দোয়া কবুলের কিছু শর্ত ও আদব
মোবাইল সিমের একটি ছোট অফার নিলেও সেখানে থাকে নানা শর্ত। ‘শর্ত প্রযোজ্য’—এই ছোট্ট বাক্যটি আমাদের চোখে পরিচিত। অথচ আমাদের প্রতিপালক আমাদের এমন অসংখ্য নিয়ামত দিয়েছেন, যার জন্য কোনো বিল, কোনো শর্ত, কোনো মূল্য তিনি চাননি। আল্লাহর দয়া এমন সর্বজনীন—যারা তাঁর আনুগত্য করে না, তাঁর অবাধ্য হয়ে জীবন চালায়, তাদের জন্যও এই দয়া কমে যায় না।
তা সত্ত্বেও রবের কিছু কিছু বিশেষ অনুগ্রহ আছে, যা আমরা শুধুই দোয়ার মাধ্যমেই চাই। এই বিশেষ প্রার্থনার জন্য অবশ্যই কিছু আদব ও শর্ত আছে। এই শর্তগুলো যত ভালোভাবে পালন করা হবে, দোয়া কবুলের সম্ভাবনাও ততটাই বেড়ে যাবে।
নিচে দোয়া কবুলের সেই গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ও আদবগুলো তুলে ধরা হলো:
যখন প্রার্থনা করবে, তখন শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে এবং যখন সাহায্য চাইবে, তখন শুধু আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৫১৬
১. একমাত্র আল্লাহর কাছেই দোয়া করা
যে বিষয় মানুষের সাধ্যের বাইরে, সেটা আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছে চাওয়া যাবে না। সব বিষয়ে তাওয়াক্কুল করতে হবে একমাত্র রবের ওপর।
রাসুল (সা.) ইবনে আব্বাস (রা.)–কে বলেছেন, ‘যখন প্রার্থনা করবে, তখন শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে এবং যখন সাহায্য চাইবে, তখন শুধু আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৫১৬)
কারণ, আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যেমন ধারণা করে, আমি তেমনই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭,৪০৫)
তাই আমাদের অন্তরে এ দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে—আমাদের প্রতিপালক সবকিছুর মালিক, সব ধরনের রিজিক দেওয়ার মালিক, অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা তাঁর হাতেই।
২. দোয়া কবুল হবে—এ বিশ্বাসে অটল থাকা
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এমনভাবে দোয়া করতে হবে, যেন আমরা নিশ্চিত থাকি যে একদিন না একদিন আমাদের দোয়া কবুল হবেই। কারণ, আমরা যার কাছে দোয়া করছি, তিনি তো দয়াশীল প্রতিপালক, বান্দার প্রার্থনারত দুই হাত শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে তিনি লজ্জাবোধ করেন।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা দোয়া কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে দোয়া কর।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩৪৭৯)
এই বিশ্বাস যত গভীর হবে, আমাদের দোয়া তত শক্তিশালী হবে।
৩. দোয়ার শুরুতে ও শেষে হামদ ও দরুদ পড়া
দোয়ার শুরুতে হামদ (আল্লাহর প্রশংসা) ও দরুদ পড়া দোয়া কবুলের একটি বড় আদব। ইবনে মাসউদ (রা.) নামাজের বৈঠকে প্রথমে হামদ, তারপর দরুদ এবং শেষে নিজের জন্য দোয়া করলে রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘এখন চাও, তোমার প্রার্থিত বস্তু তোমাকে দেওয়া হবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৪৭৬)
ওমর (রা.) বলেন, ‘দোয়া আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানে থেমে থাকে; যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা নবীর ওপর দরুদ পড়বে না, ততক্ষণ দোয়া ওপরে উঠবে না।’ (অর্থাৎ দরুদ ছাড়া দোয়া আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না।)
তোমরা জেনে রাখো, আল্লাহ কোনো গাফেল অন্তরের দোয়া কবুল করেন না।
শাইখ আহমাদ মুসা জিবরিলের কথাটিও গুরুত্বপূর্ণ, ‘দোয়ার শুরু ও শেষে নবীজির প্রতি দরুদ পাঠ করুন। আবু সুলাইমান আদ–দারানি একটি সুন্দর কথা বলেছেন, নবীজির ওপর দরুদ পড়ে দোয়া শুরু করুন এবং দরুদ পড়ে দোয়া শেষ করুন। কেন? নবীর প্রতি দরুদ পড়লে তা এমনিই কবুল হয়। আর আল্লাহ কোনো দোয়ার শুরু ও শেষের অংশ কবুল করে মাঝের অংশ প্রত্যাখান করবেন, এমনটি হতে পারে না।’ (ধূলিমলিন উপহার; রামাদান, পৃ: ৭৫)
