দামেস্কের কিংবদন্তি আলেম ইমাম ইবনে আসাকির

ছবি: ফ্রিপিক

মধ্যযুগে ইসলামি জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে যাঁদের মনন ও ভাবনা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তাঁদের অন্যতম হলেন কিংবদন্তি ইমাম ইবনে আসাকির। তাঁর মূল নাম আলী বিন হাসান, উপনাম আবুল হাসান। তবে ‘ইবনে আসাকির’ নামেই তিনি বেশি পরিচিত।

এ নামে কেন তিনি বিখ্যাত, এর স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে কারও কারও ধারণা—এটি পিতৃবংশের কারও নাম ছিল, যার সূত্র ধরে তিনি এই উপাধি অর্জন করেন। (ইমাম জাহাবি, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, ১৫/২৪৭, দারুল হাদিস, কায়রো, ২০০৬)

তিনি প্রতি জুমাবারেই অন্তত একবার কোরআন খতম করতেন, আল্লাহর আনুগত্যহীন কোনো মুহূর্ত ব্যয় হলো কি না—এ বিষয়েও তিনি নিজেই নিজের হিসাব নিতেন।
তাজউদ্দিন সুবকি (রহ.), তাবাক্বাতুশ শাফিয়িয়্যাতিল কুবরা

ইবনে আসাকির হিজরি ৪৯৯ সনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান বর্তমান সিরিয়ার দামেস্ক নগরী। সেসময় দামেস্ক ছিল জ্ঞানচর্চা, তত্ত্ব বিশ্লেষণ ও গবেষণার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। তাই তিনি সেখান থেকেই জ্ঞানার্জনের পথে যাত্রা শুরু করেন। (ভূমিকা, তারিখু মাদিনাতি দিমাশক্ব, ১/১১, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

পারিবারিক দীক্ষা

ইবনে আসাকির (রহ.)-এর পরিবার ছিল অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও আলেমদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল; যে কারণে শৈশবেই তিনি ধর্মীয় নীতিবোধ ও আত্মিক উন্নয়নের দীক্ষা লাভ করেন। তা ছাড়া পিতা ছিলেন একজন প্রজ্ঞাবান আলেম ও ফকিহ। তাই অল্প বয়সেই তিনি ফিকহ ও অন্যান্য শাস্ত্রে মৌলিক ধারণা লাভ করেন। (ভূমিকা, তারিখু মাদিনাতি দিমাশক্ব, ১/১১, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

আরও পড়ুন
ইবনে আসাকিরের হাদিস ও ইতিহাসচর্চা অসংখ্য আলেমকে মুগ্ধ করে। ফলে অনেকেই তাঁকে নির্ভরতার প্রতীক ও শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে বিবেচনা করেন।

আল্লাহভীতির অনন্য প্রতীক

তিনি ছিলেন আল্লাহভীতির এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি কাটান আল্লাহর স্মরণ, ইবাদত ও সত্যনিষ্ঠার পথে। যশ-খ্যাতি কিংবা পার্থিব সম্পদ অর্জনে তিনি কখনো আগ্রহ দেখাননি। গবেষণা ও জ্ঞানের জগতে তিনি যেমন অতুলনীয় ছিলেন, তেমনই তাকওয়া, আত্মনিবেদন ও সত্যনিষ্ঠায়ও ছিলেন অনন্য। (ভূমিকা, তারিখু মাদিনাতি দিমাশক্ব, ১/২৪, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

আল্লামা তাজউদ্দিন সুবকি (রহ.) তাঁর ব্যাপারে লেখেন, ‘তিনি প্রতি জুমাবারেই অন্তত একবার কোরআন খতম করতেন, (ইবাদত, জ্ঞানচর্চা বা লেখালেখিতে) সর্বদাই মগ্ন থাকতেন, আল্লাহর আনুগত্যহীন কোনো মুহূর্ত ব্যয় হলো কি না—এ বিষয়েও তিনি নিজেই নিজের হিসাব নিতেন।’ (তাজউদ্দিন সুবকি, তাবাক্বাতুশ শাফিয়িয়্যাতিল কুবরা, ৪/১৩৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত, ১৯৯৯)

