মেয়েদের শিক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও আমাদের করণীয়

ডিআরআরএ, পপি ও প্রথম আলোর আয়োজনে এবং মালালা ফান্ডের সহযোগিতায় ‘মেয়েদের শিক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩। আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশ হলো।

অংশগ্রহণকারী

রাশেদা কে চৌধূরী

নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান; সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

লুৎফুন নেসা খান

সংসদ সদস্য

মোশাররফ তানসেন

কান্ট্রি ডিরেক্টর, মালালা ফান্ড 

ফরিদা ইয়াসমীন

নির্বাহী পরিচালক, ডিজঅ্যাবল, রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (ডিআরআরএ) 

তানিয়া হক

অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দিলারা জাহিদ

সহযোগী অধ্যাপক ও পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শামীমা সিদ্দিকী

শিক্ষাবিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

মোরশেদ আলম সরকার

নির্বাহী পরিচালক, পপি

নিশাত সুলতানা

ডিরেক্টর-পলিসি, অ্যাডভোকেসি, ইনফ্লুয়েন্সিং অ্যান্ড ক্যাম্পেইন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ

ইলিরা দেওয়ান

মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন

শারমিন কবির

প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ঋতু

স্বপ্না রেজা

উপদেষ্টা, ডিজঅ্যাবল, রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (ডিআরআরএ) 

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যে আছে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে সমস্যা অনেক বেশি। এসব অঞ্চলে লবণাক্ততা থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উপকূল, পাহাড়ি ও দুর্গম অঞ্চলের মেয়েদের সমস্যা অনেক বেড়ে যায়। অনেক দূর থেকে মেয়েদের পানি আনতে হয়। আরও বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে তাদের যুক্ত থাকতে হয়। এ জন্য এসব অঞ্চলের মেয়েরা শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ে। তাদের শারীরিক, মানসিক সব ধরনের ক্ষতি হয়। সংসারের প্রায় সব কাজ মেয়েদের করতে হয়। ফলে তাদের লেখাপড়ার সুযোগ কমে যায়। এসব ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, যেন মেয়েরা শিক্ষা থেকে ঝরে না পড়ে।

মোশাররফ তানসেন

মালালা ফান্ড স্বপ্ন দেখে বিশ্বের প্রতিটি মেয়েশিশু তার ১২ বছরের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারবে। এই শিক্ষা হবে অবৈতনিক, নিরাপদ ও গুণগত। মালালা ফান্ড বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৯টি দেশে বিভিন্ন পার্টনার অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে কাজ করছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশে মালালা ফান্ডের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে মালালা ফান্ডের দুই ধরনের কার্যক্রম রয়েছে। ‘এডুকেশন চ্যাম্পিয়ন নেটওয়ার্ক’ কর্মসূচির আওতায় গণসাক্ষরতা অভিযান, ফ্রেন্ডশিপ, জাগো ফাউন্ডেশন, পপি , ডি-আরআরএ, বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক এবং এফআইডিডিবি মেয়েদের শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। অন্যদিকে অরোধ্য, বাদাবন সংঘ, ফ্যামিলি টাইজ ও পিসাইকেল কাজ করছে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দূরীকরণের লক্ষ্য নিয়ে।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সরকারি সূত্র অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরে ভর্তিকৃত মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৯ শতাংশ ছেলে, ৫১ শতাংশ মেয়ে। আর মাধ্যমিকে ৪৬ শতাংশ ছেলে, ৫৪ শতাংশ মেয়ে। কিন্তু মাধ্যমিকে ছেলে ও মেয়ের ঝরে পড়ার গড় হার ৩৬ শতাংশ। মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়া মেয়েদের ৪০ শতাংশ দশম শ্রেণি বা এসএসসি পাসের আগেই ঝরে পড়ে। তারা কর্মোপযোগী কোনো দক্ষতাও শিখতে পারছে না। ফলে শিক্ষাকে তারা কাজে লাগাতে পারছে না।

গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ভৌগোলিক অঞ্চলে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি। বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশে মেয়েদের শিক্ষার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ বছর আগের তুলনায় বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপকতা সাত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু ও পরিবেশের পরিবর্তন শিক্ষার জন্য ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি তৈরি করছে।

শিক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভার রয়েছে। প্রত্যক্ষ প্রভাব হলো অবকাঠামোর ক্ষতি, শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনে সমস্যা ইত্যাদি। অন্যদিকে পরোক্ষ প্রভাব হলো, শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, স্থানান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সমস্যা ইত্যাদি। 

জলবায়ু পরিবর্তন ও ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মেয়েশিক্ষার্থীরা অপুষ্টির শিকার হতে পারে। গৃহস্থালিকাজে নিয়োজিত হয়ে পড়তে পারে। তাদের ওপর পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং বাল্যবিবাহের শিকার হতে পারে। মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে যে সুবিধা পাওয়া যায়, তা থেকে যায় এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম পর্যন্ত। 

শারমিন কবির

আমরা মেয়েদের মাসিক ব্যবস্থাপনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি। সমাজে একজন মেয়ের বড় হওয়া নিয়ে আমরা কথা বলি না। এসব ক্ষেত্রে উপকূলীয় অঞ্চলে মেয়েদের সমস্যা অনেক বেশি। আমরা দেখেছি, সাতক্ষীরা অঞ্চলের মেয়েরা পিল খেয়ে মাসিক বন্ধ রাখে। একটা জরিপে এসেছে, মেয়েরা মাসিকের সময় তিন থেকে চার দিন স্কুলে যায় না। উপকূলীয় অঞ্চলের মেয়েদের সমস্যা আরও বেশি। এসব অঞ্চলের স্কুলের মেয়েদের মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য ভালো টয়লেট থাকে না। 

৫০ থেকে ৭০ জন ছেলেমেয়ে একটা টয়লেট ব্যবহার করে। এ জন্য একজন মেয়ে মাসিকের সময় স্কুলে যেতে সাহস পায় না। তারপর আমাদের সমাজটা এমন যে একটু কিছু হলেই প্রায় সবাই হাসাহাসি করে। মাসিক খুব স্বাভাবিক। এটা একটি শারীরিক প্রক্রিয়া। এটা নিয়ে লজ্জা বা হাসাহাসির কিছু নেই।

আমাদের মেয়েদের এখনো আত্মবিশ্বাসটা দিতে পারিনি। পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি বন্ধুসুলভভাবে আসেনি। আজকের উপস্থাপনায় এসেছে ৩৮ শতাংশ মেয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে পারছে না। তাদের পরিণতি কোথায় যাচ্ছে। এদের অধিকাংশই  নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে।

স্কুলে মাসিক অব্যবস্থাপনার জন্য মেয়েরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। আর এ জন্য তাদের অল্প বয়সে বিয়ে হচ্ছে। অনেককে বাধ্য হয়ে একাধিক সন্তানও নিতে হয়। এসব মেয়ের আয় নেই, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই। 

অথচ শিক্ষাই তাকে এই অবস্থা থেকে রক্ষা করতে পারত। একটা মেয়ে কখন বিয়ে করবে, কখন সন্তান নেবে, এটা তার অধিকার। অথচ সে এই অধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। এসব বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। 

নিশাত সুলতানা

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল মনে করে, জলবায়ু পরিবর্তন মূলত পাঁচভাবে মেয়েশিশুর জীবনকে প্রভাবিত করে। প্রথমত, মেয়েশিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়ে বা ঝরে পড়তে বাধ্য হয়; দ্বিতীয়ত, তারা বাল্যবিবাহের শিকার হয়; তৃতীয়ত, তারা নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়; চতুর্থত, তাদের অর্থ উপার্জনের সব পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং পঞ্চমত, তারা নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে।

জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব যেসব এলাকায় প্রবল, সেখানে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে হলে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মেয়েদের শিক্ষায় বিনিয়োগের তাগিদ অনুভব করা এবং বিনিয়োগের সদিচ্ছা থাকা।

