ইসলাম সম্পর্কে কীভাবে শিখবেন

অনেকে ধরে নেন, ইসলামের প্রথম নির্দেশ ছিল দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। নিশ্চয় নামাজ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু প্রথম নির্দেশ নামাজ ছিল না, ছিল ‘ইকরা’, অর্থাৎ ‘পড়ো’।

আরও গভীরভাবে এই পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল একজন নিরক্ষর ব্যক্তি, আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রথম উত্তর ছিল, ‘আমি পড়তে জানি না।’। ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) আবার বললেন, ‘পড়ো!’ এবং তিনি রাসুল (সা.)-কে মোলাকাত করে চাপ দিলেন। রাসুল (সা.) পুনরায় বললেন, ‘আমি পড়তে জানি না।’ জিবরাইল (আ.) তাঁকে আবার চেপে ধরে পড়তে বললেন।

রাসুল (সা.) দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি আবারও জোর দিয়ে বলেন, তিনি পড়তে সক্ষম নন। তখন জিবরাইল (আ.) সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত পড়ে শোনান: ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একটি জমাট রক্তপিণ্ড থেকে। পড়ো! তোমার প্রভু সর্বাধিক দয়ালু, যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে শিখিয়েছেন যা তারা জানত না।’

স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রথম উত্তর ছিল, ‘আমি পড়তে জানি না।’। ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) আবার বললেন, ‘পড়ো!’ এবং তিনি রাসুল (সা.)-কে মোলাকাত করে চাপ দিলেন।

কেন শিখতে হবে

ইসলাম সম্পর্কে শেখা বাধ্যতামূলক। জিবরাইল (আ.) শুধু রাসুল (সা.)-কে পড়তে বলছিলেন না, তিনি তাঁকে শিখতে বলছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি মানবজাতির জন্য শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবেন। এটিই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা: আমাদের সক্ষমতা যাই হোক না কেন, আমাদের ধর্ম সম্পর্কে আরও শেখার ক্ষমতাকে অস্বীকার করা উচিত নয়।

আমাদের শুরুতেই আরবি শিখতে হবে বা এক বছরে পুরো কোরআন মুখস্থ করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু শেখার দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন: ‘(ইসলাম সম্পর্কে) জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ।’ (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪)

মূল বিষয় হলো নিয়ত করা, আল্লাহর কাছে উপকারী শিক্ষক ও সম্পদের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করা এবং ধারাবাহিক থাকা। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আল্লাহর কাছে কোন আমল সবচেয়ে প্রিয়?’ তিনি বললেন, ‘যে আমল নিয়মিত ও ধারাবাহিক, যদিও তা সামান্য হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৪৬৪)

আরও পড়ুন

কীভাবে শুরু করবেন

যেকোনো বিজ্ঞান শেখায় আমরা মৌলিক বিষয় দিয়ে শুরু করি। কোনো গণিতজ্ঞ ক্যালকুলাস দিয়ে শুরু করেন না; তারা প্রথমে পাটিগণিতের ভিত্তি মজবুত করেন। নিচে একটি সাধারণ সময়রেখা দেওয়া হলো যাতে শিখতে গিয়ে আপনি অতিরিক্ত চাপে না পড়েন:

১. আকিদা (বিশ্বাসের মূলনীতি): আকিদা মুসলিমের ঈমানের মূল বিশ্বাস ও নীতিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই কোর্সগুলো প্রায়শই ‘ঈমানের মৌলিক বিষয়’ হিসেবে পরিচিত। এতে রাসুল (সা.)-এর মর্যাদা, কোরআনের মর্যাদা, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ এবং ঈমানের সাধারণ নীতিগুলোর কথা রয়েছে। আকিদা ক্লাসে আল্লাহ কে তা-ও আলোচনা করা হয়।

আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কিত বই পড়ুন, যা আল্লাহকে জানতে সাহায্য করবে। সঙ্গে ইমাম গাজালি (রহ.)-এর আইয়্যুহাল ওয়ালাদ (হে আমার ছেলে) তে পারেন, যা অন্তরের শুদ্ধি নিয়ে একটি মাইলফলক গ্রন্থ। এ ছাড়া ইবনে কাইয়্যিম (রহ.)-এর ‘মাদারিজুস সালিকিন’ গ্রন্থটিও পড়তে পারেন।

কোনো গণিতজ্ঞ ক্যালকুলাস দিয়ে শুরু করেন না; তারা প্রথমে পাটিগণিতের ভিত্তি মজবুত করেন।

