আজকের পৃথিবী এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আমাদের শিল্প ও কর্মসংস্থানকে আমূল পরিবর্তন করে দিচ্ছে, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা জাগাচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দার মেঘ ঘনিয়ে আসছে—আধুনিক জীবনের এই চিরায়ত ভয়গুলো মানুষকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করছে।
অনেকেই এই উদ্বেগে বিচলিত, কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যারা এই সব কিছুর মধ্যেও আশ্চর্যরকম শান্ত ও অবিচল। তাদের এই স্থিরতা কোনো নির্বোধ আশাবাদ বা সরলতা থেকে আসে না। বরং এর উৎস আরও গভীরে। এটি হলো আত্মার এমন এক কৌশল, যা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আঘাত থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখে।
ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের অধিকাংশ দুশ্চিন্তার মূলে রয়েছে একটি সুপ্ত ভ্রান্তি: যে বিষয়গুলোর ওপর আমাদের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ নেই, সেগুলোর ফলাফলও আমাদেরকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা হলো, এই পার্থিব জীবনে একটিমাত্র বিষয়ই নিশ্চিত, আর তা হলো এর চরম অনিশ্চয়তা।
দুনিয়ার নিয়মই হলো পরিবর্তনশীলতা। তাই ‘কীভাবে অনিশ্চয়তাকে দূর করা যায়, তা নয়’ বরং প্রশ্নটি হওয়া উচিত ছিল, কীভাবে এই অনিশ্চয়তার মাঝেই সুস্থির ও সতেজ থাকা যায়।
দুনিয়ার নিয়মই হলো পরিবর্তনশীলতা। তাই ‘কীভাবে অনিশ্চয়তাকে দূর করা যায়, তা নয়’ বরং প্রশ্নটি হওয়া উচিত ছিল, কীভাবে এই অনিশ্চয়তার মাঝেই সুস্থির ও সতেজ থাকা যায়।
এই প্রসঙ্গে, আমাদের নবীজি প্রায়শই তাহাজ্জুদ নামাজের শুরুতে একটি শক্তিশালী দোয়া করতেন, যা সমস্ত অনিশ্চয়তাকে ছিন্ন করে এক চরম সত্যের সঙ্গে আত্মাকে গেঁথে দেয়, “হে আল্লাহ, তুমিই সত্য, তোমার কথাই সত্য, তোমার সাথে সাক্ষাৎ সত্য, জান্নাত সত্য এবং জাহান্নাম সত্য...” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩১৭)
এই দোয়াটির দিকে লক্ষ করুন। এটি আমাদের এমন এক ভিত্তির সঙ্গে যুক্ত করে যা অপরিবর্তনশীল ও চিরন্তন। যখন দুনিয়ার সবকিছু আমাদের চোখের সামনে বদলে যেতে পারে, তখন এই চিরন্তন সত্যগুলিই হয়ে ওঠে আমাদের স্থিরতার মূল কেন্দ্র।
পার্থিব চিন্তা যেখানে মনে করে, জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য নিশ্চয়তা (Certainty) আবশ্যক, সেখানে এই দোয়াটি আমাদের শেখায়—জগত-সৃষ্টিকর্তার স্থায়ী সত্যগুলোর মধ্যেই জীবনের স্থায়িত্ব ও শান্তি খুঁজে নিতে হয়। বস্তুত, এই চিরন্তন সত্যের উপলব্ধিতেই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত।
স্থিরতার তিন স্তম্ভ
ইসলাম আমাদের জীবনে এমন কিছু স্তম্ভ তৈরি করে দেয়, যা ভবিষ্যতের ঝড়-ঝাপটার মধ্যে আত্মার ভিত্তি মজবুত রাখে:
১. আল্লাহর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ: আপনার শিল্প খাত এআই দ্বারা কতটা প্রভাবিত হলো বা আপনার জীবনের গতিপথ কী হলো—এই সব কিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ সর্বদা নিরঙ্কুশ এবং পরম। কোনো পার্থিব পরিবর্তনই তাঁর সার্বভৌমত্বকে এতটুকু স্পর্শ করতে পারে না।
২. আখেরাতের চূড়ান্ত গন্তব্য: ভূ-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা যাই হোক না কেন, কেয়ামতের দিন (বিচার দিবস) আপনার চূড়ান্ত গন্তব্যকে নিশ্চিত করে দেয়। এই বিশ্বাস আমাদের বর্তমান কর্ম ও মননে এক ধরনের জরুরি নির্দেশনা তৈরি করে।
