বক্তব্য ছিল, মুসলিম জাতির অস্তিত্ব ধর্মের ওপর নির্ভরশীল। ধর্ম ছাড়া জাতি সুরক্ষিত থাকবে না। যেহেতু ধর্ম অপরিহার্য, তাই প্রাচীন শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে ধর্মীয় শিক্ষা না হলে, তা সম্ভব নয়।
যদি কেউ বলত, ধর্মীয় শিক্ষা প্রয়োজন, তবে তা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি; শিবলি বলতেন, এমন শিক্ষা দিয়ে পবিত্র কোরআন–হাদিস রক্ষা করা সম্ভব নয়৷ এমন শিক্ষিতরা ইসলামের জটিল সমস্যা ব্যাখ্যা করতে পারবে না।
তাঁর মতে, ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাসে উত্থাপিত সমালোচনার উত্তর দিতে গভীর জ্ঞান দরকার। (আল্লামা সাইয়িদ সুলাইমান নদভি, হায়াতে শিবলি: পৃ. ৩০৪)
সফরনামা: রোম, মিশর ও শাম
শিবলীর ভ্রমণদর্শন সফরনামা: রোম, মিশর ও শাম আদতে একটি শিক্ষা প্রতিবেদন। এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, তিনি কেমন ধরনের শিক্ষা চান। শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বের মুসলিম জাতির শিক্ষাব্যবস্থা তাঁর নজরে ছিল। তিনি শুধু প্রাচীন শিক্ষাবন্দী নন, নিজেকে নতুনত্বের প্রতি অন্যভাবে সংবেদনশীল রাখতে চেয়েছেন। আধুনিক ও প্রাচীন শিক্ষাগুলোর সংমিশ্রণ চেয়েছেন।
তিনি বিশ্লেষণ করেন, আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা একমাত্র আমাদের রোগমুক্তি করতে পারবে না, ঠিক তেমনি প্রাচীন শিক্ষাও এককভাবে আমাদের সমস্যার সমাধান হতে পারে না।
তাঁর ভাষায়, ‘আমরা বারবার বলেছি, মুসলমানদের জন্য কেবল ইংরেজি মাদ্রাসার শিক্ষা যথেষ্ট নয়, ঠিক তেমনি শুধু প্রাচীন আরবি মাদ্রাসার শিক্ষা পুরোপুরি আমাদের সঙ্গী হতে পারে না। আমাদের রোগের চিকিৎসা হলো একটি সংমিশ্রণ। একটি দিক প্রাচ্যের (মূল), অন্য দিক পশ্চিমের (আধুনিক)।’ (আল্লামা সাইয়িদ সুলাইমান নদভি, মাকালাতে শিবলি: ৩/৫৭)
তিনি তুর্কির শিক্ষাব্যবস্থা, লেখক, গ্রন্থাগার, পত্রিকা এবং নীতিবিদ ও ধর্মানুরাগীদের অবস্থা বিশ্লেষণ করেন। তারপর মন্তব্য করেন, ‘সারা ইসলামি বিশ্বে শিক্ষাব্যবস্থা এতই নিম্নতর হয়ে গেছে যে কয়েকটি পাঠ্যবই ছাড়া মানুষ আধুনিক জ্ঞানে আকৃষ্ট হয় না। ফলে উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।’ (আল্লামা সাইয়িদ সুলাইমান নদভি, মাকালাতে শিবলি: ৩/৫৮)
মক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন
১৫ এপ্রিল ১৯১৩ সালে দৈনিক ‘জমিনদার লাহোর’ পত্রিকায় শিবলি নোমানি মক্কার উদ্দেশে একটি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও মাওলানা আজাদ ও অন্য অগ্রগণ্যরা তাঁর প্রস্তাবকে সমর্থন করেন।
তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার মতে, সর্বাগ্রে একটি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মক্কায় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। সেখানে ধর্মীয় ও আধুনিক বিজ্ঞানসহ সব ধরনের উচ্চশিক্ষা দেওয়া হবে। কারণ, সব ধরনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পারদর্শী হলে কোনো জাতি বাঁচতে পারবে।’ (মাআরিফ, নভেম্বর ২০১৩, পৃ. ৩৮৪)