৪. খাদ্য ও রিজিক হালাল থাকা
দোয়া কবুলের একটি উল্লেখযোগ্য শর্ত হচ্ছে খাদ্য ও পোশাক হালাল হওয়া। হারাম খাদ্য, হারাম আয়ের পোশাক, হারাম ভরণপোষণ—এগুলো দোয়া কবুল হওয়ার ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকিদের থেকেই কবুল করেন।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ২৭)
ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘হারাম ভক্ষণ করা দোয়ার শক্তিকে নষ্ট করে দেয় ও দুর্বল করে দেয়।’
তাই রিজিকে হালাল থাকা দোয়া কবুলের মৌলিক শর্ত।
৫. মনোযোগ ও ইখলাস থাকা
দোয়া কোনো মুখস্থ বাক্য নয়, এটি হতে হবে হৃদয়ের আন্তরিক নিবেদন। কোনো উদাসীন হৃদয়ের দোয়া আল্লাহ গ্রহণ করেন না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা জেনে রাখো, আল্লাহ কোনো গাফেল অন্তরের দোয়া কবুল করেন না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৪৭৯)
তাই দোয়া করার সময় আমাদের মন, চিন্তা, ইচ্ছা—সবকিছু একমাত্র আল্লাহর দিকেই নিবদ্ধ রাখতে হবে।
৬. দোয়ার মধ্যে সীমালঙ্ঘন না করা
আল্লাহ তাআলা দোয়ার মধ্যে সীমালঙ্ঘন করা পছন্দ করেন না। মানুষের ক্ষতি কামনা করা, রক্তের সম্পর্কচ্ছেদকারীর দোয়া, হারাম চাওয়া—এসব দোয়া তিনি কবুল করেন না।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাকো; নিশ্চয় তিনি সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৫৫)
রাসুল (সা.) এ সম্পর্কে বলেন, ‘যখন কোনো মুসলিম পাপ ও আত্মীয়তা নষ্ট করা ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তখনই আল্লাহ তার প্রার্থনা পূরণ করে তাকে তিনটি বিষয়ের একটি দান করেন:
(১) হয় তার প্রার্থিত বস্তুই তাকে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেন
(২) অথবা তার দোয়াকে তার আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করে রাখেন
(৩) অথবা দোয়ার পরিমাণে তার অন্য কোনো বিপদ তিনি দূর করে দেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৫৭৩)
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে শর্ত পূরণ করলে কোনো না কোনো সময় যেকোনোভাবে দোয়া কবুল হবেই।
মানুষের কাছে বারবার চাইলে মানুষ রেগে যায়, কিন্তু আল্লাহর কাছে না চাইলে তিনিই অসন্তুষ্ট হন।
৭. দোয়ার ফলাফলের জন্য তাড়াহুড়া না করা
ফুল ফোটে ধীরে, এর আগে গাছের অনেক পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। তেমনি দোয়ার ফলও সময়মতো আসে। তাড়াহুড়া করলে দোয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কারও দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাড়াহুড়া করে বলে যে, ‘আমি দোয়া করেছি, কিন্তু আমার দোয়া কবুল হয়নি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৩৪০)
৮. দোয়া ইউনুস পাঠ করা
দোয়া ইউনুস অর্থাৎ ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জোয়ালিমীন’ পড়ে দোয়া করলে দোয়া কবুলের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইউনুস (আ.) মাছের পেটে যে দোয়া করেছিলেন—লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জোয়ালিমীন, এ দোয়া দ্বারা যেকোনো মুসলিম যেকোনো বিষয়ে দোয়া করবে, আল্লাহ অবশ্যই তার দোয়া কবুল করবেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৫০৫)
শেষ কথা
দোয়া এমন এক শক্তি, যা আরশের অধিপতির কাছে পৌঁছে যায়। আমাদের প্রতিপালকের ভান্ডারে কোনো কিছুরই অভাব নেই। মানুষের কাছে বারবার চাইলে মানুষ রেগে যায়, কিন্তু আল্লাহর কাছে না চাইলে তিনিই অসন্তুষ্ট হন।
আসুন, আমরা ইখলাস, বিনয় ও তাওয়াক্কুল নিয়ে দোয়ার শর্তগুলো মেনে প্রতিদিন আল্লাহ তাআলার কাছে হাত পাতি। আল্লাহর আরশই একমাত্র স্থান, যেখানে হাত পাতায় কোনো লজ্জা নেই, মনটা বরং হালকা হয়ে যায়। তিনি যে আল–মুজিব! তিনি তাঁর বান্দার অন্তরের গভীর থেকে আসা দোয়াগুলো শুনেন, জানেন এবং সর্বোত্তমভাবে কবুল করেন।
ইসমত আরা : শিক্ষক, লেখক