এআই কি কোরআনের সঠিক অনুবাদ করতে পারে
কোরআন আল্লাহর বাণী এবং এমন এক আধ্যাত্মিক সম্পদ যা শতাব্দীকাল ধরে মানুষের হৃদয়ে আনন্দ, ভয়, আশা ও সতর্কতার সঞ্চার করে এসেছে। এর শাস্ত্রীয় আরবি ভাষা এবং অতুলনীয় বাগ্মিতা এটিকে অনন্য করে তুলেছে। তবে অনারবি ভাষাভাষীদের কাছে কোরআনের বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুবাদ অপরিহার্য।
এই অনুবাদ প্রক্রিয়ায় শুধু শব্দের অর্থ নয়, আয়াতের গভীর অনুভূতি বা সেন্টিমেন্ট সংরক্ষণ করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), বিশেষ করে ট্রান্সফরমার ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (টিএলএম) এই ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো: এআই দিয়ে কোরআনের অনুবাদ করলে অনুভূতির সংরক্ষণ কতটা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে কতটা সঠিক অনুবাদ পাওয়া যাবে?
কামেল গানুন ও মোহাম্মদ আলসুহাইবানির গবেষণা কোরআনের সাতটি বিখ্যাত ইংরেজি অনুবাদে (পিকথল, ইউসুফ আলি, মুহসিন খান, সহিহ ইন্টারন্যাশনাল, শাকির, সরওয়ার, আরবেরি) অনুভূতির সংরক্ষণ বিশ্লেষণ করেছে।
কোরআনের অনুবাদে অনুভূতির গুরুত্ব
কোরআনের প্রতিটি আয়াত শুধু তথ্য বা নির্দেশ বহন করে না, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গভীর অনুভূতি। যেমন. জান্নাতের বর্ণনা (সুরা আর-রাহমান, আয়াত: ৪৬-৭৮) পাঠকের মনে আনন্দ ও আশা জাগায়, আবার জাহান্নামের সতর্কবাণী (সুরা আল-মুদ্দাসসির, আয়াত: ৩৫-৪২) ভয় ও সচেতনতা সৃষ্টি করে।
এই অনুভূতিগুলো কোরআনের আধ্যাত্মিক প্রভাবের মূল চালিকাশক্তি। যদি অনুবাদে এই অনুভূতি হারিয়ে যায়, তবে পাঠক কোরআনের পূর্ণ তাৎপর্য থেকে বঞ্চিত হন। ঐতিহ্যগতভাবে, মানুষের দ্বারা করা অনুবাদে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে অনুভূতির সংরক্ষণে সমস্যা হয়েছে। এআই তার দ্রুত ও ব্যাপক ডেটা বিশ্লেষণ ক্ষমতা নিয়ে, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা কার্যকর হতে পারে?
এআই অনুবাদ নিয়ে গবেষণা
কামেল গানুন ও মোহাম্মদ আলসুহাইবানির গবেষণা কোরআনের সাতটি বিখ্যাত ইংরেজি অনুবাদে (পিকথল, ইউসুফ আলি, মুহসিন খান, সহিহ ইন্টারন্যাশনাল, শাকির, সরওয়ার, আরবেরি) অনুভূতির সংরক্ষণ বিশ্লেষণ করেছে। তারা একটি সমান্তরাল ডেটাসেট তৈরি করেছেন, যাতে কোরআনের ৬,২৩৬টি আয়াতের আরবি ও ইংরেজি সংস্করণ রয়েছে।
এআই-এর ট্রান্সফরমার ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল এবং মানবিক যাচাইয়ের সমন্বয়ে তারা আয়াতের অনুভূতিকে ইতিবাচক, নেতিবাচক, এবং নিরপেক্ষ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন। তাদের ফলাফল কোরআনের অনুবাদে এআই-এর সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা বিস্তারিত প্রকাশ করেছে।
অনুভূতির সংরক্ষণ কতটা সম্ভব
গবেষণায় দেখা গেছে, আরবি কোরআন থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করলে সাধারণত নিরপেক্ষ অনুভূতি ৬৬ শতাংশ, নেতিবাচক ২৪ শতাংশ, এবং ইতিবাচক ১০ শতাংশ থাকে। ইংরেজি অনুবাদগুলোতে নিরপেক্ষ অনুভূতি ৫৯ শতাংশ থেকে ৭৪ শতাংশ, নেতিবাচক ১৪ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ, এবং ইতিবাচক ৮ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশ থাকে। এই ভিন্নতা থেকে বোঝা যায় যে, মানুষের করা অনুবাদেও অনুভূতির সংরক্ষণে অসঙ্গতি রয়েছে। এআই এই অসঙ্গতি বিশ্লেষণে কার্যকর হলেও, সরাসরি অনুবাদে এর ভূমিকা এখনো সীমিত।
এআই-এর টিএলএম মডেলগুলো কোরআনের সম্পূর্ণ আয়াত বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। এগুলো শব্দের প্যাটার্ন ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে অনুভূতি শ্রেণিবদ্ধ করে। তবে শাস্ত্রীয় আরবির রূপক, বহু-অর্থবাহী শব্দ এবং সাংস্কৃতিক গভীরতা এআই-এর জন্য চ্যালেঞ্জ।
যেমন, সুরা বাকারা (১২)-এ ‘আল-মুফসিদুন’ (দুর্নীতিবাজ) শব্দটি তীব্র নেতিবাচক অনুভূতি বহন করে। ইউসুফ আলির অনুবাদে এটি ‘মিসচিফ’ হয়ে নিরপেক্ষ হয়ে যায়, যা এআই সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারে। কিন্তু এআই নিজে যদি অনুবাদ করে, তবে এই সূক্ষ্ম অনুভূতি ধরতে পারে কিনা তা নির্ভর করে মডেলের প্রশিক্ষণ ডেটার উপর।