৩. জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য: আপনার কর্মজীবনের পথ যতই ঘোলাটে হোক না কেন, জীবনের মূল উদ্দেশ্য—আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁর সৃষ্টির সেবা করা—সর্বদা স্বচ্ছ ও স্ফটিকের মতো পরিষ্কার। (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ৫৬)
এই চিরন্তন সত্যগুলো কেবল ধারণাগতভাবে উপলব্ধি করা যথেষ্ট নয়; এটিকে প্রতিদিনের জীবনে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এই পুনঃঅভিমুখীকরণ আমাদের অনিশ্চয়তা মোকাবিলার ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে সাহায্য করে।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরাও উদ্বেগ মোকাবিলার জন্য ‘মাইন্ডফুলনেস’ ও ‘গ্রাউন্ডিং টেকনিকস’-এর কথা বলেন, যা এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের চেতনার সঙ্গে প্রায়শই মিলে যায়।
কীভাবে নিজেকে স্থির রাখবেন
১. নামাজ একটি প্রয়োজনীয় বিরতি
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ কেবল একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি আমাদের জীবনের সবচেয়ে জরুরি বিরতি (Pause)। কোনো খারাপ খবর বা বড় চ্যালেঞ্জ সামনে আসার পর যখন মানুষ ভয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে, তখন নামাজ আমাদের বাধ্য করে থামতে এবং এই স্থায়ী সত্যগুলোর সঙ্গে পুনরায় নিজেদেরকে সারিবদ্ধ করতে।
আল্লাহর সঙ্গে এই পরামর্শের পরে নেওয়া পদক্ষেপগুলো হয় সুচিন্তিত, পরিমিত—কোনো প্যানিক-নির্ভর বা আতঙ্ক-চালিত পদক্ষেপ নয়।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরাও উদ্বেগ মোকাবিলার জন্য ‘মাইন্ডফুলনেস’ ও ‘গ্রাউন্ডিং টেকনিকস’-এর কথা বলেন, যা এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের চেতনার সঙ্গে প্রায়শই মিলে যায়। নামাজি ব্যক্তি প্রতিটি সালাতে নিজেকে বিশ্বজগতের কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে আখেরাতের দিকে মনোনিবেশ করে।
যেমন দেখুন, “নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।” (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৪৫)
এই আয়াত প্রমাণ করে, নামাজ কেবল দৈহিক ইবাদত নয়; এটি আত্মার পরিশুদ্ধি ও মন-মানসিকতার স্থিতিশীলতা বিধানের একটি প্রক্রিয়া।
২. কোরআনের নীতি আধুনিক সমস্যার পথপ্রদর্শক
যখন আমরা কোনো নৈতিক বা জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হই, তখন আমাদের প্রয়োজন একটি শক্তিশালী কাঠামো। কোরআন এমন একটি কাঠামো যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয় না।
এটি এমন এক গ্রন্থ, যা উম্মাহকে মঙ্গোল আক্রমণ, ক্রুসেড এবং ইতিহাসের অন্য সব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে পথ দেখিয়েছে। এই গ্রন্থটি ভবিষ্যতেও আমাদের পথ দেখাবে।
কোরআন আমাদের শেখায় নীতি-ভিত্তিক জীবন (Principle-Based Life)। উদাহরণস্বরূপ, অর্থনৈতিক অস্থিরতা এলে কোরআন সুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নৈতিক অর্থনীতির প্রতি নির্দেশ দেয়। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৫-২৭৯)
এ ধরনের নীতিগত নির্দেশনাগুলো প্রতিটি আধুনিক সমস্যা মোকাবিলার জন্য এক মৌলিক ও মজবুত ভিত্তি তৈরি করে। অর্থাৎ, কোরআন আমাদের শুধু সমস্যার সমাধান দেয় না, বরং সমস্যাকে দেখার ও মোকাবিলা করার একটি নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেয়।
৩. আতঙ্কের সময় জিকির