আমরা বিভিন্ন মেগা প্রকল্প হাতে নিচ্ছি, অথচ নারীশিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় বিনিয়োগে কার্পণ্য করছি। মনে রাখতে হবে, নারীদের শিক্ষিত করলে ১০টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করার সমান সুফল আনা সম্ভব।

আরেকটি বিষয় বিবেচনায় আনা প্রয়োজন, সেটি হলো শিক্ষিত নারী জলবায়ু পরিবর্তনের রোধে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। আমরা দেখেছি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীরা গাছ লাগিয়ে, বীজ সংরক্ষণ করে কিংবা সবুজ বেষ্টনী রচনা করে পরিবেশ বিপর্যয় রোধে সক্রিয় হয়েছেন। তাই উপকূলীয় এলাকার মেয়েদের শিক্ষিত করতে ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে, বিনিয়োগ করতে হবে।

এ ছাড়া মেয়েদের স্কুলে ধরে রাখতে, বাল্যবিবাহ ঠেকাতে ও তাদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সমন্বিত ক্যাম্পেইন সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে জোরদার কাজ করছে।

শামীমা সিদ্দিকী

ইউনিসেফ শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে। এর মধ্যে অবশ্যই শিক্ষার অধিকার অন্যতম। মেয়েদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে এমনভাবে ক্ষমতায়ন করতে হবে, যেন তারা অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। আমরা সরকারের সঙ্গে এসব নিয়ে কাজ করছি।

জলবায়ুর প্রভাব স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার একটা বড় কারণ। এ ক্ষেত্রে ছেলেদের থেকে মেয়েরা বেশি ঝরে পড়ে। টুয়েলভ ক্লাস পর্যন্ত তারা যেতে পারে না। 

এটা যদি তারা পারত, তাহলে বাল্যবিবাহ কম হতো। ঝরে পড়া শিক্ষার্থী স্কুলে আসছে না, তাহলে কীভাবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেবে। আমরা তাদের জন্য বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। দুর্গম এলাকায়ও আমরা এই শিক্ষা নিয়ে যাচ্ছি, যেন তারা স্বাবলম্বী হতে পারে। আর যারা স্কুলে আছে, তাদের জন্য ‘কল্যাণ’, ‘তথ্যপ্রযুক্তি’ ও ‘জীবন জীবিকা’—তিনটি নতুন বিষয় যুক্ত করেছি। শিক্ষার্থীরা যখন ক্লাস নাইন ও টেনে পড়বে, তখন তাদের স্থানীয়ভাবে চাহিদার ভিত্তিতে কী কাজ করতে পারে, সেই ধরনের প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা বলা হবে। এভাবে তারা নিজেদের ক্ষমতায়নের দিকনির্দেশনা পাবে। জলবায়ুর প্রভাবে মানুষ স্থানান্তরিত হচ্ছে। ঢাকাসহ শহরে অনেক ছেলেমেয়ে রাস্তায় থাকে। তারা স্কুলে যায় না। আবার ভীষণ অনিরাপদ অবস্থায় আছে। তাদের জন্য কী করণীয়, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। তাদের জন্য একটা বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

এ ক্ষেত্রেও সরকারের সঙ্গে কী করা যায়, সেটা নিয়ে আমরা ভাবছি। কারিকুলামেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় এসেছে। এখান থেকেও শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। 

দিলারা জাহিদ

জলবায়ু পরিবর্তন এখন বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবিকা—সব ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি রয়েছে। 

চর, হাওর, উপকূল, পাহাড়, দুর্গম ও সীমান্ত এলাকার মেয়েদের অধিকাংশ শিক্ষার আওতায় আসছে না। তাহলে আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন করতে পারছি না। কিন্তু আমরা যদি এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাই, তাহলে এসব এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগে গড়ে এক মাস স্কুল বন্ধ থাকে। 