গবেষণায় মানবিক যাচাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আরবি আয়াতের ১১ শতাংশ (৭০৫টি) মানুষের দ্বারা যাচাই করা হয়েছে, কারণ এআই শাস্ত্রীয় আরবির সূক্ষ্মতা পুরোপুরি ধরতে পারেনি। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, এআই-এর বর্তমান প্রযুক্তি অনুবাদে সহায়ক হলেও, সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য নয়। ভবিষ্যতে, মিশ্র অনুভূতি শ্রেণি (যেমন, ইতিবাচক ও নেতিবাচকের সমন্বয়) এবং শাস্ত্রীয় আরবি ডেটাসেটে প্রশিক্ষণ দিয়ে এআই-এর কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব।
এআই-এর বর্তমান প্রযুক্তি অনুবাদে সহায়ক হলেও, সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য নয়। ভবিষ্যতে, মিশ্র অনুভূতি শ্রেণি এবং শাস্ত্রীয় আরবি ডেটাসেটে প্রশিক্ষণ দিয়ে এআই-এর কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব।
সঠিক অনুবাদে এআই কতটা কার্যকর
কোরআনের অনুবাদে সঠিকতা বলতে শুধু শব্দের অর্থ নয়, এর সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ধরে রাখাও বোঝায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ইংরেজি অনুবাদগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মতি অনুসারে মুহসিন খান ও সহিহ ইন্টারন্যাশনাল ‘মাঝারি থেকে ভালো’। কিন্তু আরবি কোরআনের সঙ্গে তুলনায় কোনো অনুবাদই ‘মাঝারি’ বা ‘ভালো’ সম্মতি অর্জন করেনি। চারটি অনুবাদ (পিকথল, শাকির, সরওয়ার, মুহসিন খান) শুধু ‘সাধারণ সম্মতি’ পেয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, মানুষের করা অনুবাদেও সঠিকতার ঘাটতি রয়েছে।
এআই যদি সরাসরি কোরআনের অনুবাদ করে, তবে এর সঠিকতা নির্ভর করবে প্রশিক্ষণ ডেটা, মডেলের ক্ষমতা, এবং মানবিক তত্ত্বাবধানের উপর। বর্তমানে, এআই মেশিন অনুবাদে (যেমন, গুগল ট্রান্সলেট) সাধারণ পাঠ্যের জন্য ভালো ফল দেয়, কিন্তু কোরআনের শাস্ত্রীয় আরবি এবং এর ধর্মীয় গভীরতার জন্য এটি পর্যাপ্ত নয়। উদাহরণস্বরূপ, সুরা আস-সাফফাত (আয়াত: ৪৯)-এ ‘বাইদুন মাকনূন’ (লুকানো ডিমের মতো) রূপকটি পবিত্রতা ও মূল্যবানতার ইতিবাচক অনুভূতি বহন করে। পিকথলের অনুবাদে এটি নিরপেক্ষ হয়ে যায়। এআই এই রূপকের অর্থ ধরতে পারে, কিন্তু এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বোঝার জন্য ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
গবেষণায় এআই-এর একটি শক্তি হলো এর বিশ্লেষণ ক্ষমতা। এটি কোরআনের সম্পূর্ণ আয়াত বিশ্লেষণ করে অনুভূতির অসঙ্গতি শনাক্ত করতে পারে, যা মানুষের জন্য সময়সাপেক্ষ। কিন্তু অনুবাদে সঠিকতার জন্য এআই-কে ধর্মতাত্ত্বিক ও ভাষাগত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।
এআই-এর সম্ভাবনাও অপার। গবেষণায় দেখা গেছে, টিএলএম মডেলগুলো ৮৯% আরবি আয়াতের অনুভূতি সঠিকভাবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে, যা মানবিক যাচাইয়ের পর নিশ্চিত হওয়া গেছে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
কোরআনের অনুবাদে এআই-এর প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো ৩টি:
১. শাস্ত্রীয় আরবির জটিলতা: আরবির রূপক, বহু-অর্থবাহী শব্দ, এবং বাগ্মিতা এআই-এর জন্য বোঝা কঠিন।
২. সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট: কোরআনের অনেক আয়াতের অর্থ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভর করে, যা এআই-এর ডেটা-চালিত পদ্ধতির জন্য চ্যালেঞ্জ।
৩. অনুভূতির সূক্ষ্মতা: একটি আয়াতে একাধিক অনুভূতি (যেমন, আশা ও সতর্কতা) থাকতে পারে, যা বর্তমান এআই মডেলগুলো পুরোপুরি ধরতে পারে না।
তবে এআই-এর সম্ভাবনাও অপার। গবেষণায় দেখা গেছে, টিএলএম মডেলগুলো ৮৯% আরবি আয়াতের অনুভূতি সঠিকভাবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে, যা মানবিক যাচাইয়ের পর নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ভবিষ্যতে উন্নতির এআই আরও কার্যকর হতে পারে শাস্ত্রীয় আরবি এবং কোরআনের ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে প্রশিক্ষিত ডেটাসেট তৈরি করা, একাধিক অনুভূতির সমন্বয় ধরতে সক্ষম মডেল নির্মাণ এবং অনুবাদক ও ধর্মতাত্ত্বিকদের সঙ্গে এআই-এর সমন্বয় করা মাধ্যমে।
সূত্র: ন্যাচার ডটকম