শিক্ষায় অবদান

শিক্ষাজীবনের সূচনা থেকেই ইবনে আসাকির (রহ.) ছিলেন অনুসন্ধিৎসু, জ্ঞানপিপাসু ও মননশীল। জ্ঞান ও গবেষণা ছিল তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য। জীবনের সিংহভাগ সময়ই তিনি কাটান জ্ঞান অন্বেষণ, ভ্রমণ, গ্রন্থ সংকলন ও শাইখদের সান্নিধ্যে গমন করে।

তিনি গভীর জ্ঞান আহরণের জন্য পাড়ি দেন হাজার মাইল পথ; পৌঁছেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক নগরে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

বাগদাদ (ইরাক): সে যুগের প্রধান জ্ঞানকেন্দ্র। ইবনে আসাকির (রহ.) সেখানে পাঁচ বছর অবস্থান করেন। এই সময়ে তিনি বিখ্যাত ‘মাদরাসায়ে নিজামিয়্যা’ থেকে হাদিস, ইতিহাস, নাহু, ফিকহসহ নানা শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান লাভ করেন।

নিশাপুর (ইরান): সে সময়ে হাদিসশাস্ত্র ও তত্ত্বচিন্তার সমৃদ্ধ কেন্দ্র।

ইস্পাহান (ইরান): ইমাম আবু নুআইম ও আবু আবদুল্লাহ ইবনে মানদাহসহ অনেক খ্যাতনামা মুহাদ্দিসের শহর।

হেজাজ: জ্ঞানার্জনের এক ঐতিহাসিক কেন্দ্র, যেখান থেকেই গড়ে উঠেছেন অসংখ্য আলেম, ফকিহ ও মুহাদ্দিস। (ভূমিকা, তারিখু মাদিনাতি দিমাশক্ব, ১/১৬-১৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

দামেস্কে ইবনে আসাকিরের সমাধি
ছবি: উইকিপিডিয়া

আলেমদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার

ইবনে আসাকিরের হাদিস ও ইতিহাসচর্চা অসংখ্য আলেমকে মুগ্ধ করে। ফলে অনেকেই তাঁকে নির্ভরতার প্রতীক ও শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে বিবেচনা করেন। খতিব আবুল ফজল আত তুসি (রহ.) বলেন, ‘আমাদের জানামতে, ইবনে আসাকির (রহ.) ব্যতীত “হাফিজুল হাদিস” উপাধির যোগ্য আর কেউ নেই।’ (ভূমিকা, তারিখু মাদিনাতি দিমাশক্ব, ১/২৫-২৬, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

আল্লামা নববি (রহ.) বলেন, ‘তিনি শাম প্রদেশের হাদিসবিশারদ; বরং বলা যায় তিনি পুরো বিশ্বের হাদিসবিশারদ এবং ইমাম।’ (ভূমিকা, তারিখু মাদিনাতি দিমাশক্ব, ১/২৫-২৬, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

আরও পড়ুন
তিনি সরাসরি শ্রবণের (সামা’) মাধ্যমে ১,৩০০ জন শাইখের কাছ থেকে হাদিস শুনেছেন। ৪৬ জন শাইখ তাঁকে কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন।

শিক্ষকেরা

কেবল ব্যক্তিক প্রচেষ্টায়ই নয়; বরং বহু শাইখ ও শাস্ত্রজ্ঞের দীক্ষা, ত্যাগ ও নির্দেশনার ফলেই ইবনে আসাকির (রহ.) গড়ে ওঠেন বিজ্ঞ আলেম হিসেবে। রিজাল শাস্ত্রের ইমাম হাফেজ জাহাবি (রহ.) বলেন, তিনি সরাসরি শ্রবণের (সামা’) মাধ্যমে ১,৩০০ জন শাইখের কাছ থেকে হাদিস শুনেছেন। ৪৬ জন শাইখ তাঁকে কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন। অনুমতিক্রমে (ইজাজা) তিনি ২৯০ জন শাইখের কাছ থেকে হাদিস গ্রহণ করেছেন—এসব তথ্য তাঁর মুʿজাম গ্রন্থে সংকলিত।

এ ছাড়া ৮২-এর ও বেশি নারী শিক্ষিকা রয়েছেন, যাঁদের নামে ছোট একটি মুʿজামও রচিত হয়েছে।’ (ইমাম জাহাবি, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, ১৫/২৪৮, দারুল হাদিস, কায়রো, ২০০৬)