২০২২ সালে হাওরের বন্যায় একটা গবেষণা করেছিলাম। সেখানে একটা স্কুলের নাম ‘উজানিগাঁও’, আরেকটা স্কুলের নাম ‘জলকলম’। এই নাম থেকেই বোঝা যায়, কী পরিমাণ বন্যা হয়। বন্যার পানি নামতে প্রায় ১৫ দিন লেগে যায়। প্রায় ২০ দিন যায় কাদাপানি শুকাতে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর বই–খাতা নষ্ট হয়। এখানকার প্রত্যেকের পরীক্ষা পিছিয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের দাম অনেক বেশি ছিল। অভিভাবকেরা শিক্ষার্থীদের জীবিকার কাজে লাগিয়েছেন। এসবই বাস্তবতা। 

এ বছর সাতক্ষীরার শ্যামনগরে মেয়েদের ওপর একটা গবেষণা করেছি। সেখানে একটা বড় সমস্যা হলো লবণাক্ততা। এ জন্য তাঁদের আয় কমে যাচ্ছে। মেয়েদের শিক্ষাকে তাঁরা বাড়তি খরচ হিসাবে ধরে নিচ্ছেন। সরকার এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। শিক্ষা কারিকুলামে বিষয়টি আনা দরকার। 

বন্যা, দুর্যোগসহিষ্ণু স্কুল ভবন নির্মাণ করতে হবে। ইমার্জেন্সি শিক্ষা ফ্রেমওয়ার্কে বলা আছে কীভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চলবে, তহবিল কোথা থেকে আসবে, কারা শিক্ষা দেবেন ইত্যাদি। এসব বিষয় আছে; কিন্তু কার্যকর হচ্ছে না। এসব বিষয়ে এখন বিশ্বে প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। আমাদের বিষয়টি ভাবতে হবে।

ইলিরা দেওয়ান

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য দরকার বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা। পাহাড়ে সাধারণত বন্যা হয় না। প্রচুর বৃষ্টি হলেও তিন থেকে চার ঘণ্টায় পানি নেমে যায়। কিন্তু বান্দরবানে ভয়াবহ বন্যা হলো। এর কারণ হলো, জলবায়ুর পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন শুধু চর, হাওর বা উপকূলীয় অঞ্চলে নয়, পাহাড়সহ সর্বত্র এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আমাদের এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে। পাহাড়ের উন্নয়ন পরিকল্পনা চরাঞ্চলের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। 

আবার হাওরের উন্নয়ন পরিকল্পনা উপকূলের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। কোনো এলাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হলে সে এলাকার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলে বাস্তবসম্মত উন্নয়ন পরিকল্পনা হবে। কোভিডের সময় ডিজিটাল মাধ্যমে পড়ালেখা হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ে নেটওয়ার্ক ২জি বা ৩জি। এই নেটওয়ার্ক দিয়ে সেখানকার শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করতে পারেনি।

সাধারণত তাদের বাবা-মায়েরাও লেখাপড়া জানেন না। তাঁরা একটা স্মার্টফোন ঠিকভাবে চালাতেও পারেন না। সেখানে একটা শিশুকে দু–তিনটি পাহাড় পার হয়ে স্কুলে যেতে হয়। ফলে  পাহাড় এলাকার উপযোগী করে শিক্ষাপদ্ধতি চালু করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে ভালোভাবে জানাতে হবে। তাহলে তারা ভবিষ্যতে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী নির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় এখন পরিবার থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্র আলোচনায় আনতে হবে।

তানিয়া হক

শিক্ষার্থীদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ব্যাপক। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ভীষণ বিরূপ প্রভাব পড়ে। যেকোনো দুর্যোগ, সেটা মানুষের তৈরি হোক বা প্রাকৃতিক হোক, বিভিন্নভাবে নারীর ওপর প্রভাব ফেলে। দুর্যোগের সময় এটা আরও বেড়ে যায়। এ সময় বাড়ির নারী ও মেয়েশিক্ষার্থী সবাইকে কাজ করতে হয়। এ জন্য সে সময়মতো লেখাপড়া করতে পারে না। স্কুলে যেতে পারে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে দুর্যোগ এমন পর্যায়ে হয় যে স্কুলও বন্ধ থাকে। দুর্যোগের সময় নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। এ সময় গর্ভবতী নারী ও মেয়েদের ভীষণ সমস্যায় পড়তে হয়। অনেক ঘরে বিশুদ্ধ পানি থাকে না। বাড়িতে মাসিকের ব্যবস্থাপনা থাকে না। টয়লেটসহ অনেক রকম সমস্যায় তাদের
পড়তে হয়। 