২. তাজবিদ (কোরআনের বিশুদ্ধ পাঠ): তাজবিদ শিখলে আপনি কোরআন বিশুদ্ধ উচ্চারণে পড়তে শিখবেন। প্রথমে আরবি অক্ষর চিনবেন, শব্দ সংযোগ করবেন এবং ধীরে ধীরে পুরো আয়াত পড়তে শিখবেন। এই জন্য একজন শিক্ষক থাকা ভালো, যিনি আপনার শেখার সঠিকতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবেন।

আরবি অক্ষর শেখার বই বা ভিডিও সিরিজ, অ্যাপ যেখানে বিভিন্ন কারি (পাঠক)-এর পাঠ শুনতে পারবেন এবং প্রতিদিনের পাঠের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারবেন। নারীদের জন্য নারী কারিয়াহদের তেলাওয়াত শোনার ভালো অ্যাপ আছে, ইনস্টল করে নিতে পারেন।

৩. ফিকহ (ইসলামি আইনশাস্ত্র): এটি একটি গভীর বিজ্ঞান, তবে প্রত্যেক মুসলিমের মৌলিক ফিকহ জানা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, কখন নামাজ পড়তে হবে, কীভাবে নামাজ পড়তে হবে এবং নারীদের ঋতুস্রাবের পর শরীরের পবিত্রতা কীভাবে অর্জন করতে হবে। এখান থেকে নামাজে মনোযোগ, বিতর নামাজ, ইস্তিখারা এবং গোসলের নিয়ম, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত বিধানাবলি জেনে নাও।

৪. তাফসির (কোরআনের ব্যাখ্যা): বিভিন্ন মসজিদে আজকাল জুমার দিনে তাফসির শেখানো হয়। এ ছাড়া কোরআন অধ্যয়ন সেশন বা কোর্সে ভর্তি হতে পারেন। ইনস্টল করে রাখতে পারেন কোনও উপযুক্ত অ্যাপ যেখানে প্রতিদিন পাঁচ মিনিটে একটি সুরা বা পারার মৌলিক বিষয় শেখা যায়। গ্রন্থ হিসেবে ‘তাফসিরে জালালাইন’ সহজে বোঝার জন্য উপযুক্ত। সহজবোধ্য অনুবাদ জানতে ‘মাআরিফুল কোরআন’ পড়তে পারেন।

৫. হাদিস ও সিরাত: আমরা যেমন প্রিয় সিনেমার উক্তি মুখস্থ করি, তেমনি রাসুল (সা.)-এর সবচেয়ে অর্থবহ বাণী আমাদের জন্য অমূল্য। বিভিন্ন মসজিদে প্রায়শই ইমাম নববির ৪০ হাদিস বা রিয়াদুস সালিহিনের তালিম হয়। ভালো আলেমদের সিরাত ও হাদিসের পডকাস্ট শুনতে পারেন। বই হিসেবে পড়তে পারেন আর-রাহিকুল মাখতুমর ভালো অনুবাদ।

আরও পড়ুন
যে ব্যক্তি জ্ঞানের সন্ধানে পথ চলে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন
সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৬৯৯

সশরীরে শিক্ষা নিতে চাইলে

অনেক মসজিদ সন্ধ্যায় বা সকালে কোর্স অফার করেন। আপনার স্থানীয় ইমামের কাছে সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন। হয়তো নারীদের কোনো গ্রুপ বা তরুণদের সংগঠন রয়েছে। একটু একটু করে শুরু করুন এবং নিয়মিত লেগে থাকুন। সপ্তাহে অন্ততঃ একবার সশরীর কোনও প্রতিষ্ঠানে হাজির হয়ে আলেমদের থেকে শোনার চেষ্টা করুন। হাদিস, সিরাত, তাফসির বা আধ্যাত্মিক আলোচনায় যোগ দিন।

যদি উচ্চত অধ্যয়ন করতে চান, তাহলে পরামর্শক্রমে ভালো কোনও প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে যান। অনেকে অনলাইন, সশরীরে, খণ্ডকালীন বা পূর্ণকালীন বিকল্প অফার করে; তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানের সন্ধানে পথ চলে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৬৯৯)। রাসুল (সা.) ইবনে আব্বাস (রা.)-এর জন্য বিশেষ দোয়া করেছিলেন, যা আমরা নিজেদের জন্যও বলতে পারি: ‘আল্লাহুম্মা ফাক্কিহনা ফিদ দিন, ওয়া আল্লিমনা তা’উইল (হে আল্লাহ, আমাদের ধর্মের জ্ঞান দাও এবং কোরআনের ব্যাখ্যা শেখাও)।’ আমিন!

 সূত্র: আমালিয়াহ ডটকম

আরও পড়ুন