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টি মক্কায় প্রতিষ্ঠা কেন চান, তার বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, ‘মক্কা হলো মুসলমানদের কেন্দ্র এবং প্রত্যেক মুসলমান সেখানেই উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে উৎসাহিত হবে। এ ছাড়া ওই এলাকার প্রচুর তহবিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিতে পারে। হাজিরা যদি মাত্র ১০ রুপি দান করে, তবু তা লাখে পৌঁছাবে।’
তিনি আরও যুক্তি দেন, ‘ওই এলাকায় একটি উন্নত গ্রন্থাগার আছে এবং আবহাওয়ার দিক থেকেও শিক্ষক–ছাত্রদের জন্য উপযোগী।’ তিনি লিখেছেন, ‘আমার ইচ্ছা, ভারতের সব স্থান ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন করি, তারপর মক্কায় গমন করি এবং ওই মহান বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজ করি।’ (জমিনদার, ১৫ এপ্রিল ১৯১৩)
তাঁর মতে, শিক্ষাদান হবে লেকচার বা বক্তৃতার মাধ্যমে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো দক্ষতা অর্জন। একাধিক বিষয় শেখার ক্ষেত্রে প্রাচীন বিষয়ের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষাদানের পদ্ধতি ও পাঠ্যক্রম
শিবলী প্রাচীন শিক্ষাকে পছন্দ করতেন। তাঁর মতে, শিক্ষাদান হবে লেকচার বা বক্তৃতার মাধ্যমে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো দক্ষতা অর্জন। একাধিক বিষয় শেখার ক্ষেত্রে প্রাচীন বিষয়ের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
পাঠ্যক্রমে শুধু ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা নয়, অন্যান্য মুসলিম দেশের পাঠ্যক্রমকেও তিনি অপ্রতুল মনে করতেন। যদিও তিনি প্রকাশ্যভাবে ‘দরসে নেজামি’কে প্রাচীন পাঠ্যক্রমের চেয়ে প্রাধান্য দিতেন।
শিক্ষাগত অভিজ্ঞতা ও মুসলিম শিক্ষার ইতিহাস বোঝার কারণে তিনি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে সংস্কার ও পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিভাগের পাঠ্যক্রমেও তিনি পরিবর্তনের প্রয়োজন মনে করতেন।
নদওয়া সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘ইসলামে শিক্ষার শুরু থেকে শিক্ষাদানের পদ্ধতি কেমন ছিল, পাঠ্যক্রম কেন পরিবর্তিত হয়েছে, বিভিন্ন বিদ্যার প্রচলন কীভাবে ঘটেছে, দরসে নেজামি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বর্তমান পাঠ্যক্রমের কী কী ত্রুটি রয়েছে, সেগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’ (আল্লামা সাইয়িদ সুলাইমান নদভি, মাকালাতে শিবলি: ৩/৪৬–৪৭)
তাঁর মতে, ধর্ম ও আধুনিক জ্ঞান উভয়ই অপরিহার্য। শুধু প্রাচীন শিক্ষা নয়, শুধু আধুনিক শিক্ষা নয়, মিশ্রণই সমাধান। (সফরনামা: রোম, মিশর ও শাম: পৃ. ৫৬)
যদি তাঁর পাঠ্যসংক্রান্ত সংস্কারগুলো তখনই গ্রহণ করা হতো, আজকের শিক্ষা পরিসর সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যেত। যদি ১০০ বছর আগে নদওয়া তাঁর পাঠ্যসূচি গ্রহণ করত, তাহলে আজ ভারতবর্ষের মাদ্রাসাগুলোর সুন্দর ইতিহাস ও স্বাতন্ত্র্য থাকত।