ঈদুল আজহার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য

মুসলিম সমাজে কোরাবানির সংস্কৃতির সূচনা হয় মহানবী (সা.)–এর আমলের মধ্য দিয়ে। এরপর গত দেড় হাজার বছরে নানান রূপ পরিগ্রহ করেছে। কোরবানির সংস্কৃতির বিবর্তন নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক রচনার আজ তৃতীয়শেষ পর্ব

ফেজ ও মারাকেশের মসজিদের আঙিনায় কোরবানির মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হতো

ঈদুল আজহা মুসলিম সমাজে একটি সর্বজনীন উৎসব, যা ধর্মীয় তাৎপর্যের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রকাশ ঘটায়। মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে এই উৎসব সাধারণভাবে পালিত হলেও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল—আন্দালুস, মাগরিব, পারস্য, ভারত—নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রথার মাধ্যমে ঈদুল আজহাকে সমৃদ্ধ করেছে। এ অঞ্চলগুলোয় কোরবানির অনুষ্ঠান, পোশাক, খাবার এবং সামাজিক রীতিনীতি স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে একটি অনন্য রূপ লাভ করেছে।

ফেজ ও মারাকেশের মসজিদের আঙিনায় কোরবানির মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হতো। এই প্রক্রিয়ায় ফকিহগণ উপস্থিত থাকতেন এবং তাকবির ধ্বনির মাধ্যমে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হতো।

আন্দালুসিয়ায় ঈদুল আজহা

আন্দালুসিয়া (৯২-৮৯৭ হি./৭১১-১৪৯২ খ্রি.), যা আজকের স্পেনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, একসময় মুসলিম বিশ্বের একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। ঈদুল আজহা এখানে সৌন্দর্য, পরিচ্ছন্নতা এবং সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে পালিত হতো।

ইবনে আজারি আল-মারাকুশি (মৃ. ৭১২ হি.) তাঁর আল-বায়ান আল-মুগরিব গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, আন্দালুসিয়ার পুরুষেরা ঈদের জন্য চুল ও দাড়িতে মেহেদি ব্যবহার করতেন। এই প্রথা ছিল সৌন্দর্যের পাশাপাশি নবীজির (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণের প্রকাশ।

আন্দালুসিয়ায় কোরবানির আয়োজন হতো ব্যাপকভাবে। ইবনে আবদুন আল-ইশবিলি (মৃ. ৫৩০ হি.) তাঁর রিসালা ফি আল-কাদা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কর্দোভা ও সেভিয়ার বাজারে ঈদের আগে পশুর হাট বসত, যেখানে স্বাস্থ্যবান দুম্বা ও গরু বিক্রি হতো।

কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করা হতো—এক ভাগ পরিবারের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়দের জন্য এবং এক ভাগ দরিদ্রদের জন্য। এই বিতরণ প্রক্রিয়া মালিকি ফকিহদের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হতো, যাঁরা কোরবানির শরিয়াহ বিধান কঠোরভাবে পালন করতেন।

গ্রানাদার আমিররা ঈদুল আজহার ভোজে হরেক রকম খাবার পরিবেশন করতেন। থাকত কুসকুস, মাংসের তরকারি এবং মিষ্টান্ন। এই ভোজে খ্রিষ্টান ও ইহুদি প্রতিবেশীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হতো।
আরও পড়ুন

আন্দালুসিয়ায় ঈদের ভোজ ছিল বিখ্যাত। ইবনে সাঈদ আল-মাগরিবি (মৃ. ৬৮৫ হি.) বর্ণনা করেছেন, গ্রানাদার আমিররা ঈদুল আজহার ভোজে হরেক রকম খাবার পরিবেশন করতেন, যার মধ্যে কুসকুস, মাংসের তরকারি এবং মিষ্টান্ন হিসেবে আলফাজোর (মধু ও বাদামের মিষ্টি) ছিল। এই ভোজে খ্রিষ্টান ও ইহুদি প্রতিবেশীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হতো।

