মহররমে মুসা (আ.)–এর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার
হিজরি ১৪৪৭ সনের শুরুতে মহররম মাস আমাদের সামনে এসেছে। মহররমকে আল্লাহ ‘শাহরুল্লাহ’ বা তাঁর নিজের মাস বলে সম্মানিত করেছেন। এই মাসে আশুরার রোজা আমাদের জন্য মুসা (আ.)-এর উত্তরাধিকার পুনরুদ্ধারের এক অনন্য সুযোগ করে দিয়েছে। কোরআনে সবচেয়ে বেশিবার উল্লেখিত নবী মুসা (আ.) এই উম্মাহর জন্য এক প্রেরণার পুরুষ।
মুসা (আ.)-এর গল্প কোরআনে ১৩৬ বার উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি শুধু ইহুদিদের নবী নন, মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মাতের জন্যও একজন গুরুত্বপূর্ণ নবী। আল্লাহ বলেন, ‘আমি মুসাকে আমার নিদর্শন ও স্পষ্ট প্রমাণসহ ফেরাউন, হামান ও কারুনের কাছে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তারা বলল, সে একজন জাদুকর ও মিথ্যাবাদী।’ (সুরা মুমিন, আয়াত: ২৩-২৪)
নবীজি (সা.) ইহুদিদের বললেন, ‘মুসার প্রতি আমাদের অধিকার তোমাদের চেয়ে বেশি।’ তিনি সেদিন রোজা রাখলেন এবং মুসলিমদেরও তা পালনের নির্দেশ দিলেন।
ফেরাউন ছিলেন অত্যাচারী শাসক, হামান রাজনৈতিক দুর্নীতির প্রতীক আর কারুন ছিলেন অর্থের অপব্যবহার ও কপটতার প্রতিনিধি। মুসা (আ.)-এর সংগ্রাম ছিল এই তিন ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধেই। বিস্ময়ের কথা হলো, একই ধরনের দুর্নীতি আমাদের সমাজেও বিদ্যমান।
ফলে মুসা (আ.)-এর জীবন আমাদের জন্য অনন্য শিক্ষা। তিনি ফেরাউনের প্রাসাদে বড় হয়েছিলেন, তবুও নিজের জনগোষ্ঠীর জন্য লড়েছিলেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে ক্ষমতার মুখে সত্য বলতে হয় এবং ন্যায়ের জন্য দাঁড়াতে হয়।
মহররমের দশম দিন আশুরা, মুসা (আ.)-এর রেখে যাওয়া আদর্শ আবার আমাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ইবন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) মদিনায় এসে দেখেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখছেন।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা কী?’ তাঁরা বললেন, ‘এটি একটি পুণ্যময় দিন, এই দিনে আল্লাহ বনি ইসরাইলকে তাদের শত্রুদের থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, তাই মুসা (আ.) এই দিনে রোজা রেখেছিলেন।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘মুসার প্রতি আমাদের অধিকার তোমাদের চেয়ে বেশি।’ তিনি সেদিন রোজা রাখলেন এবং মুসলিমদেরও তা পালনের নির্দেশ দিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২০০৪)
আরেকটি বর্ণনায় বলা হয়, ‘এটি একটি মহান দিন, যেদিন আল্লাহ মুসা ও তাঁর কওমকে রক্ষা করেছিলেন এবং ফেরাউন ও তাঁর কওমকে ডুবিয়েছিলেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৩০)
ফলে এই রোজা কেবল একটি ইবাদত নয়, বরং মুসা (আ.)-এর বিজয়ের স্মরণ এবং এই উম্মাহর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগও বটে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘আশুরার দিনের রোজা সম্পর্কে আমি আশা করি যে আল্লাহ এটিকে পূর্ববর্তী এক বছরের পাপের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২)
আমাকে মুসার ওপর প্রাধান্য দিয়ো না। কিয়ামতের দিন মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়বে, আমিও সংজ্ঞাহারা হব। প্রথম আমি জ্ঞান ফিরে পাব, আর দেখব মুসা (আ.) আরশ ধরে আছেন।
মুসা (আ.)-এর গল্প এই উম্মাহর জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। একবার একজন সাহাবি ইহুদির সঙ্গে মুসা (আ.) ও মুহাম্মদ (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিতর্ক করলেন, নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমাকে মুসার ওপর প্রাধান্য দিয়ো না। কিয়ামতের দিন মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়বে, আমিও সংজ্ঞাহারা হব। প্রথম আমি জ্ঞান ফিরে পাব, আর দেখব মুসা (আ.) আরশ ধরে আছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৪০৫)
তা ছাড়া মেরাজের সময় নবীজি (সা.)-কে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।
তবে নবীজি (সা.) আশুরার রোজাকে এই উম্মাহর স্বতন্ত্র পরিচয়ের অংশ করেছেন। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নবীজি আশুরার দিন রোজা রাখলেন এবং মুসলিমদেরও তা রাখতে বললেন। সাহাবিরা বললেন, ‘আল্লাহর রাসুল, এটি এমন একটি দিন যাকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা সম্মান করে।’ নবীজি বললেন, ‘আগামী বছর ইনশা আল্লাহ আমরা নবম দিনেও রোজা রাখব। কিন্তু পরের বছর আসার আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৩৪)
এভাবে নবম ও দশম মহররমের রোজা আমাদের পরিচয়কে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের থেকে আলাদা করা হয়েছে। আমরা নবম ও দশম মহররমে রোজা রেখে মুসা (আ.)-এর উত্তরাধিকারকে পুনরুজ্জীবিত করি। মহররম আমাদের জন্য কেবল একটি মাস নয়, বরং আমাদের ইতিহাস ও পরিচয়ের একটি অংশ।
সূত্র: ইসলাম টুয়েন্টিওয়ান-সি ডটকম