দুর্ভিক্ষের সময় খলিফা উমর (রা.)-এর মানবিক নেতৃত্ব

ছবি: পিক্সেলস

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর খিলাফতকালে ১৮ হিজরিতে আরবদের এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যা ইতিহাসে ‘আমুর রামাদা’ বা ‘ধূসর বর্ষ’ নামে পরিচিত। এই দুর্যোগ ছিল এক জাতিবিধ্বংসী বিপর্যয়, যা আরবের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি এবং সমাজব্যবস্থাকে প্রায় স্থবির করে দিয়েছিল।

১৮ হিজরিতে মদিনা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে দীর্ঘ অনাবৃষ্টির কারণে ভয়াবহ খরা দেখা দেয়। ফসল উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায় এবং ভূমি শুকিয়ে ধূসর বা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। এই মাটিকে বালির চেয়ে ছাইয়ের মতো মনে হতো, যা উত্তপ্ত মরুভূমির বাতাসে উড়ে বেড়াত। এ কারণেই বছরটিকে ‘ধূসর বর্ষ’ বা ‘আমুর রামাদা’ নাম দেওয়া হয়।

দুর্ভিক্ষের তীব্রতা এতটাই ছিল যে, মানুষের জীবন যায় যায় অবস্থা। গ্রামাঞ্চলের লোকেরা সামান্য খাবারের আশায় মদিনার খিলাফতকেন্দ্রে ভিড় জমাতে শুরু করে। পেটের ক্ষিধের কারণে তাদের মুখ থেকে ঠিকমতো কথাও বেরোচ্ছিল না। সমাজের এই চরম দুরবস্থা স্বয়ং খলিফার ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব ফেলে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে, জঙ্গলের হিংস্র প্রাণীরাও ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে লোকালয়ে চলে আসে। (তাফসিরে ইবনে কাসির : খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৯০)

দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্যসংকট কতটা চরম ছিল, এই ঘটনাটি তারই প্রমাণ। মুজায়না গোত্রের এক লোক তার পরিবারের অনুরোধে একটি বকরি জবাই করে। সে প্রথমে বকরি জবাই করতে রাজি ছিল না, কারণ সে জানত বকরির গায়ে মাংস বলতে কিছু নেই। জবাইয়ের পর দেখা গেল, চামড়ার নিচে হাড়গোড় ছাড়া আর কিছুই নেই।

রাতের বেলা মদিনায় টহল দিতে বেরিয়ে খলিফা কোথাও কোনো হাসি বা শব্দ শুনতে পেতেন না, বিরাজ করত এক আশ্চর্য নীরবতা। মুসলিম সমাজের এই অসহায়ত্ব উমর (রা.)-এর দুশ্চিন্তা বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছিল। (তারিখে তাবারি : খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা- ৯৮)

আরও পড়ুন

আমুর রামাদার সময় খলিফা উমর (রা.) যে নেতৃত্ব ও মানবিকতা প্রদর্শন করেছিলেন, তা রাষ্ট্রনায়কদের জন্য চিরন্তন আদর্শ হয়ে আছে। উমর (রা.) প্রথমে নিজের জীবনে কৃচ্ছ্রসাধন করেন। এখনকার শাসকদের মতো নিজের বিষয়ে কোনো আপস করেননি। মেকি দরদ না দেখিয়ে তিনি শপথ নেন, পুরো রাষ্ট্রের সকল নাগরিক খেয়ে তৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনিও কোনো দানাপানি মুখে তুলবেন না। ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে তাঁর পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত খাবার থাকা সত্ত্বেও তিনি তা ভোগ করেননি।

স্বাভাবিক খাবার (ঘি, দুধ ও রুটি) ত্যাগ করে তিনি কেবল যাইতুন ও সিরকাজাতীয় খাবার খেয়ে নয়টি মাস পার করেন। ফলস্বরূপ তাঁর গায়ের রং কালো হয়ে যায় এবং স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগে শরিক না হলে তিনি তাদের কষ্ট বুঝতে পারবেন না। তাঁর এই ত্যাগ ছিল মূলত নেতৃত্বের একটি শক্তিশালী ঘোষণা—বিপর্যয়ের সময় শাসক জনগণের পাশে আছেন, তাদের দুঃখের সমভাগী।

দুর্ভিক্ষের এ সময়টায় তিনি বায়তুলমাল ও সম্পদের দ্রুত ব্যবহার করেন। কালক্ষেপণ না করে তাৎক্ষণিকভাবে জনগণের জন্য বায়তুলমাল উন্মুক্ত করে দেন। খাদ্য ও সম্পদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সামান্য কার্পণ্য করেননি। তাঁর এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ জনগণের এবং জনগণের বিপদের সময় তা নিঃসংকোচে ব্যয় করাই শাসকের দায়িত্ব।

দুর্ভিক্ষ দীর্ঘস্থায়ী হলে সাহাবিরা উমর (রা.)-কে ইসতিস্কা তথা বৃষ্টি প্রার্থনার নামাজ আদায়ের পরামর্শ দেন। উমর (রা.) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘বিপদ চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছার পরই কি এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া হলো?’ এরপর তিনি মুসলিমদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে সালাতুল ইসতিস্কা আদায় করেন এবং কায়মনোবাক্যে দুআ করেন, ‘হে আল্লাহ, আমি সঙ্গীদের সহযোগিতায় অপারগ হয়ে গেছি। আমাদের শক্তি-সামর্থ্য শেষ হয়ে গেছে। আপনার শক্তি ও সহায়তা ছাড়া এখন আর আমাদের বাঁচার উপায় নেই। আল্লাহ, আপনি বৃষ্টি বর্ষণ করুন।’ আল্লাহ তাঁর দুআ কবুল করেন এবং নামাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মদিনার চৌবাচ্চাগুলো পানিতে ভরে ওঠে। (তাফসিরে ইবনে কাসির : খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৯১)