মাগরিবে ঈদ: মালিকি ফকিহদের প্রভাব

মাগরিব—অর্থাৎ বর্তমান মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া—মুসলিম বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যেখানে মালিকি ফিকহ ঈদুল আজহার উৎসবকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। ইবনে আবি দিনার (মৃ. ১০৭০ হি.) তাঁর আল-মুয়ানিস ফি আখবার ইফরিকিয়া গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, মাগরিবের মানুষ ঈদের আগে পশু কেনায় বিশেষ গুরুত্ব দিত।

মালিকি ফকিহগণ কোরবানির পশুর স্বাস্থ্য, বয়স এবং জবাইয়ের পদ্ধতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট ফতোয়া জারি করতেন। ইমাম মালিক (মৃ. ১৭৯ হি.) তাঁর আল-মুওয়াত্তা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কোরবানির পশুকে জবাইয়ের সময় যত্ন নিতে হবে, যাতে তা অপ্রয়োজনীয় কষ্ট না পায়।

কোরবানির পশুকে জবাইয়ের সময় যত্ন নিতে হবে, যাতে তা অপ্রয়োজনীয় কষ্ট না পায়
ছবি: এআই

মাগরিবে কোরবানির মাংস বিতরণ ছিল একটি সামাজিক প্রথার মতো। নাসিরি আস-সালাওয়ি (মৃ. ১৩১৫ হি.) বর্ণনা করেছেন, ফেজ ও মারাকেশের (মরক্কো) মসজিদের আঙিনায় কোরবানির মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হতো।

এই প্রক্রিয়ায় ফকিহগণ উপস্থিত থাকতেন এবং তাকবির ধ্বনির মাধ্যমে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হতো। মাগরিবের একটি অনন্য প্রথা ছিল কোরবানির মাংস দিয়ে ‘হারিরা’ (একটি ঘন স্যুপ) তৈরি করা, যা সম্প্রদায়ের সবাই ভাগ করে খেত।

ঈদের পোশাকও মাগরিবে বিশেষ গুরুত্ব পেত। ইবনে বতুতা (মৃ. ৭৭৯ হি.) তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে উল্লেখ করেছেন, মরক্কোর মানুষ ঈদের জন্য সাদা জেল্লাবা (দীর্ঘ পোশাক) এবং লাল ফেজ টুপি পরতেন। নারীরা রঙিন কাফতান এবং সোনার গয়না পরে ঈদের নামাজে অংশ নিতেন। এই পোশাক সামাজিক মর্যাদা ও উৎসবের আনন্দ প্রকাশ করত।

আরও পড়ুন
ঈদুল আজহার মিছিলে সিল্কের পোশাক, সোনার অলংকার এবং রঙিন পতাকা ব্যবহার করতেন। এই মিছিলে কবি ও সংগীতজ্ঞরা অংশ নিতেন, যাঁরা তাকবিরের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সুরে গান পরিবেশন করতেন।

ইরানে ঈদ: কবিতা ও শিল্প

পারস্য (বর্তমান ইরান ও আশপাশের অঞ্চল) ইসলামি বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক কেন্দ্র ছিল। ঈদুল আজহা এখানে কবিতা, শিল্প এবং সামাজিক সমাবেশের মাধ্যমে পালিত হতো। ইবনে সিনা (মৃ. ৪২৮ হি.) তাঁর কিতাব আশ-শিফা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, পারস্যের শাসকেরা ঈদের নামাজের পর কবিতা আবৃত্তির আয়োজন করতেন। এ কবিতায় কোরবানির ত্যাগ, ইবরাহিম (আ.)-এর আনুগত্য এবং আল্লাহর প্রশংসা বর্ণিত হতো।