ছাত্ররা

লেখালেখি ও গবেষণার পাশাপাশি ইবনে আসাকির (রহ.) ছাত্রদের শিক্ষাদানেও তৎপর ছিলেন। তিনি ছাত্রদের কেবল তাত্ত্বিক (ইলমি) জ্ঞানেই নয়; প্রায়োগিক (আমলি) জ্ঞানেও দীক্ষিত করতেন। তাঁর এই ত্যাগ ও নিষ্ঠাই একদিন অসংখ্য ছাত্রকে যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে পরিণত করে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

১. আবুল ক্বাসেম আশ শিরাজি: তৎকালীন শাম প্রদেশের বিচারপতি ও ইসলামি চিন্তাবিদ।

৩. কাসেম বিন আলী: তৎকালীন দামেস্কের প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ ও আলেম।

৩. আবু সাদ আব্দুল কারিম আস সামআনি: খ্যাতিমান মুহাদ্দিস ও রাব্বানি আলেম; আল-আনসাব গ্রন্থের রচয়িতা।

৪. আবু জা’ফার আল-ক্বুরতুবি: হাদিস সংগ্রহ ও রেওয়ায়েতে শীর্ষস্থানীয়দের একজন। (ইমাম জাহাবি, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, ১৫/২৪৮, দারুল হাদিস, কায়রো, ২০০৬)

রচনাবলি

ইবনে আসাকির (রহ.)-এর রেখে যাওয়া সবচেয়ে অমূল্য সম্পদ তাঁর গ্রন্থগুলো। যুগে যুগে এ গ্রন্থগুলোই পাঠকদের প্রেরণা জুগিয়েছে এবং তাঁর গভীর জ্ঞান, গবেষণা-নৈপুণ্য ও বিদ্বত্তার সাক্ষ্য বহন করে আসছে।

তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ তারিখু মাদিনাতি দিমাশক্ব ৮০ খণ্ডে রচিত ইতিহাসবিষয়ক এক মহাকাব্যসম সংকলন। এতে দামেস্ক নগরীর ভৌগোলিক পরিচয়, ঐতিহাসিক বিকাশ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বিখ্যাত আলেম-মনীষীদের জীবনী অত্যন্ত বিশদভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

এ ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: আল মুয়াফাক্বাত, আল-আতরাফ লিস সুনানিল আরবাআ, ফাজলু আসহাবিল হাদিস, তাবয়িনু কিজবিল মুফতারি আলাশ শাইখ আবিল হাসান আল-আশআরি, কিতাবু ফাজলি মান লা ইয়া’মালু বিইলমিহি, মানাক্বিবুশ শুব্বান প্রভৃতি। (ইবনে ইমাদ, শাজারাতুজ জাহাব ফি আখবারি মান জাহাব, ৬/৩৯৬-৯৭, দার্ ইবনি কাসির, বৈরুত, ১৯৯১)

অন্তিম যাত্রা

হিজরি ৫৭১ সনের ১১ রজব, রোজ সোমবার ইহলোক ত্যাগ করেন এ মহান ইতিহাসবিদ। তাঁর মৃত্যুসংবাদে কেবল দামেস্কবাসীই নয়; পুরো বিশ্বই যেন থমকে দাঁড়ায়।

মুহাদ্দিস ইমাদ (রহ.) বলেন, ‘তিনি যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন প্রবল বৃষ্টি নেমে আসে। অথচ এর আগে টানা এক বছর কোনো বৃষ্টির দেখা মেলেনি। মনে হয় আকাশও তাঁর মৃত্যুতে ক্রন্দন করছিল।’ (ভূমিকা, তারিখু মাদিনাতি দিমাশক্ব, ১/২৪, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

দামেস্কের মাক্ববারায়ে বাবে সগিরে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। তিনি আপন পিতার পাশেই শায়িত হন। (ভূমিকা, তারিখু মাদিনাতি দিমাশক্ব, ১/২৪, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৫)

ইবনে আসাকির (রহ.) চলে গেছেন; কিন্তু তাঁর ইতিহাস, জ্ঞান ও লেখনী আজও অমলিন। যুগ যুগ ধরে এগুলোই তাঁকে প্রতিনিধিত্ব করছে এবং তাঁর অমরত্বের স্বীকৃতি দিচ্ছে।

রায়হান আল ইমরান : লেখক ও গবেষক

আরও পড়ুন