সাইক্লোন, ঝড়, বন্যার সময় নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে সবাইকে একসঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হয়। এ পরিস্থিতিতে অভিভাবকেরা তাঁদের মেয়েদের বিয়ে দেওয়াকে সমস্যার সমাধান মনে করেন। এ সময় অভিভাবকেরা মেয়েদের নিয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। তাঁরা এ থেকে মুক্তি চান। এসবের সহজ সমাধান হলো, বিয়ে দেওয়া। 

আবার সাধারণভাবে সব নারী ও মেয়ের সমস্যা এক নয়। উপকূল, চর ও হাওরাঞ্চলের সমস্যা যত প্রকট, শহরের মেয়ে ও নারীদের সমস্যা তেমন নয়। ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে সমস্যা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এসব বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

স্বপ্না রেজা

আজ বাংলাদেশের যে উন্নয়ন, সেখানে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ আছে। আমরা একটা বিশেষ অঞ্চলের নারীদের শিক্ষা–স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলছি। তাঁরা ভবিষ্যতে কীভাবে উন্নতি করবেন। জলবায়ু পরিবর্তনে নারীদের সমস্যা থেকে কীভাবে রক্ষা করা যায়। কীভাবে তাঁরা শিক্ষায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সেটাই আজকের আলোচনা। আমরা কোন অঞ্চলের কথা বলছি। চর, হাওর, উপকূল, পাহাড়—এ ধরনের অঞ্চলের কথা বলছি। 

আমাদের যা কিছু উন্নয়ন হচ্ছে, এর প্রায় সবই শহরকেন্দ্রিক। যাঁরা সুবিধা পাচ্ছেন, তাঁদের আরও সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। নারীরা আসলে দরিদ্র নন। কোনো না কোনোভাবে তাঁরা পিছিয়ে যাচ্ছেন। সমাজব্যবস্থার জন্য, দৃষ্টিভঙ্গির জন্য নারীরা পিছিয়ে থাকছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছেন। তাহলে কী করতে হবে। গবেষণা করে সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে। কে পরিকল্পনা করবে, কীভাবে পরিবর্তন হবে—এসব ক্ষেত্রে খুবই হতাশাজনক চিত্র। 

দুর্গম অঞ্চলের নারীরা সব সময় বঞ্চিত হচ্ছেন। এখানে তাঁদের জন্য কিছু করতে হবে। এ জন্য কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে এমন জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বানানো হয় যে নদীতে বা ঝড়ে ভেঙে পড়ে। তাহলে কেন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অপরিকল্পিতভাবে বানানো হলো। এর কোনো জবাবদিহি নেই। 

অনেক মা–বাবা ইচ্ছা থাকার পরও কিন্তু তাঁদের মেয়েদের শিক্ষা দিতে পারছেন না। কারণ, অর্থের অভাব। ত্রাণ দিয়ে কখনো কাউকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেওয়া যাবে না। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে হলে স্বাবলম্বী হতে হবে। কোনো আইন দিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যাবে না, যদি তার মৌলিক চাহিদা পূরণ করা না যায়। আমাদের প্রত্যেকের সে কাজটি করতে হবে, যেন ব্যক্তির মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়। সে যেন নাগরিক সব সুবিধা পায়। তার পরিবার যেন একটি উন্নত জীবনের অধিকারী হয়। 

মোরশেদ আলম সরকার

নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে আমরা একটা নেতিবাচক সংস্কৃতি ধারণ করি। স্বামী-স্ত্রী চাকরি করে একই সঙ্গে বাসায় ফেরেন। পুরুষ খবরের কাগজ পড়েন। নারী তাঁর চা করে দেন। এভাবেই চলে আসছে। এই মানসিকতা থেকে বের হতে পারিনি। উত্তরাধিকার আইন শেষ মুহূর্তে বাতিল হলো। সেটা যদি কার্যকর করা যেত, তাহলে নারীদের সমস্যা অনেকটা কমে যেত। অসুখ হলে ওষুধ খাবেন। অসুখ প্রতিরোধের জন্য যদি কাজ না করেন, তাহলে সারা বছর অসুখ হতেই থাকবে। এই জায়গায় কাজ করতে হবে। সেটা না হলে যা-ই করি না কেন, সেগুলো তেমন কাজে আসবে না।