তবে বৃষ্টি এলেও তাৎক্ষণিক খাদ্যসংকট দূর হয়নি। তাই উমর (রা.) দূরদর্শী কিছু কৌশল গ্রহণ করেন। যেমন, তিনি তাৎক্ষণিক খাদ্য সহায়তার জন্য বসরা, মিসর ও শামের মুসলিম গভর্নরদের কাছে চিঠি পাঠান। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.) ৪ হাজার সওয়ারি বোঝাই খাদ্য পাঠান।

আরও পড়ুন

আমর ইবনুল আস (রা.) কৌশলগতভাবে লোহিত সাগরের একটি পুরোনো খাল সংস্কার করে জলপথে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করেন। এতে মদিনায় খাদ্যের মূল্য মিসরের মতো সহনীয় হয়ে আসে। মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) এবং সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.)-ও হাজার হাজার উট বোঝাই খাদ্য ও বস্ত্র পাঠিয়েছিলেন। (আত তাবাকাত, ইবনে সাদ : খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩১৫)

উমর (রা.) লক্ষ করেন, সবাই মদিনায় চলে আসায় রাজধানীতে চাপ বাড়ছে এবং সংকট দ্বিগুণ হচ্ছে। তিনি জনগণকে ধৈর্যের সঙ্গে যার যার স্থানে থাকার আহ্বান জানান। তিনি চাননি, রাজধানীতে ভিড় জমার কারণে অন্য কোনো সামাজিক বা নিরাপত্তাজনিত সংকট তৈরি হোক। ফলে তিনি তাদেরকে আশ্বস্ত করেন, সবার কাছেই খাবার পৌঁছে যাবে।

খলিফা ত্রাণ বণ্টনের জন্য বিশেষ লোকবল নিয়োগ করেন এবং তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন। তাঁর নির্দেশ ছিল, যে খাদ্যসামগ্রী ও জরুরি সম্পদ আমাদের হাতে এসেছে, সেগুলো গ্রাম এলাকায় যথাযথভাবে বণ্টন করে দাও। তৈরি আটাগুলো তাদের হাতে দাও, যেন কিছু বানিয়ে আপাতত পেট বাঁচাতে পারে। (আত তাবাকাত, ইবনে সাদ : খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা- ১৬-১৭)

তিনি খাদ্যসামগ্রী (খেজুর, আটা, চামড়া) একবারে বিলিয়ে না দিয়ে পরিবার ও সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী অঞ্চলভিত্তিক মাসিক সরবরাহের কৌশল নেন, যা রাষ্ট্রীয় তহবিলের ওপর চাপ কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ত্রাণ কার্যক্রম নিশ্চিত করেছিল।

আমুর রামাদায় উমর (রা.)-এর সবচেয়ে প্রশংসনীয় আরেকটি সিদ্ধান্ত ছিল, তিনি সেই বছরের জাকাত মওকুফ করে দেন। যাকাত ফরজ হলেও এই চরম দুর্দশার সময় তিনি জনগণের ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ বাড়াতে চাননি। পরে যখন সুদিন ফিরে আসে এবং অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়, তখন তিনি সক্ষম ব্যক্তিদের কাছ থেকে একসঙ্গে দুই বছরের যাকাত সংগ্রহ করেন। এক নিসাব ওই বছরের দরিদ্রদের জন্য এবং অন্য নিসাব বায়তুল মালের ক্ষতিপূরণের জন্য। এই নীতি সংকটাপন্ন মানুষের উপকার যেমন করেছিল, তেমনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারকেও পূর্ণ করেছিল।

দুর্ভিক্ষ কেটে গেলে খলিফা উমরের গোলাম একদিন বাজারে গিয়ে দেখতে পায় প্রচুর ঘি ও দুধ উঠেছে। সে তখন ৪০ দিরহাম দিয়ে কিছু দুধ ও ঘি কিনে এনে খলিফার সামনে উপস্থাপন করে। উমর বলেন, ‘তুমি খুব মূল্যবান জিনিস নিয়ে এসেছ। এগুলো কাউকে দান করে দাও। আমি খাবার গ্রহণে বিলাসিতা একদম পছন্দ করি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ যে সংকটে আছে, আমি যদি সেই সংকটে না পড়ি, তাহলে সেটা কীভাবে বুঝব?’ (তারিখে তাবারি : খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৯৮)

আমুর রামাদার ঘটনা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য ইসলামে নীতি হলো, শাসককে অবশ্যই মানবিক হতে হবে। বিপদ-দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। দুর্যোগের কারণ যা-ই হোক না কেন, আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ তাওবা-ইসতিগফার এবং সম্মিলিত দুআ-প্রার্থনা করতে হবে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের দোরগোড়ায় ত্রাণ পৌঁছে দিতে কৌশলীও হতে হবে। চরম সংকটে বায়তুলমাল বা রাজকোষ দ্রুত ও নিঃসংকোচে জনসাধারণের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। যাকাত বা করের মতো আর্থিক বাধ্যবাধকতা পরিস্থিতিতে সাময়িক ছাড় দেওয়া এবং সুদিন ফিরে এলে ক্ষতিপূরণ বা পুনরুদ্ধারের কৌশল গ্রহণ করতে হবে।

আরও পড়ুন