আল-মুহাদ্দিসাত ০১
ইতিহাসে লুকানো নারী হাদিস বর্ণনাকারীদের কাহিনী
কেমব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভি ৪৩ খণ্ডের একটি চরিতাভিধান রচনা করেছেন ইসলামের ইতিহাসে নারী হাদিস বর্ণনাকারীদের নিয়ে; যাদের বলা হয় ‘আল–মুহাদ্দিসাত’। ২০২১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটিতে প্রায় ১০ হাজার স্কলার নারীর জীবন–কর্ম স্থান পায়। লন্ডন মুসলিম সেন্টারের চ্যানেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন তিনি। অনুবাদ করেছেন মারদিয়া মমতাজ ও শরিফ সাইদুর।
যত দূর মনে পড়ে, ১৯৯৫ সালে আমি ইন্ডিয়ায় ছিলাম। তখন কিছু লেখালেখি করতাম, আরবিতে কিছু প্রবন্ধ লিখতাম। সে সময় টাইমস-এ এক ভদ্রলোক মুসলিম নারীদের নিয়ে এক সপ্তাহে বেশ কিছু লেখা দিচ্ছিলেন। তিনি বলার চেষ্টা করছিলেন যে ইসলাম আসলে জ্ঞান অর্জনের দিক দিয়ে নারীদের কত পশ্চাৎপদ করে রেখেছে!
আমার মনে হলো তার লেখায় তথ্যের অভাব আছে, মানুষ আসলে অনেক কিছু জানেই না। যেহেতু আমি হাদিসশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করতাম, জানতাম যে কত বিপুলসংখ্যক নারী হাদিসের শিক্ষকতা করেছেন, হাদিসচর্চাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
আমার মাথায় তখন কোনো পরিকল্পনা বা প্রস্তাব ছিল না। তবু ভাবলাম, নারীদের এই তথ্যগুলোকে একত্র করব। হয়তো বড়জোর দু-এক খণ্ডের একটা কাজ হবে। অন্তত এসব অপপ্রচার কিংবা ভুল–বোঝাবুঝির একটা জবাব দেওয়া যাবে। আরও একটা লাভের কথাও মাথায় এসেছিল যে এই বই থেকে মুসলিম নারীরা জ্ঞানের চর্চায় উৎসাহিত হবেন।
কাতার ইউনিভার্সিটিতে একটা বক্তৃতা দিই। ওখানে এক শ্রোতা বলেন, এ ধরনের কাজ আসলে নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষের একধরনের ষড়যন্ত্র।
যদিও জ্ঞানের অনেক শাখায় নারীরা আজকাল অনেক এগিয়ে গেছেন, কিন্তু ইসলামকে জানার দৌড়ে তাঁরা অনেকটা পিছিয়ে। হয়তো এমন একটা কাজ তাঁদের কোরআন ও হাদিসকে জেনে বিদুষী হতে উৎসাহ দেবে। শুরুতে ভাবতে পারিনি যে কাজটা এত বিশাল এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো আল্লাহ বরকত ঢেলে দিয়েছেন।
আমি শুধু কাজ করছিলাম আর নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছিল। মনে আছে, ২০১০ সালে কাতার গেলে শাইখ ইউসুফ কারজাভি আমাকে এ নিয়ে তাঁর মসজিদে কিছু বলতে অনুরোধ করেন। নারী বর্ণনাকারীদের বিপুল সংখ্যা দেখে তিনিও বিস্মিত হন এবং বলেন যেন আমি আপাতত এখানে ইতি টানি। নইলে কাজটি কোনো দিন একেবারে শেষ হবে না।
তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করি। একই সময়ে কাতার ইউনিভার্সিটিতে একটা বক্তৃতা দিই। ওখানে এক শ্রোতা বলেন, এ ধরনের কাজ আসলে নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষের একধরনের ষড়যন্ত্র। তো এভাবেই আসলে কাজটি শুরু হয়েছিল।
নারী হাদিস বর্ণনাকারীদের অনন্য বৈশিষ্ট্য
হাদিসচর্চার শুরু থেকেই বর্ণনাকারীদের জীবন নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। একটি হাদিসের উৎস বিশ্বাসযোগ্য কি না, তা আসলে বর্ণনাকারীর স্মৃতিশক্তি, জ্ঞান ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। মাকদিসির লেখা আল ক্বামাল ফি আসমাইর রিজাল। এ–বিষয়ক একটি গ্রন্থ। ইমাম মিজ্জি তাতে আরও তথ্য সংযোজন করে ৩৫ খণ্ডে আনেন এবং নাম দেন তাহজিবুল কামাল ফি আসমাইর রিজাল। খুব বেশি না হলেও তাতে কিন্তু কিছু নারীর উল্লেখ ছিল। এই সকল নামের অনুকরণে আমার বইয়ের নাম দেওয়া হলো আল–ওয়াফা বি আসমায়িন নিসা।