মেয়েশিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ে। এটা দুর্গম এলাকায় যেমন, সমতলে এর থেকে একেবারে আলাদা। হাওরে মাইলের পর মাইল কিছু নেই, শুধু পানি। সেখানে ছেলেমেয়েরা কীভাবে স্কুলে যাবে। এসব এলাকায় স্কুল অনেক কম। আবার কী ধরনের দুর্নীতি এখানে হয়, সেটা বোঝা অনেক কঠিন। একটা স্কুল হয়তো নদীতে ভেঙে গেল। খাতা–কলমে সে স্কুল, স্কুলের শিক্ষক ঠিক থাকে। উপস্থিতি ঠিক থাকে। এর সুযোগ-সুবিধা ঠিক থাকে। শুধু স্কুলটা থাকে না। 

সম্পদ ও তথ্য যার কাছে থাকবে, সে–ই শক্তিশালী। এটা আমাদের নারী ও মেয়েদের কাছে নেই। কারণ, তারা সেভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। উত্তরাধিকার আইন ঠিক হলে এ ক্ষেত্রে অনেক কাজ হতো। হাওর এলাকায় সরকার ভাসমান স্কুল দিতে পারে। আমরা পাঁচটি ভাসমান স্কুল চালাই। তবে আমরা প্রাথমিকের বেশি শিক্ষা দিতে পারছি না। 

হাওরে ভাসমান স্কুলের বিকল্প নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখানে অতিরিক্ত পানি আসবে, আবার কখনোবা শুকিয়ে যাবে। ভাসমান ক্লিনিক থাকা দরকার। গর্ভবতী নারী ও মেয়েশিশুদের অনেক জটিলতা থাকে। হাওরে দুর্যোগে প্রায় কোথাও যাওয়া যায় না। হাওরে ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স দরকার। তাদের উপযোগী করে শিক্ষা ক্যালেন্ডার করতে হবে। যোগাযোগের জন্য এখানে উড়ালসড়ক নির্মাণ করা যেতে পারে। 

ফরিদা ইয়াসমীন

আজকের গোলটেবিল আলোচনায় ১১ জন নারী। সরকার হয়তো মনে করে, একটা আলোচনায় এত নারী, তাহলে দেশে নারীদের কোনো সমস্যা নেই। আজকের আলোচনায় তিনটি জাতীয় বিষয় আছে। একটা হলো নারী, শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন। এ বিষয়গুলো একে অপরের সঙ্গে এত সম্পর্কিত যে একটা ছাড়া আরেকটা হয় না। সরকার ও পরিবার সেখানে বিনিয়োগ করে, যেখানে রিটার্ন আসে। অনেক পরিবার মনে করে, মেয়েশিশুর জন্য বিনিয়োগ করে লাভ নেই। কারণ, এখানে রিটার্ন আসবে না। 

একটা পরিবার কন্যার জন্য সময়, টাকা ও আবেগ বিনিয়োগ করে। এর বিনিময় অর্থনৈতিক সুবিধা পায় না। সামাজিক সুবিধা পায় না। একটা মেয়ে এত শিক্ষিত হচ্ছে, এত সংগ্রাম করছে, এর জন্য পরিবার যে সমাজ থেকে কোনো সুবিধা পায়, তা কিন্তু নয়। অধিকাংশ মেয়ে টুয়েলভ ক্লাস শেষ করতে পারে না। এর মানে হলো, একটা পরিবার একটা জার্নি শুরু করেছিল, কিন্তু সে সেই জার্নি শেষ করতে পারল না।

