আল্লাহর সান্নিধ্যের পথ একাকীত্ব

একাকীত্ব সর্বদা নেতিবাচক নয়ছবি: পেক্সেলস

মানুষ স্বভাবতই বন্ধুবৎসল এবং সামাজিক প্রাণী। আমরা প্রিয়জনদের সঙ্গে থাকতে, তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসি। তবে জীবনের যাত্রায় মাঝে মাঝে এমন মুহূর্ত আসে যখন একাকীত্বের ছায়া ঘনিয়ে আসে।

এই একাকীত্ব কখনো ক্ষণস্থায়ী, কখনো দীর্ঘস্থায়ী—কিন্তু এটি সর্বদা কষ্টকর নয়। অনেক সময়, ভিড়ের মাঝেও বা একই ছাদের নিচে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থেকেও অন্তরের গভীরে একঘেয়ে নীরবতা অনুভূত হয়।

সমাজতত্ত্ব এবং মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, একাকীত্ব প্রায়শই কষ্টদায়ক একটি অনুভূতি হিসেবে বিবেচিত হয়। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন (need to belong) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দীর্ঘমেয়াদি একাকীত্ব শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে—যেমন, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, ঘুমের সমস্যা, এমনকি হৃদরোগ এবং জ্ঞানীয় হ্রাসের ঝুঁকি বাড়ায়।

একাকীত্ব সর্বদা নেতিবাচক নয়। ক্ষণিকের জন্য এটি আমাদের নিজেকে জানার, অন্তরকে শুদ্ধ করার এবং আধ্যাত্মিকভাবে গভীরতা লাভের সুযোগ দেয়।

একটি রিভিউতে দেখা গেছে যে, শিশু ও কিশোরদের মধ্যে একাকীত্ব মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে যুক্ত। এছাড়া, একাকীত্ব মানসিক রোগ যেমন বিষণ্ণতা, অ্যালকোহল অপব্যবহার এবং ব্যক্তিত্ব-জনিত ব্যাধির কারণ হতে পারে। এমনকি সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জীবনকাল কমিয়ে দিতে পারে।

আরও পড়ুন

তবু একাকীত্ব সর্বদা নেতিবাচক নয়। ক্ষণিকের জন্য এটি আমাদের নিজেকে জানার, অন্তরকে শুদ্ধ করার এবং আধ্যাত্মিকভাবে গভীরতা লাভের সুযোগ দেয়। বিশেষ করে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে, একাকীত্বকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের একটি দরজা হিসেবে দেখা হয়।

মুফতি ইসমাইল মেন্‌ক বলেছেন, ‘আপনি যখন একাকীত্ব অনুভব করবেন তখন নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেবেন, আল্লাহ–তায়ালা অন্য সবাইকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন যেন তখন আপনার অন্তরে শুধু তিনিই থাকতে পারেন।’

দুনিয়ার চাকচিক্য এবং ব্যস্ততায় আমরা প্রায়ই প্রতিপালকের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করি। হয়তো তাই আল্লাহ আমাদের একা করে দেন, যাতে আমরা তাঁর কাছে ফিরে আসি। একাকীত্বে নিজেকে জানা, অন্তরকে হালকা করা এবং প্রতিপালকের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার বিকল্প খুব কম।

পূর্বসূরিদের বিভিন্ন লেখায় ‘একা থাকা’কে অপ্রত্যাশিত ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যায়।

পূর্বসূরিদের বিভিন্ন লেখায় ‘একা থাকা’কে অপ্রত্যাশিত ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যায়।

কিছুকালের জন্য একাকীত্ব মোটেও খারাপ নয়—বরং এটি মহা সুফল বয়ে আনতে পারে। যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করে, সে কখনো সত্যিকারের একাকীত্ব অনুভব করে না। একাকীত্বকে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করলে অন্তরে শান্তি এবং তৃপ্তি আসে।

মুসলিম সমাজে একাকীত্ব মোকাবিলায় আধ্যাত্মিক অনুশীলন, যেমন দোয়া এবং সাম্প্রদায়িক সংযোগ, একটি সমন্বিত পদ্ধতি হিসেবে সুপারিশ করা হয়।

আরও পড়ুন

একটি অন্তর শীতলকারী হাদিস এই একাকীত্বের মর্যাদা আরও উজ্জ্বল করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ তায়ালা সেদিন (কিয়ামতের দিন) তাঁর ছায়ার নীচে আশ্রয় দেবেন; যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কারো ছায়া থাকবে না। এর মধ্যে এক শ্রেণির মানুষ হচ্ছে—সে ব্যক্তি, যে একাকী অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে আর আল্লাহর ভয়ে তার দু’ চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৬০; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,০৩১)

কিছুকালের জন্য একাকীত্ব মোটেও খারাপ নয়—বরং মহা সুফল বয়ে আনতে পারে। যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করে, সে কখনো একাকীত্ব অনুভব করে না।

এই হাদিস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, একাকীত্ব যদি আল্লাহর স্মরণে রূপান্তরিত হয়, তাহলে এটি কিয়ামতের দিনের ছায়ার মতো একটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করে।

তো ভয় কী আর একা হতে! সবাই এসেছি একা, যেতে হবে তো একাই। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে একাকীত্বের স্বাদ নিন—সবার মাঝে থেকেও একা হয়ে যান। তখনই আপনি অনুভব করবেন আল্লাহর সান্নিধ্যে অন্তরের কতটা শান্তি।

হে আল্লাহ, আপনার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার জন্য একাকীত্বকে আমাদের জন্য প্রশান্তিকর করে দিন। আমরা যেন এই একাকীত্বকে কষ্টের পরিবর্তে আপনার নৈকট্যের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করি। আমিন।

আরও পড়ুন