আমার বইটিতে ১০ হাজারেরও বেশি নারী হাদিসচর্চাকারীর কথা এসেছে, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। আপনি যদি আসমাউর রিজাল (হাদিস বর্ণনাকারীদের নিয়ে জ্ঞানের যে শাখা) দেখেন, দেখবেন, কয়েক শত বর্ণনাকারী পাওয়া যাবে যাঁরা হাদিসকে বিকৃত করেছেন; যেগুলোকে বলে ‘মাওযুআত’ (মনগড়া হাদিস)।
ভুল হতে পারে সবারই, কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে হাদিস বিকৃত করেছেন, কোনো একজন নারীর নামেও এমন অভিযোগ নেই। নারী হাদিস বর্ণনাকারীদের এটি একটি বড় গুণ।
অথচ সেই যে বিপুলসংখ্যক নারী হাদিস বর্ণনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে একজনকেও পাওয়া যায়নি যিনি হাদিস বর্ণনায় মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন বা মনগড়া হাদিস বর্ণনা করেছেন। যদিও তাঁরা বহু হাদিস বর্ণনা করে গেছেন। ভুল হতে পারে সবারই, কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে হাদিস বিকৃত করেছেন, কোনো একজন নারীর নামেও এমন অভিযোগ নেই। নারী হাদিস বর্ণনাকারীদের এটি একটি বড় গুণ।
নারীরা কেন হাদিস বিকৃত করেননি
এর একটা কারণ হতে পারে, জ্ঞানের প্রতিযোগিতা। পুরুষদের জন্য জ্ঞান ছিল মর্যাদা বাড়ানোর মাধ্যম, যার মাধ্যমে তাদের সামাজিক অবস্থান, প্রতিপত্তি এমনকি উপার্জনও বাড়তে পারত। এ জন্য হয়তো তাঁরা কিছু বানানো কথারও প্রচার করতেন।
হাদিসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য স্কলার ছিলেন আবু যুরা আর-রাজী, তাঁকে ইমাম বুখারির সমকক্ষ ভাবা হয়। ‘শাদ কুনি’ নামের একজনের সঙ্গে একবার তাঁর বিতর্ক হচ্ছিল যে কে বেশি হাদিস জানেন। তিন–চার দিন ধরে এই বিতর্ক চলল, কিন্তু দুজনই সমানভাবে এগিয়ে ছিলেন, কোনো মীমাংসা হচ্ছিল না।
একদিন শাদ কুনি একটি হাদিস বললেন, যা আবু যুরা জানতেন না। আবু যুরা হেরে গেলেন। তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না, কেন হাদিসটি তাঁর জানা নেই? পরে জানতে পারলেন, এমন কোনো হাদিসই আসলে নেই, শাদ কুনি মিথ্যা বলেছেন।
এ জন্য শাদ কুনিকে একমাত্র ‘হাফিজে হাদিস’ (হাদিসবেত্তাদের মর্যাদার একটি স্তর) বলা হয়, যিনি একবার মিথ্যা বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু নারীরা কখনো এ প্রতিযোগিতায় যাননি। নারীদের কাছে হাদিস বর্ণনার কাজটি ছিল কেবল ধার্মিকতার অংশ, ইসলামের খেদমত। আমার মনে হয় নারীরা মিথ্যা হাদিস থেকে দূরে থাকার এটা একটা কারণ।
মুহাদ্দিস নারীদের কর্ম সংকলন পদ্ধতি
শুরুতে আমি বিখ্যাত হাদিস সংকলনগুলো থেকে হাদিস নিয়েছি। বুখারি, মুসলিম, আবু দাঊদ, তিরমিজি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তা এসব গ্রন্থে যেসব নারী বর্ণনাকারীর সূত্রে হাদিস এসেছে, সেগুলো সংগ্রহ করেছি।
এরপর গবেষণায় আরও অগ্রসর হয়ে হাদিস বর্ণনাকারীদের জীবনী দেখতে শুরু করি। বিশেষ করে যেখানে প্রত্যেক হাদিসবেত্তা তাঁদের শিক্ষকের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন, যাদের থেকে তাঁরা হাদিস শিখেছেন বা বর্ণনা করেছেন। সেখান থেকেও আমি প্রচুর নাম পেয়েছি।
এ জন্য আমাকে সিরিয়া, হিজায, ইন্ডিয়া, তুরস্ক, উজবেকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন গ্রন্থাগার ও পাণ্ডুলিপি দেখতে হয়েছে।
এত নারীর নাম আমি পেয়েছি যে প্রচুর নাম বাদও দিতে হয়েছে। কারণ, গবেষণার জন্য যথেষ্ট সময় আমার ছিল না। যদি আমি আরও ১০ বছর সময় পাই, তাহলে আরো বিপুল হাদিস ও তার নারী বর্ণনাকারীদের নাম লিপিবদ্ধ করতে পারব। কেননা, এখন আমার অভিজ্ঞতা যেমন বেড়েছে, আবার আমার কাছে অনেক তথ্যও আছে।