 সম্প্রতি আমরা একটা গবেষণা করেছি। ৬৯ শতাংশ মেয়ে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় ঝরে পড়ছে। তারা সবাই বিবাহিত। সরকার এসব বিষয় জানে। সরকার ও এনজিও ছাড়া এ বিষয়ে আর কেউ কাজ করবে না। 

নারীর উন্নয়ন, শিক্ষা, জলবায়ুর পরিবর্তন প্রতিটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দরিদ্র মেয়েরা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে। তালাকের সংখ্যা বাড়ে। কারণ, পরিবারের পুরুষ শহরে এসে আবার বিয়ে করেন। আগের স্ত্রীকে তালাক দেন। এসব গবেষণায় এসেছে। 

প্রতিবন্ধী মেয়েদের অবস্থা আরও খারাপ। কোনো প্রতিবন্ধী মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে তার শিক্ষা শেষ করতে পারে না। তারা একা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারে না। যত দিন মা কোলে করে স্কুলে নিতে পারেন, তত দিন সে পড়তে পারে। পঞ্চম শ্রেণির পর মায়ের পক্ষে এটা আর সম্ভব হয় না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সাহসী। আমরাও সাহসী। নারীর অধিকারের পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা দিতে হবে। নারীরা পিছিয়ে থাকলে দেশ কখনো উন্নত হবে না। নারীরা যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক মর্যাদায় এগিয়ে যেতে না পারেন, তাহলে দেশও পিছিয়ে পড়বে।

লুৎফুন নেসা খান

আজকের আলোচনায় জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে মেয়েশিক্ষার্থী ও নারীদের যে সমস্যা হয়, এর একটা সার্বিক চিত্র এসেছে।  আমি বাংলাদেশ সরকারের ডেল্টা প্ল্যান নিয়ে কিছু বলতে চাই। এই প্রথম সরকার ১০০ বছরের পরিকল্পনা করেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এটা বাস্তবায়ন করবে।  এটা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা। এটা বাস্তবায়িত হলে আজকের সমস্যাসহ দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন, নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন দুর্যোগে মেয়েদের শিক্ষায় ক্ষতি হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, উপযোগিতা না যাচাই করে কোনো প্রকল্প নেবেন না। হাওর এলাকায় স্কুলগুলো উঁচু করে নির্মাণ করছেন। এটা স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আশ্রয়কেন্দ্র হবে। 

জাইকাসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাওর ব্যবস্থাপনা হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেন, নারীদের কোনোভাবে পিছিয়ে রাখা যাবে না। সরকার আশ্রয়ণ প্রকল্প করেছে। পরবর্তী ধাপে কর্মসংস্থান করবে। 

পরিবারে অভাব না থাকলে মেয়েশিক্ষার্থী ঝরে পড়বে না। সব স্কুল নারীবান্ধব হতে হবে। মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটের আদেশ আছে। কোনো স্কুল না করলে এর জন্য সেই স্কুল কমিটি দায়ী। প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়েও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভীষণভাবে ভাবেন। 

মেয়েশিক্ষার্থী যেন ঝরে না পড়ে, সে জন্য মেয়েদের উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন ফোরামে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। আমিও সেসব আলোচনায় অংশ নিয়েছি। কিশোর-কিশোরী ক্লাব করা হয়েছে। বিভিন্নভাবে অভিভাবকদের বোঝানো হচ্ছে তাঁরা যেন মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ না করেন। অল্প বয়সে তাঁদের কন্যাদের বিয়ে না দেন ইত্যাদি। মেয়েরা যেন স্কুল থেকে ঝরে না পড়ে, সে জন্য সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ আছে। তবে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

রাশেদা কে চৌধূরী

অনেক বিষয় কারিকুলামে আনার কথা বলা হয়। একজন শিক্ষাকর্মী হিসেবে এটা আমার ভালো লাগে। আবার একটা আশঙ্কাও কাজ করে। শিক্ষার্থীদের জন্য কোন বিষয় কতটুকু আনা যাবে। অনেক জ্ঞানের কথা কঠিন ভাষায় লিখে দিলে হবে না। সহজ–সরল ভাষায় তাদের উপযোগী করে দিতে হবে। বিদেশের বইয়ে লেখাই থাকে এটা তৃতীয়, পঞ্চম, সপ্তম ইত্যাদি শ্রেণির জন্য। শিশু মনস্তত্ত্ব যাঁরা বোঝেন, তাঁদের দিয়ে ঠিক করতে হবে।

