‘সাকিনা’ অর্থ কী
আধুনিক জীবিকা ও ভোগের প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের আত্মিক প্রশান্তি। অথচ সুখময় জীবনের জন্য আত্মিক প্রশান্তি অত্যন্ত জরুরি। এটি আল্লাহর নেয়ামতও।
সাকিনা কেবল সাময়িক স্বস্তির অনুভূতি নয়; বরং এটি মানুষকে কঠিন ও অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে আশাবাদী করে তোলে এবং স্থিরতার সঙ্গে জীবনযাপন করতে সক্ষম করে।
সাকিনা শব্দের বাংলা অর্থ স্থিরতা, প্রশান্তি। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেছেন, সাকিনা এমন প্রশান্তি, মর্যাদা ও স্থিরতা, যা মহান আল্লাহ তাঁর উদ্বিগ্ন ও অস্থির বান্দার অন্তরে নাজিল করেন।
কোরআনে সাকিনা
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, সুরা বাকারা ছাড়া কোরআনে যেসব স্থানে সাকিনা শব্দটি এসেছে, এর অর্থ হলো প্রশান্তি ও আত্মিক শান্তি।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন অনেক ক্ষেত্রে এবং হুনাইনের যুদ্ধের দিনে, যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদের প্রফুল্ল করেছিল, কিন্তু তা তোমাদের কোনো কাজে আসেনি এবং পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তোমাদের জন্য সংকুচিত হয়েছিল। অতঃপর পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। তারপর আল্লাহ নাজিল করেন নিজের পক্ষ থেকে সান্ত্বনা, তাঁর রাসুল ও মুমিনদের প্রতি এবং অবতীর্ণ করেন এমন সেনাবাহিনী, যাদের তোমরা দেখতে পাওনি।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ২৫-২৬)
সাকিনা কেবল সাময়িক স্বস্তির অনুভূতি নয়; বরং এটি মানুষকে কঠিন ও অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে আশাবাদী করে তোলে এবং স্থিরতার সঙ্গে জীবনযাপন করতে সক্ষম করে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা তাঁকে (রাসুলকে) সাহায্য না করো, তবে মনে রেখো, আল্লাহ তার সাহায্য করেছিলেন, যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দুজনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন বিষণ্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় সান্ত্বনা নাজিল করলেন এবং তাঁর সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখোনি।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৪০)
মহান আল্লাহ বলেন, ‘কাফেররা যখন তাদের অন্তরে অহমিকাকে স্থান দিল, যা ছিল জাহেলিয়া যুগের অহমিকা, তখন আল্লাহ তাঁর রাসুল ও মুসলিমদের ওপর নিজ প্রশান্তি বর্ষণ করলেন এবং তাদের তাকওয়ার বিষয়ে স্থিত করে রাখলেন আর তারা তো এরই বেশি হকদার ও এর উপযুক্ত ছিল।’ (সুরা ফাত্হ, আয়াত: ২৬)
সাকিনার কারণ
নবীজি (সা.)-এর বহু হাদিসে সাকিনার বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি মুমিনের হৃদয়ে প্রশান্তির নাজিলের বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। সেসব হাদিস আমাদের কাজকর্মে, চলাফেরায় ও কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্য, সংযম ও স্থিরতা বজায় রাখতে উৎসাহ দেয়।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, কোরআন পাঠের মাধ্যমে সাকিনা নাজিল হয়।
বারা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি সুরা কাহাফ পাঠ করছিলেন। তাঁর ঘোড়াটি দুটি রশি দিয়ে তার পাশে বাঁধা ছিল। তখন একখণ্ড মেঘ এসে তার ওপর ছায়া বিস্তার করল। মেঘখণ্ড ক্রমেই নিচের দিকে নেমে আসতে লাগল। আর তাঁর ঘোড়াটি ভয়ে লাফালাফি শুরু করে দিল।
ভোরে লোকটি নবীজির কাছে ঘটনাটি বললেন। নবীজি বললেন, এটা ছিল সাকিনা (প্রশান্তি), যা কোরআন পাঠের কারণে নাজিল হয়েছিল। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০১১)
অপর হাদিসে নবীজি (সা.) বলেছেন, কোরআনের আলোচনার বৈঠকে সাকিনা নাজিল হয়।
রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন কোনো সম্প্রদায় আল্লাহর ঘরগুলোর কোনো একটিতে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং পরস্পরে তার পর্যালোচনায় নিয়োজিত থাকে তখন তাদের ওপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়।
রহমত তাদের আচ্ছাদিত করে এবং ফেরেশতারা তাদের পরিবেষ্টন করে রাখেন। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর নৈকট্যধারীদের (ফেরেশতাদের) নিয়ে তাদের কথা বলেন। আর যে ব্যক্তির আমল তাকে পিছিয়ে দেবে তার বংশমর্যাদা তাকে এগিয়ে নিতে পারবে না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৯৯-১)
সাকিনা জিহ্বাকে সত্য ও প্রজ্ঞার কথা বলায় অভ্যস্ত করে তোলে; অশ্লীল, অশোভন, অর্থহীন ও মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত রাখে।ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.)
সাকিনার জন্য নবীজির দোয়া
নবীজি (সা.) যুদ্ধের দিনে সাকিনার জন্য দোয়া করেছেন। বারা (রা.) বলেন, খন্দকের দিন আমি রাসুল (সা.)-কে দেখেছি যে তিনি মাটি বহন করছেন। আর তাঁর পেটের শুভ্রতা মাটি ঢেকে ফেলেছে।
সে সময় তিনি আবৃত্তি করছিলেন, (ইয়া আল্লাহ), আপনি না হলে আমরা হেদায়েত পেতাম না; সদকা দিতাম না এবং নামাজ আদায় করতাম না। তাই আমাদের ওপর প্রশান্তি বর্ষণ করুন। যখন আমরা শত্রুর সম্মুখীন হই তখন আমাদের পা সুদৃঢ় করুন। ওরা (মুশরিকরা) আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। তারা যখনই কোনো ফেতনা সৃষ্টি করতে চায় তখনই আমরা তা থেকে বিরত থাকি। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৮৩৭)
সাকিনা ইমান বৃদ্ধির মাধ্যম
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাজিল করেন, যাতে তাদের ইমানের সঙ্গে আরও ইমান বেড়ে যায়।’ (সুরা ফাত্হ, আয়াত: ৪)
মহান আল্লাহর সাকিনা মাধ্যমে মুমিনের হৃদয়ে দৃঢ়তা, স্থিরতা ও প্রশান্তি দান করেন। ফলে মুমিন ব্যক্তি আরও দৃঢ়ভাবে আল্লাহর আদেশ প্রতিষ্ঠা করে এবং তার ইমান বৃদ্ধি পায় ও তার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়।
ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) তাঁর বিখ্যাত মাদারিজুস সালিকিন গ্রন্থে বলেছেন, যখন সাকিনা (আত্মিক প্রশান্তি ও স্থিরতা) হৃদয়ে নেমে আসে, তখন হৃদয় প্রশান্ত হয়; অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শান্ত হয় ও বিনয় প্রকাশ করে এবং মানুষ গাম্ভীর্য ও মর্যাদা অর্জন করে। সাকিনা জিহ্বাকে সত্য ও প্রজ্ঞার কথা বলায় অভ্যস্ত করে তোলে; অশ্লীল, অশোভন, অর্থহীন ও মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত রাখে।
যুবাইর ইসহাক : আলেম, লেখক, অনুবাদক