সাধারণ সূত্রগুলোই আমি ব্যবহার করেছি। পার্সিসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অনেক তথ্য আছে, যা খুঁজতে পারিনি। মূলত আরবি ভাষার সূত্রই দেখতে পেরেছি।
নারী মুহাদ্দিসদের ভৌগোলিক অবস্থান
মুহাদ্দিস নারীরা সব মুসলিম–অধ্যুষিত এলাকাতেই ছড়িয়ে ছিলেন। স্পেন, আন্দালুস; উত্তর আফ্রিকার দেশ যেমন মরোক্কো, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মিশর; মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যেমন সৌদি আরব, শাম, ইরাক, বাগদাদ, কুফা, বসরা, ইরান, আফগানিস্তান, ভারত—সবখানে। আমি ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক বা মালয়েশিয়ার ভাষা জানি না, নিশ্চয়ই সেখানকার নারীরা হাদিসচর্চা করেছিলেন কিন্তু আমি তাঁদের তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে পারিনি।
বলা যায় এটি একটি প্রাথমিক প্রচেষ্টা। ভেবে দেখুন, ইমাম মিজ্জির তাহজিবুল ক্বামাল ফি আসমাইর রিজাল লেখার আগে সময় গেছে ৭৪০ বছরের বেশি, কেবল মূল হাদিস চর্চাকারীদের তথ্য সংকলন করেছেন তিনি। আমি যা শুরু করেছি, তারও পূর্ণতা আসতে অন্তত সাত–আটশ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
মানুষ এখনই নারীদের সংখ্যা জানতে চাইছে, কতজন ‘হাফিজা’ ছিলেন, কতজন বর্ণনাকারী ছিলেন ইত্যাদি। আমি তাঁদের বলতে চাই, আমাদের হাতে যা তথ্য আছে, তার ভিত্তিতে কিছুই করা যাবে না। আমাদের প্রচুর তথ্য প্রয়োজন, ব্যাখ্যা প্রয়োজন, তাঁদের জীবনী সংগ্রহ করা প্রয়োজন। তারপর এমন একটা অবস্থানে আমরা পৌঁছাব হয়তো, যখন এসব বিশ্লেষণ করতে পারব।
গবেষণার জন্য যথেষ্ট সময় আমার ছিল না। যদি আমি আরও ১০ বছর সময় পাই, তাহলে আরো বিপুল হাদিস ও তার নারী বর্ণনাকারীদের নাম লিপিবদ্ধ করতে পারব।
হাদিসচর্চায় জেন্ডার নিয়ে প্রচলিত ধারণা
বিভিন্ন অঞ্চল বা সংস্কৃতির চিন্তাচেতনা এক নয়। হোক মদিনা বলেন বা অন্য যেকোনো স্থানই, ‘ফিতনা’র শঙ্কা ইত্যাদি কারণে নারীরা সব সময় সমান সুযোগ পাননি। স্বামী কিংবা ভাইয়েরা নারীদের বিভিন্ন সময় নিরুৎসাহিত করেছেন।
সামআনি ষষ্ঠ শতকের একজন বড় পণ্ডিত ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি মার্ভে যাই। কারিমা নামের হাদিসে দক্ষ একজন নারীর কাছে হাদিস শেখার ইচ্ছা পোষণ করি। তাঁর ভাই নানা অজুহাত পেশ করতে শুরু করেন, আমার বোন ব্যস্ত ইত্যাদি। আমি তাঁর সাক্ষাৎই পাই নি, কয়েকজন প্রতিনিধি মারফত কিছু হাদিস শিখিছে মাত্র।’
দেখুন, পরিবারে একজন পুরুষ যদি মুহাদ্দিস থাকতেন, তাহলে তাঁর নাম প্রচার হতো। অথচ বিপরীত ঘটনা ঘটত যদি নারী মুহাদ্দিসা থাকতেন। তাঁর নাম গোপন করা হতো। শতাব্দিকাল ধরে তাই অনেক তথ্য গোপন থেকে গেছে, নারীদের কৃতিত্ব সম্পর্কে লোকজন আলোচনাও করতে চাইত না।
আমি চাই না, এমন চিন্তা আমাদের আটকে দিক, যা নারীদের জ্ঞান অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বরং তাঁদের উৎসাহিত করা দরকার, তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
আজকাল তো পর্দার আড়াল থেকে নারীরা হাদিসশাস্ত্র শিখবে, তা–ও উৎসাহিত করা হচ্ছে না। নেকাব পরা কোনো নারী কোথাও জ্ঞান অর্জনের জন্য বসতে পারেন, সে–চর্চা হারিয়ে যাচ্ছে। এ–কারণে তাঁদের নামও আর হাদিসের উৎস হিসেবে গ্রন্থিত হচ্ছে না।
আমরা এমন বর্ণনাও পাই যে অমুক নারীর সন্তান কান্না করায় তিনি ‘দরস’ ত্যাগ করেছিলেন এবং কিছু হাদিস শুনতে পারেননি। অর্থাৎ সে সময়ে নারীদের চেনা যেত, তাঁরা সন্তানসহ হাদিস শেখার দরসে আসতেন। এবং তা লিখে রাখার কাজ করতেন খুব বুদ্ধিমান শিক্ষার্থীরা, যাতে হাদিসের বর্ণনায় পরিশুদ্ধতা যাচাই করা সম্ভব হয়।