কোরবানির সংস্কৃতি ০১
মহানবী (সা.)–এর যুগে কোরবানির ঈদ
মুসলিম সমাজে কোরাবানির সংস্কৃতির সূচনা হয় মহানবী (সা.)–এর আমলের মধ্য দিয়ে। এরপর গত দেড় হাজার বছরে নানান রূপ পরিগ্রহ করেছে। কোরবানির সংস্কৃতির বিবর্তন নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক রচনার আজ প্রথম পর্ব।
ঈদুল আজহা, যাকে আমরা বলি কোরবানির ঈদ। এটা মুসলিম সমাজের অন্যতম পবিত্র উৎসব। এ উৎসব শুধু আনন্দের নয়; বরং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতার প্রতীক। ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর ত্যাগের স্মরণে এ উৎসব পালিত হয়।
কোরবানির আচার শুধু একটি ধর্মীয় রীতি নয়; বরং এটি নফসের পরিশুদ্ধি, দানশীলতা ও সামাজিক ঐক্যের একটি গভীর দার্শনিক বার্তা বহন করে। আমরা ঈদুল আজহা ও কোরবানির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য, মহানবী (সা.)-এর সময়ে এর প্রচলন ও এর সামাজিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
মহানবী (সা.) ঈদুল আজহার দিনে দুটি দুম্বা কোরবানি করতেন—একটি নিজের জন্য এবং অপরটি তাঁর উম্মতের জন্য। তিনি কোরবানির সময় বলতেন, ‘বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার।
কোরবানির আধ্যাত্মিক শিকড়
ঈদুল আজহার মূল কাহিনি ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগের ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত। কোরআনের সুরা সাফফাতে (আয়াত: ১০০-১১১) বর্ণিত হয়েছে যে আল্লাহ স্বপ্নে ইবরাহিম (আ.)-কে তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার নির্দেশ দেন।
ইবরাহিম (আ.) এ নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত হন এবং ইসমাইল (আ.) নিজেও আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পণ প্রকাশ করেন। তাঁদের এ আনুগত্য ও ত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে আল্লাহ ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানির জন্য প্রেরণ করেন।
এ ঘটনা মুসলিমদের শিক্ষা দেয় যে সত্যিকারের কোরবানি হলো আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য ও নিজের প্রিয় জিনিস ত্যাগ করার মানসিক প্রস্তুতি।
ইমাম তাবারি (মৃ. ৩১০ হি.) তাঁর তাফসিরে তাবারি গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেন, কোরবানির আচার শুধু পশু জবাই নয়; বরং এটি নফসের লোভ, অহংকার ও ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। তিনি উল্লেখ করেন, ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগ ছিল আধ্যাত্মিক জিহাদের একটি রূপ, যা মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়তা করে।
মহানবী (সা.) ঈদের নামাজের জন্য মদিনার ঈদগাহে যেতেন একটি হারবা (বর্শা) সামনে রেখে। এ হারবা তাঁর সামনে স্থাপন করা হতো, যা পরবর্তীকালে খলিফাদের মধ্যে একটি শ্রদ্ধার প্রতীক হয়ে ওঠে।
সে সময়ে কোরবানি
মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরতের পর ঈদুল আজহার প্রথাগত উদ্যাপন শুরু করেন। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (মৃ. ৭৮ হি.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, মহানবী (সা.) ঈদুল আজহার দিনে দুটি দুম্বা কোরবানি করতেন—একটি নিজের জন্য এবং অপরটি তাঁর উম্মতের জন্য। তিনি কোরবানির সময় বলতেন, ‘বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার। এটি আমার পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের যারা কোরবানি দিতে পারেনি তাদের পক্ষ থেকে।’
ইমাম তিরমিজি (মৃ. ২৭৯ হি.) তাঁর সুনানে তিরমিজি গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মহানবী (সা.) কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করতেন। এক ভাগ পরিবারের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনের জন্য ও এক ভাগ দরিদ্রদের জন্য। এ প্রথা কোরবানির সামাজিক দিককে তুলে ধরে, যা সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের প্রতি দায়িত্বশীলতার শিক্ষা দেয়।
মহানবী (সা.) ঈদের দিনে সর্বোত্তম পোশাক পরতে ও সুগন্ধি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করতেন। ইমাম বুখারি (মৃ. ২৫৬ হি.) উল্লেখ করেন, মহানবী (সা.) ঈদের নামাজের জন্য মদিনার ঈদগাহে যেতেন একটি হারবা (বর্শা) সামনে রেখে। এ হারবা তাঁর সামনে স্থাপন করা হতো, যা পরবর্তীকালে খলিফাদের মধ্যে একটি শ্রদ্ধার প্রতীক হয়ে ওঠে। নবী (সা.)-এর এ সাধারণ কিন্তু গভীর আচরণ ঈদুল আজহাকে একটি সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
কোরবানির মাংস বিতরণের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য কমে এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মজবুত হয়।ইমাম গাজ্জালি (মৃ. ৫০৫ হি.), ইহয়াউ উলুমিদ্দিন
কোরবানির আধ্যাত্মিক প্রভাব
কোরবানির আচার শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত নয়; বরং এটি সমাজের দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি দায়িত্ব পালনের একটি মাধ্যম। ইমাম গাজ্জালি (মৃ. ৫০৫ হি.) তাঁর ‘ইহয়াউ উলুমিদ্দিন’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেন, কোরবানির মাংস বিতরণের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য কমে এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মজবুত হয়। তিনি বলেন, কোরবানি হলো আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও মানুষের প্রতি উদারতার সমন্বয়।
ঈদুল আজহার নামাজও একটি সামাজিক সমাবেশ। সহিহ মুসলিমে উম্মে আতিয়া আল-আনসারিয়ার (মৃত্যু: প্রায় ৭০ হিজরি) বর্ণনায় আছে, মহানবী (সা.) নারীদের ঈদের মাঠে উপস্থিত থাকতে বলতেন। এ অন্তর্ভুক্তি ঈদকে একটি সর্বজনীন উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যেখানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সমবেত হয়।
আয়েশা (রা.) বলেন, ঈদুল আজহার দিনে মদিনার কতিপয় বাসিন্দা তাঁদের ঐতিহ্যবাহী তরবারি ও ঢাল নিয়ে খেলা প্রদর্শন করছিলেন।
সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা (রা.) বলেন, ঈদুল আজহার দিনে মদিনার কতিপয় বাসিন্দা তাঁদের ঐতিহ্যবাহী তরবারি ও ঢাল নিয়ে খেলা প্রদর্শন করছিলেন। মহানবী (সা.) আয়েশা (রা.)-কে এ খেলা দেখার অনুমতি দেন এবং তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে এটি উপভোগ করেন।
মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে শুরু হওয়া কোরবানির অনুষ্ঠান পরবর্তী ইসলামি যুগে কীভাবে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে এবং কী মাত্রা যোগ করেছে, পরবর্তী পর্বে আমরা আলোচনা করব।
কোরবানির সংস্কৃতি ০২ : আদি সময়ে ঈদুল আজহার উদ্যাপন
কোরবানির সংস্কৃতি ০৩ : ঈদুল আজহার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য
‘আল–জাজিরা ডট নেট’ অবলম্বনে