সকাল-সন্ধ্যার জিকির কেবল একটি আধ্যাত্মিক রুটিন নয়। এটি আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে পুনর্বিন্যাস করার একটি প্রক্রিয়া। যখন বড় কোনো সংকট খবরের শিরোনামে আধিপত্য বিস্তার করে, তখন আল্লাহর সুরক্ষার কথা স্মরণ করে আমাদের হৃদয় শান্ত হয়।
আল্লাহর স্মরণ যে অন্তরকে প্রশান্তি দেয়, কোরআন তার সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে, “...জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি লাভ করে।” (সুরা রাদ, আয়াত: ২৮)
নিয়মিত জিকির একজন বিশ্বাসীকে মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে এক ধরনের স্থিতিশীলতা এনে দেয়, যা প্যানিক বা গণ-উদ্বেগের সময়ও তাকে বিচলিত হতে দেয় না। এটি আসলে নিজের অস্তিত্বকে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুক্ত রাখার একটি অভ্যাস। (ইবনুল কাইয়িম আল জাওযি, আল-ওয়াবিলুস সায়্যিব মিনাল কালামিত তাইয়্যিব, পৃষ্ঠা: ৯২, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০১)
নিয়মিত জিকির একজন বিশ্বাসীকে মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে এক ধরনের স্থিতিশীলতা এনে দেয়, যা প্যানিক বা গণ-উদ্বেগের সময়ও তাকে বিচলিত হতে দেয় না।
৪. ব্যক্তিগত শক্তির চেয়ে সমষ্টিগত শক্তি
ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার জন্য প্রস্তুত হওয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ কেবল ব্যক্তিগত সহনশীলতার (Individual Resilience) ওপর মনোযোগ দেয়। কিন্তু ইসলাম এর বাইরেও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা এনে দেয়—তা হলো সমষ্টিগত বা সামাজিক সহনশীলতা (Community Resilience)।
যখন আপনি ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে অসহায় মনে করেন, তখন আপনার পরিবার এবং আপনার স্থানীয় সমাজ বা উম্মাহ-এর নেটওয়ার্কই আপনাকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেবে।
কিন্তু এই সুবিধা তখনই কার্যকর হয়, যখন আপনি প্রয়োজনের আগে থেকেই এই সামাজিক কাঠামোতে বিনিয়োগ করেছেন। বিশেষ করে আপনার পরিবার, স্থানীয় প্রতিবেশী এবং মুসলিম সমাজের প্রতি আপনার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)
নবীজি (সা.) আমাদের ‘হাম্ম’ (ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা) এবং ‘হুযন’ (অতীতের দুঃখ) থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে শিখিয়েছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৬৮)
আমাদের অধিকাংশ মানসিক শক্তি এমন কিছুর পেছনে অপচয় হয়, যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তাই, ভবিষ্যৎ কী নিয়ে আসছে তা মানচিত্রে আঁকার চেষ্টা না করে, বরং এই প্রশ্নের ওপর মনোযোগ দিন, “আজকে আপনি এমন কোন মূল্যবান পদক্ষেপ নিতে পারেন, যা আপনার মূল বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আপনার চূড়ান্ত উদ্দেশ্যকে সফল করতে সাহায্য করে?”
আপনার প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা ভবিষ্যতে কী আসছে, তা জানার মধ্যে নিহিত নয়। বরং আপনার আসল সুবিধা হলো, যা আসছে তার জন্য আধ্যাত্মিক ও বাস্তবিক উভয় দিক থেকে প্রস্তুত থাকা।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের হিকমাহ (প্রজ্ঞা) দান করুন, যেন আমরা আমাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে এমনভাবে চালনা করতে পারি, যা তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। আমিন।