কোরবানির প্রথা পারস্যে স্থানীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। জাহিজ (মৃ. ২৫৫ হি.) তাঁর কিতাব আল-হায়াওয়ান গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, পারস্যের মানুষ কোরবানির মাংস দিয়ে ‘খোরেশ্ত’ (মাংসের তরকারি) তৈরি করত, যা নওরোজের মতো ঐতিহ্যবাহী খাবারের সঙ্গে মিলিয়ে খাওয়া হতো। এই খাবার সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়া হতো এবং দরিদ্রদের জন্য বিশেষভাবে রান্না করা হতো।

পারস্যে ঈদের মিছিল ছিল দৃষ্টিনন্দন। ইবনে ফাদলান (মৃ. ৩৪৯ হি.) বর্ণনা করেছেন, সাফ্‌ফারি শাসকেরা ঈদুল আজহার মিছিলে সিল্কের পোশাক, সোনার অলংকার এবং রঙিন পতাকা ব্যবহার করতেন। এই মিছিলে কবি ও সংগীতজ্ঞরা অংশ নিতেন, যাঁরা তাকবিরের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সুরে গান পরিবেশন করতেন। এই শিল্পকর্ম ঈদকে একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপান্তরিত করত।

আরও পড়ুন

ভারতে ঈদ: রাজকীয় মর্যাদা

ভারতে ঈদুল আজহা মোগল (৯৩২-১২৭৪ হি./১৫২৬-১৮৫৭ খ্রি.) এবং অন্যান্য মুসলিম শাসনামলে রাজকীয় মর্যাদা লাভ করে। আবুল ফজল (মৃ. ১০১১ হি.) তাঁর আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, সম্রাট আকবর (মৃ. ১০১৪ হি.) ঈদুল আজহার নামাজের জন্য দিল্লির জামে মসজিদে উপস্থিত হতেন। তিনি নিজে কোরবানির পশু জবাই করতেন এবং মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। মোগল আমলে কোরবানির মাংস দিয়ে ‘বিরিয়ানি’ ও ‘কোরমা’ তৈরি করা হতো, যা রাজকীয় ভোজের প্রধান খাবার ছিল।

মোগলদের ঈদের মিছিল ছিল অত্যন্ত গৌরবময়। মোগল সম্রাটরা সিল্ক ও সোনায় সজ্জিত হাতি এবং ঘোড়ার মিছিলের আয়োজন করতেন। এই মিছিলে হিন্দু ও মুসলিম প্রজারা একত্রে অংশ নিত। মোগল সম্রাটরা ঈদের সময় দরিদ্রদের জন্য বিশেষ দানশীলতা প্রদর্শন করতেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর আল-আকবর (মৃ. ১০৮৩ হি.) ঈদুল আজহার সময় হাজারো দরিদ্রকে পোশাক ও খাবার দান করেছিলেন।

সম্রাট আকবর ঈদুল আজহার নামাজের জন্য দিল্লির জামে মসজিদে উপস্থিত হতেন। তিনি নিজে কোরবানির পশু জবাই করতেন এবং মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন।

ঈদুল আজহা বিভিন্ন ইসলামি অঞ্চলে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের একটি প্রধান প্রকাশ ছিল। আন্দালুসে এটি সৌন্দর্য ও সম্প্রীতির প্রতীক ছিল, মাগরিবে মালিকি ফকিহদের প্রভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল, পারস্যে কবিতা ও শিল্পের মাধ্যমে উদ্‌যাপিত হতো এবং ভারতে রাজকীয় মর্যাদা লাভ করেছিল। এই ঐতিহ্য আজও মুসলিম বিশ্বে জীবন্ত, যা আমাদের ত্যাগ, ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের শিক্ষা দেয়।

কোরবানির সংস্কৃতি ০১ : মহানবী (সা.)–এর যুগে কোরবানির ঈদ

কোরবানির সংস্কৃতি ০২ : আদি সময়ে ঈদুল আজহার উদ্‌যাপন

 (আলজাজিরা ডট নেট অবলম্বনে)

আরও পড়ুন