আবার দেখতে হবে যে কোন এলাকার বা কোন অঞ্চলের শিক্ষার্থী। উপকূল, চার, হাওর, পাহাড় ইত্যাদি প্রতিটি এলাকার শিশুদের বোঝার ক্ষমতা ভিন্ন। প্রতি এলাকার উপযোগী করে শিক্ষা উপকরণ দিতে হবে। 

সিলেটে বাল্যবিবাহের হার বেশি। জন্ম ও মৃত্যুহার বেশি। শিক্ষার হার কম। কারণ, এখানে হাওর আছে, চা–বাগান আছে। এসব বিবেচনা করেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আবার যে জনগোষ্ঠীর জন্য পরিকল্পনা করতে হবে, তাদের অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদের সমস্যা শুনে পরিকল্পনা করলেই কেবল ভালো পরিকল্পনা হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গত সপ্তাহের হিসাব ধরলে চারজনে একজন লেখাপড়া করে না। নিশ্চয়ই এখানে মেয়েরা বেশি হবে। আমাদের এক জরিপে এসেছে যে মায়েরা লেখাপড়া জানেন না, তঁাদের সন্তানদের ৪৮ শতাংশ পিছিয়ে যাচ্ছে। এর অর্থ হলো, নারীর শিক্ষায় বিনিয়োগ করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। 

প্রাইমারিতে মেয়েদের উপবৃত্তি দেওয়া হয়। পরে আমাদের ক্যাম্পেইনে দেখা গেল ছেলেরা পিছিয়ে যাচ্ছে। পরে ছেলেদেরও দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। কোভিডের সময় যেসব মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েছিল, আমরা তাদের স্কুলে ফিরে আনার ও বৃত্তি দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ এই বিনিয়োগে চার শ কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন হতো না। 

জলবায়ুর পরিবর্তনে মেয়েদের শিক্ষার যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি প্রজননস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। বন্যায় যখন চারদিক ভেসে যায়, তখন মেয়েরা বাথরুমে যেতে পারে না। পুরুষেরা তবু এখানে–সেখানে চলে যান। অনেক সময় তাঁদের ঘরের চালে আশ্রয় নিতে হয়। 

এই সময় মেয়েদের মাসিক হলে কী ভয়ানক অবস্থা হয়, সেটা সহজেই বোঝা যায়। এখানে স্থানীয় প্রশাসনের কতটুকু ভূমিকা নেয়, এ প্রশ্ন আমরা করতেই পারি। কিন্তু  প্রশ্ন করে কোনো লাভ হয় না। 

সবাই সমন্বিতভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে কেবল উন্নতি হতে পারে। 

ফিরোজ চৌধুরী

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে একটি ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আলোচনার পরামর্শগুলো নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বিবেচনা করলে নিশ্চয়ই অনেক সমস্যার সমাধান হবে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

সুপারিশ

■ চর, হাওর, পাহাড়, উপকূল এসব এলাকার উপযোগী করে শিক্ষাপদ্ধতি তৈরি করতে হবে। 

■ কন্যাশিশুদের শিক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

■ মেয়েদের শিক্ষা চালিয়ে নিতে দরিদ্র পরিবারের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা জরুরি।

■ জলবায়ু পরিবর্তন মেনে নিয়ে কীভাবে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যায়, সেটা বিবেচনা করতে হবে।

■ দুর্গম অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে যারা বাস্তুচ্যুত হয়, তাদের পুনর্বাসন দরকার।

■ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে।

■ মেয়েদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া রোধে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে।

■ মেয়েরা যেন লেখাপড়ার সুযোগ পায়, সে জন্য নারী-পুরুষ সবাইকে ঘরের কাজ করতে হবে।

■ বন্যাসহ বিভিন্ন দুর্যোগসহিঞ্চু  স্কুল ভবন নির্মাণ করতে হবে।