মিনায় শেষ রাত, তাঁবুর ভেতরে জুম্মা

মিনায় তাঁবুর বাইরে নামাজ আদায় করছেন হাজিরা।ছবি: রয়টার্স

১১ জিলহজ বা ২৯ জুন২০২৩ বৃহস্পতিবার মাগরিবের সালাতও তাঁবুর ভেতর আদায় করলাম জামাতে। ওখানে মোটামুটি দলের সবাইকে পেলাম। সাব্বির ভাই সালাতে ইমামতি করলেন। ফরজ সালাত আদায়ের পর তিনি আমাদের উদ্দেশে বললেন যে মিনায় এটা বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত মানে শুক্রবার তথা জুম্মাবার শুরু হয়েছে। হয়তো জীবনে এ রকম আর সুযোগ নাও আসতে পারে। তাই আমরা যেন চেষ্টা করি একটু বেশি আমল-ইবাদত করতে। তিনি কিছু আমলের পরামর্শও দিলেন।

এদিকে ফরজ সালাত আদায় শেষে কয়েকজন সুন্নত সালাত পড়ছিলেন। সালাম ফিরিয়ে দুতিনজন সাব্বির ভাইকে ধমকাধমকি করলেন তাঁদের সালাতে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য। আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। সদ্য হজ আদায় করা মানুষ তাঁরা। এ কি রকম তাদের ব্যবহার? আল্লাহ মাফ করুন। তাঁরা থামার পর নজরুল ভাই শুধু বললেন, ’যার ইমামতিতে সালাত আদায় করলেন, তাঁকেই ধমকালেন?’

সালাতের পর আমি গেলাম হজ মিশন অফিসের তাঁবুগুচ্ছে। ওখানে ফেরদৌস ফয়সাল ছিল। ওকে বললাম যে রাতে মিশনের তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করতে। ও বলল, কোনো অসুবিধা নেই। রাতে ঘুমানোর আগে ১০টার দিকে চলে আসলেই হবে।

মিশনের তাঁবুগুচ্ছে একটায় আছেন চিকিৎসা সেবা দল, আরেকটায় হাজিদের হারিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন তথ্যাদি সংরক্ষণ ও হাজিদের বিভিন্ন পরামর্শ ও সহযোগিতার ব্যবস্থা। উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে আল-জাওহারাত সড়কমুখী হজ অফিসে খানিক পরপরই হাজিরা আসছেন। কেউবা মানচিত্র নিতে, কেউ বা হাজি হারানোর খবর জানতে বা জানাতে, কেউ বা ওষুধ নিতে। এখানে তথ্যসেবার জন্য কারিগরি ও প্রযুক্তির কাজ করছেন বিজনেস অটোমেশনের কয়েকজন কর্মী, বাংলাদেশ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে। হজকর্মীদের সঙ্গে বসে আমিও হাজিদের মিনার মানচিত্র বিতরণ করলাম, তাদের কথা শুনলাম। ভালো লাগলে যে হাজিদের সামান্য একটু খেদমত করার সুযোগ পেয়ে।

ইশার সালাত এখানেই আদায় করলাম। একটু পরে আমাদের তাঁবুতে গিয়ে রাতে খাওয়া সেরে এলাম। পরদিন জামারায় কখন কঙ্কর নিক্ষেপ করব, তা নিয়ে আমার সহধর্মিণীর সঙ্গে একটু মতবিরোধ হলো। আমি সকাল বেলা গিয়ে কঙ্কর নিক্ষেপের কথা বলেছিলাম এ জন্য যে ওজর থাকলে শেষদিন এটাও করা যায়। তবে আমার সহধর্মিণীর এককথা, জোহরের আগে তা করলে ওয়াজিব আদায় হবে না। ও আমার বড় মামা শ্বশুর শামসুল আলমের সঙ্গে টেলিফোনে এ নিয়ে একাধিকবার কথা বলল। তিনি বহু বছর রিয়াদে থাকেন। বেশ কয়েকবার হজ ও অসংখ্যবার ওমরাহ করেছেন। তিনিও জোর দিয়ে একই কথা বললেন। তাঁবুতে আরও কয়েকজনও একই কথা বললেন। আসলে সূর্য ঢলে যাওয়ার বা জোহরের ওয়াক্ত শুরুর পর থেকে কঙ্কর মারতে হবে। আগে মারলে হবে না, বরং দম দিতে হবে। সহধর্মিণীর কথা মেনে নেয়ায় হজের একটা ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া গেল। আল্লাহই রহম করেছেন।

দুই

রাতে মিশনের তাঁবুতে ফয়সালদের সঙ্গে ঘুমালাম নির্বিঘ্নে। ফজরের সময় যখন উঠতে গেলাম, তখন টের পেলাম সারা শরীর কি পরিমাণ ব্যথা হয়ে আছে। সালাত শেষে আবার ঘুম। ৯টার দিকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ওখানে নাশতা সারলাম। এরপর আমি ও ফেরদৌস ফয়সাল বেড়িয়ে আশেপাশে একটু ঘুরে দেখলাম। ততক্ষণে রোদ চড়তে শুরু করেছে। কেউ একজন আইসক্রিম বিতরণ করছিল। আমরা দুজনে দুটা আইসক্রিম খেলাম।

একটু পরে খবর এল যে গরমে হাজিরা অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাই বেলা ১১টা থেকে ২টা মিনার তাঁবু প্রাঙ্গণের সব ফটক আটকে দেওয়া হবে যেন কেউ বাইরে বা জামারায় না যান। আগের দিন এই সময়টায় সবচেয়ে বেশি গরম ছিল আর তখন অনেকেই অসুস্থ হয়েছেন। এমনকি মারাও গেছেন কয়েকজন। তবে আমাদের ও আরও কয়েক তাঁবু থেকে কেউ কেউ সকাল ১০টার মধ্যেই বেড়িয়ে পড়েছিলেন জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপের জন্য। আর সকালে নাশতার পর হজ মিশন অফিসে বসেই দেখছিলাম যে হাজিদের কেউ কেউ দলে দলে জামার দিকে চলেছেন।

এদিকে ১২ জিলহজ শুক্রবার। তাই কেউ কেউ মসজিদে খায়েফে গিয়ে জুম্মার সালাত আদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে ১১টা পর তাঁবু প্রাঙ্গণের ফটকগুলো আটকে দেওয়ায় অনেকেই যেতে পারলেন না। আমাদের তাঁবুর ভেতরেই জুম্মার সালাতের ব্যবস্থা করা হলো। কুমিল্লার এক মসজিদের ইমাম সাহেব এই সালাতে ইমামতি করলেন। জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা হলো।

আসলে হজের প্রতিটি ধাপই অনন্য এক অভিজ্ঞতা বয়ে আনে। হজের বিভিন্ন কাজকে হাল জমানার সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে বলা হয়: হজ হলো হলো কাবা প্রাঙ্গণে মুসলিম উম্মার বার্ষিক কুচকাওয়াজ; আরাফা ও মুজদালিফার প্রান্তরে মুসলিম উম্মার বার্ষিক সমাবেশ; এবং মিনার মালভূমিতে অস্থায়ী আবাসে রাতযাপন ও মিলেমিশে রাতের খাবার গ্রহণ। এসবের মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মার ভ্রাতৃত্ববোধ জোরদার হয়।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন