আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে সুরের লড়াই

দেবী দুর্গার ধর্মীয় মাহাত্ম্যের প্রথম উল্লেখ দেখা যায় শ্রীশ্রীচণ্ডীতে। সেখানে যে ধর্মীয় কাহিনি আছে, তাতে বলা আছে: রাজা সুরথ রাজ্য হারিয়ে আর সমাধি বৈশ্য ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে তাঁদের পরিবার-পরিজন কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে মনের দুঃখে গৃহত্যাগী হলেন। রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য কেউই কারও পূর্বপরিচিত নন। মনের দুঃখে তাঁরা দিগ্বিদিক ঘুরছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে একসময় দুজনের দেখা হলো মেথস মুনির আশ্রমে। সেখানেই তাঁদের কথা হয়। দুজনেই তাঁদের দুঃখ ও যন্ত্রণার কথা পরস্পরকে বলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরা দুজনেই দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে মা দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করলেন। সময়টা ছিল বসন্তকাল। চণ্ডীতে বলা আছে, মা দেবী দুর্গা তাঁদের আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেখা দিলেন এবং তাঁদের শোকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলেন। এই হলো দেবীপূজার মাহাত্ম্য।
শ্রীশ্রীচণ্ডীতে যে মেথস মুনির আশ্রমটির কথা বলা আছে, আশ্রমটির অবস্থান যেখানে থাকার কথা উল্লেখ আছে শ্রীশ্রীচণ্ডীতে, সেটি এখনো আছে নবগ্রামের বোয়ালখালী থানার করলডেঙ্গা গ্রামের করলডেঙ্গা পাহাড়ে। আশ্রমটি তেমনভাবেই আছে। বিশ্বাসীদের মতে, আগে এই অঞ্চলটি বেশ দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ছিল। এই স্থানের পর্যটনের গুরুত্ব অনেক। তাই কয়েক বছর ধরে এই স্থানের পর্যটন গুরুত্ব, ধর্মীয় গুরুত্ব উপলব্ধি করে, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের খানিকটা সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে।
আমি মনে করি, দেবী দুর্গার ধর্মীয় মাহাত্ম্য অনুযায়ী দেবী দুর্গার আবাহনের এই স্থানটির যথাযথ সংস্কার জরুরি। একই সঙ্গে নানা ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে পর্যটন করপোরেশন স্থানটিকে দর্শনার্থী, তীর্থযাত্রীদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। তাহলে বাংলাদেশ-ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে বহু দর্শনার্থী, তীর্থযাত্রী স্থানটি পরিদর্শনে আসতে পারবে। এতে বাংলাদেশ পর্যটন খাতটি আরও সমৃদ্ধ হবে।
বসন্তকালে দুর্গাপূজা হবে, এমনটাই যখন বলা আছে শ্রীশ্রীচণ্ডীতে, তখন এ ঘটনার ব্যতিক্রম দেখি রামায়ণে। রামায়ণে উল্লেখ আছে, রামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধারের জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেছিলেন। আর সময়টা ছিল শরৎকাল। তাই পরবর্তী সময়ে যখন শারদীয় দুর্গাপূজার ব্যাপক প্রচলন হয়, তখন এই পূজাকে আমরা বলি শারদীয় দুর্গোৎসব। সেই সঙ্গে অকালবোধন পূজা।
আমরা যদি শ্রীশ্রীচণ্ডীর মাহাত্ম্য বা রামচন্দ্রের অকালবোধন পূজার উদ্দেশ্যের দিকে তাকাই, দেখতে পাই দেবী দুর্গার আরাধনা, শক্তিরই আরাধনা। রাজা সুরথ আর রামের সময় আর পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও তাঁরা একই দেবীর পূজা করেন শক্তি সঞ্চয়ের জন্য। আর সেই শক্তিটি হলো শুভশক্তি। যে শক্তি আসুরিকতার বিরুদ্ধে, সব অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
আদিম যুগের পরবর্তী সময়ে যখন প্রস্তর যুগের সূচনা হলো, দেখলাম মানুষ পাথর দিয়ে বিভিন্ন জিনিস সৃষ্টি করে মনের ভাব প্রকাশ করতে শুরু করল। তার পরবর্তী সভ্যতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইট ও মাটি দিয়ে তৈরি জিনিসের প্রচলন শুরু হলো। তখন যে ভক্তিবাদের উন্মেষ ঘটেছিল, সেখানে মাটি দিয়ে তৈরি দেবীরই আরাধনা করতে শুরু করল মানুষ।
আমরা মিসরীয় সভ্যতা, মহেেঞ্জাদারো সভ্যতা, হরপ্পা বা ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, ভারত সভ্যতা, অথবা মধ্যপ্রাচ্যের সভ্যতার দিকে যখন তাকাই, সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে দেখতে পাই, সব সভ্যতাতেই বাসনকোসনের সঙ্গে মাটির তৈরি মূর্তিগুলোও পাওয়া গেছে।
এ দেশে মা দেবী দুর্গার মাটির তৈরি প্রতিমা গড়ে পূজার প্রচলন শুরু করেন রাজশাহীর তাহিরপুরে রাজা কংস নারায়ণ। সেটাও আজ থেকে প্রায় সাত-আট শ বছর আগের কথা। এর আগে দেবী দুর্গার মাটির মৃণ্ময়ী রূপের প্রচলন হতে দেখা যায়নি। রাজা কংস নারায়ণ প্রতিমা গড়ে যে পূজা করেছিলেন, সেখানে তৎকালীন সময়ে নয় লাখ টাকা খরচ করা হয়েছিল।
বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে যেসব রাজা-মহারাজা ছিলেন, তাঁদের একাংশ ছিলেন প্রজাদের প্রতি নিষ্ঠুর। আরেকাংশ প্রজাবৎসল। প্রজাবৎসল রাজারা যে শুধু প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন তা-ই নয়, প্রজাদের সঙ্গে মিলে তাঁরা দুর্গোৎসবের আয়োজনও করতেন। রাজারা এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই প্রজার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করতেন। এই উৎসবে রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন—সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতেন। ফলে রাজা আর প্রজার মধ্যে নৈকট্যের জন্ম হতো। এটি ছিল ভয়ের সংস্কৃতির বিপরীতে একটি সৌহার্দ্যের সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা। আর এই ধারাটা চলে এসেছে প্রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ কাল পর্যন্ত।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন রাজা-মহারাজাব্যবস্থা থাকল না, তখন দেখা গেল, সাধারণ বাঙালি একজোট হয়ে দুর্গাপূজা করছে। সেই সময় থেকেই দুর্গাপূজা সর্বজনীনতার রূপ নিল। তখন দুর্গাপূজা রাজার আঙিনা থেকে বেরিয়ে সাধারণের আঙিনায় চলে এল।
বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। বাঙালির জীবন ইতিহাসে দেখা যায়, বাঙালি কখনো কারও ওপর আগ্রাসী ভূমিকা পালন করেনি। চিরকাল তারা আগ্রাসিত হয়েছে। এর কারণে বাঙালির জীবনে দুঃখ এসেছে, বিপর্যয় এসেছে, হাসি-কান্না-বেদনার দিন এসেছে। পরবর্তী সময়ে এই কান্না, দুঃখ, বিপর্যয় থেকে উত্তরণের জন্য নতুন করে প্রাণোদ্যম ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেছে উৎসবের মাধ্যমে। সেটা আজও অব্যাহত। বাংলার যেমন ষড়্ঋতু আছে। আছে সেই ঋতুগুলোর বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য আর কোথাও দেখা যায় না। আর প্রতি ঋতুতেই বাঙালির উৎসব আছে। উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালির বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আছে। সংকীর্ণতা ভুলে বাঙালি পরিসরে একাকার হওয়ার চেষ্টা করে এ অঞ্চলের জনগণ। এ জন্যই আমরা বলি, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ।
প্রত্যেক বাঙালির যার যার ধর্ম আছে। ধর্মাচার আছে। কিন্তু সব ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মাচারের পাশাপাশি ধর্মীয় উৎসব আছে। এখান থেকে আমরা উচ্চারণ করতে পারি: ধর্ম যার যার উৎসব সবার। চট্টগ্রামে যে পাড়ায় আমি থাকি, তার নাম দেওয়ানজি পুকুরপাড়। এই এলাকায় মূলত হিন্দু সংখ্যালঘুদের বাস। এই পাড়ার নিকটতম প্রতিবেশী ছিল আজকের বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানদের পরিবার। একবার সরস্বতী পূজা উপলক্ষে পাড়ায় যে কমিটি হয়েছিল, সেই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। বিএনপির সাবেক মন্ত্রী। বর্তমানে তিনি দলটির ভাইস চেয়ারম্যান। আবার কলাবাগানে যে সর্বজনীন দুর্গোৎসব হচ্ছে, এই উৎসবের সূচনা ও আয়োজনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন সেই এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। তঁারাই এলাকার হিন্দুদের একত্র করে এই উৎসবের আয়োজনে উৎসাহিত করেছেন। সেই থেকেই কলাবাগান সর্বজনীন দুর্গোৎসব হয়ে আসছে। এটা খুব বেশি দিনের কথা নয়।
আমরা লক্ষ করি, শারদীয় দুর্গাপূজা হিন্দুধর্মাবলম্বীরা করে। গৌতম বুদ্ধের জন্মদিনে বুদ্ধপূর্ণিমা বা খ্রিষ্টের জন্মদিনে ক্রিসমাস ডে করে, সবই আবহমানকাল থেকে বাঙালির সংস্কৃতির একটি রূপ।
আরেকটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য, মা দুর্গার যে কাঠামো, রাষ্ট্র ও সমাজকে প্রতিফলন করে এ কাঠামো। আসুরিক শক্তির প্রভাবে যখন স্বর্গ থেকে দেবতারা চ্যুত হয়ে গেলেন, তখন তাঁরা আসুরিক সংস্কৃতির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মা দুর্গার আরাধনা করলেন। দেবতাদের মিলিত আরাধনার মাধ্যমেই তো মা দুর্গার আবির্ভাব। দেবতাদের যাঁর হাতে যা ছিল, তা-ই কিন্তু মায়ের হাতে স্থান পেল। রাষ্ট্র ও সমাজেরও তেমনি আসুরিক শক্তি আছে। আসুরিক অত্যাচারে মানুষ যখন ভয়ে থাকে, যখন উৎপীড়নের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা থেকে উত্তরণের জন্য বাঙালি যুদ্ধ করে। ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে বাঙালি যখন যূথবদ্ধ হয়ে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখে, এই অবয়বটি মা দুর্গার কাঠামোতে আছে।
অসুরের সঙ্গে মা দুর্গার যে লড়াইটি হয়েছিল, তাতে আসুরিক শক্তির পরাজয় ঘটেছিল। দেখা যায়, যখনই আসুরিক শক্তির পরাজয় ঘটল, সেখানে যে সমাজকে দেখি, লক্ষ করি জ্ঞানের প্রতীক সরস্বতী, ধনের প্রতীক লক্ষ্মী, জনগণের প্রতীক গণেশ আর বীরের প্রতীক কার্তিক। তার মানে জনতা, জনগণ, ধ্যানজ্ঞান ও বীরের মধ্য যে রাষ্ট্রকাঠামো, এটা হলো শান্তি-সৌহার্দ্য বিনির্মাণের রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামো।
এই কাঠামো বিনির্মাণের জন্যই তো ঐক্যবদ্ধ বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেছে। কিন্তু এই স্বপ্নের বাংলাদেশ স্বাধীনতার চার দশক পর আজও আসেনি। আসুরিক শক্তি আজও সমাজে বর্তমান। পাশাপাশি শুভশক্তিও অবস্থান করছে। তাই আসুরিক শক্তির সঙ্গে শুভশক্তির বারবার সংঘর্ষ হচ্ছে, লড়াই হচ্ছে। তাই সময়ের বিচারে শারদীয় পূজা এখনো প্রাসঙ্গিক। ভবিষ্যতেও থাকবে। এই পূজার মাহাত্ম্য কখনো শেষ হওয়ার নয়।
রানা দাশগুপ্ত: সাধারণ সম্পাদক, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ।