নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ: বিদ্যমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

একশনএইড বাংলাদেশের আয়োজনে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ: বিদ্যমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৫ নভেম্বর ২০২৩। এ আয়োজনে প্রচার সহযোগী হিসেবে ছিল প্রথম আলো। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

তানিয়া হক

সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নুরুন নাহার বেগম

পরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

তাসলিমা ইয়াসমীন

সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গীতাঞ্জলি সিং

বাংলাদেশ প্রতিনিধি, ইউএন উইমেন

নিশাত রহমান মিথুন

অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার, সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ডিভিশন (সাউথ), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)

আজমেরী হক বাঁধন

অভিনয়শিল্পী

আয়শা আখতার

সিনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার, বাংলাদেশ লিগ্যালএইড, অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট

শামীমা আক্তার

পরিচালক, করপোরেট অ্যাফেয়ার্স পার্টনারশিপ অ্যান্ড কমিউনিকেশন, ইউনিলিভার

জাহানারা আলম

সাবেক অধিনায়ক, বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দল

তৃষিয়া নাশতারান

প্রেসিডেন্ট, অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ও প্রতিষ্ঠাতা, মেয়ে নেটওয়ার্ক

পূর্ণিমা ইসলাম

প্রতিনিধি, গার্লস লিড অ্যাকশন প্রজেক্ট

আয়েশা কবির

বিভাগীয় প্রধান, প্রথম আলো ইংলিশ

তামাজের আহমেদ

ব্যবস্থাপক (নীতি গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি), একশনএইড বাংলাদেশ

মরিয়ম নেছা

ব্যবস্থাপক (নারী অধিকার ও লিঙ্গভিত্তিক সমতা) একশনএইড বাংলাদেশ

সঞ্চালনা

ফারাহ্ কবির

কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ

আলোচনা

ফারাহ্ কবির

নারী নির্যাতন রোধ শুধু নারীর বিষয় না, এটা পরিবার ও সমাজের বিষয়। নারী দিবসের এবারের থিম হলো ‘নারীর জন্য বিনিয়োগ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ’। আমরা প্রায়ই আলোচনা করি, যেকোনো সমাজের জন্য জেন্ডারবেজড ভায়োলেন্স একটা জটিল বিষয়।

প্রায় তিনি দশক ধরে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কাজ করছি। আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা উদ্‌যাপন করা হয়। সে জন্য বাল্যবিবাহসহ অনেক অপরাধকে অপরাধ মনে হয় না। বাল্যবিবাহের প্রায় সব স্টোরি হলো প্রথমে মেয়ে না করবে, এরপর চাপ প্রয়োগ করা হবে, কোনো কোনো মেয়ে রাজি হবে। এভাবেই চলছে। কিন্তু মেয়েটার চাওয়ার কোনো মূল্য নেই। তার মানসিক যন্ত্রণার কোনো মূল্য নেই। এসবের পরিবর্তন হতে হবে।

আমাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আইনগত, কাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনার জায়গা থেকে পরিবর্তন হয়েছে। আমরা বারবার পরিবার ও সমাজের মধ্যে আটকে যাচ্ছি। পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যদি না বদলায়, তাহলে এগোতে পারব না।

ভালো পরিবেশ পেলে নারীরা সবার সঙ্গে কাজ করতে পারেন। নারীকে প্রথমেই ভাবতে হবে যে তিনি মানুষ। একজন মানুষের যা অধিকার আছে, একজন নারীরও সে অধিকার আছে। এ জায়গায় গণমাধ্যমের কাজ করতে হবে। আজকের আয়োজনের উদ্দেশ্য গণমাধ্যম এসব বিষয় নিয়ে আরো বেশি লিখুক। অনেক মানুষ এখান থেকে সচেতন হবে। আমরা যে কাজ করি, সেটা বৃথা যায় না। ২০০৯ সালের যৌন হয়রানির গাইডলাইনে আমাদের কাজের প্রতিফলন দেখা যায়।

এখন অনেক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যৌন হয়রানি কমিটি করেছে। কিন্তু এটা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আরও কাজ করে যেতে হবে। ২০২৩ সালে এসে যে উন্নতির কথা ছিল, সেটা হয়নি। আমাদের সবার সমন্বিতভাবে আরও চেষ্টা করে যেতে হবে। অনেক অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু এরপরও কেন সমস্যা থেকে উত্তরণ হচ্ছে না, সেটা জানা প্রয়োজন।

তামাজের আহমেদ

একশনএইড বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে যে সব জরিপ ও গবেষণা করেছে, তাতে দেখা দেখা যায়, দেশের প্রায় অর্ধেক নারী প্রতিনিয়ত রাস্তা, পাবলিক পরিবহন এমনকি জনসেবামূলক জায়গায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এর মূল কারণ যৌন হয়রানি ও অপর্যাপ্ত নারীবান্ধব ব্যবস্থা। বেশির ভাগ নারী মনে করেন, নিরাপত্তাহীনতা থেকে তাঁদের মুক্তি নেই। এ ছাড়াও নারীরা কর্মক্ষেত্রে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নানা রকম যৌন হয়রানির ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হন।

যৌন হয়রানি নিরসনে ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত একটি নির্দেশনা জারি করেন। এ নির্দেশনামতে প্রতিটা কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের ২০১৮ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশের অধিকাংশ কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কোনো কমিটি হয়নি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ৮৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রীরা কমিটি সম্পর্কে জানে না। নারীদের প্রতি সহিংসতার ৬৬ শতাংশ ঘটনা পারিবারিক। কিন্তু এর মাত্র ১০ দশমিক ৭ শতাংশ আইনি সহায়তার জন্য আসে। এর মধ্যে নারীর পক্ষে রায়ের হার মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ।

আবার ২০২০ সালের এক জরিপ থেকে জানা যায়, দেশের অধিকাংশ অভিভাবক জানেন বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ। আবার বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের ৮৬ শতাংশ জানে যে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ। এরপরও প্রায় প্রতিনিয়ত দেশের কোথাও না কোথাও বাল্যবিবাহ হচ্ছে। এর মূল কারণ মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা ও দারিদ্র্য। বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এটা তাদের সন্তানের স্বাস্থ্যকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে। অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি নতুন সংযোজন। একশনএইড বাংলাদেশের ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী, ৬৩ দশমিক ৫১ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এটা তঁাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। পরিবারের প্রায় সব কাজই নারী করেন। অথচ এ কাজের কোনো আর্থিক মূল্য ও স্বীকৃতি নেই। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

মরিয়ম নেছা

একশনএইড বাংলাদেশ মনে করে, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে বিদ্যমান আইনের কার্যকর প্রয়োগ ও মূল্যায়নের জন্য মনিটরিং প্রক্রিয়া চালু করা প্রয়োজন। নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা নিশ্চিত করা দরকার। প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার, বিশেষ করে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০-এর পারিবারিক সম্পর্কের সীমাবদ্ধ সংজ্ঞা সংশোধন প্রয়োজন। আইন প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের জন্য বিচারক, আইনজীবী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য নিয়মিত লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাবিষয়ক আইনের ওপর প্রশিক্ষণ আয়োজন করা জরুরি। এ–সংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি, মামলা পরিচালনার খরচ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সময় কমিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।

সব ধরনের লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এ–সংক্রান্ত আইন সম্পর্কে প্রচারণা বাড়ানো, স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাবিরোধী প্রচারণায় পুরুষদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা জরুরি।

লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ এবং ভুক্তভোগী নারীদের সহায়তার জন্য স্বাধীন তহবিল তৈরি করা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র, মনো-সামাজিক পরামর্শ ও চিকিৎসা পরিষেবা বৃদ্ধি করা দরকার। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য জীবিকার সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন। নারীর গৃহস্থালি সেবামূলক কাজের চাপ কমাতে শিশু ও বয়স্কদের যত্নে সামাজিক পরিষেবা নিশ্চিত করা দরকার।

জাতীয় জিডিপিতে অবৈতনিক কাজকে আর্থিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবিলা করতে হবে। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। গণমাধ্যমে লিঙ্গ-সংবেদনশীল প্রতিবেদন ও সচেতনতামূলক প্রচারণা জোরদার করা দরকার। সর্বোপরি সব ধরনের সহিংসতা নিরসনে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

তৃষিয়া নাশতারান

নারী নির্যাতন রোধে আইন সংস্কার ও নতুন আইন করা দরকার। কিন্তু এখন যে আইন আছে, সেটারই ঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। দুই বছর আগে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলাম। তার নামে মামলা করেছি। এই মামলা করতে গিয়েও আমাকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত মামলার কিছু হয়নি। আমার মামলার এ অবস্থা! কিন্তু যঁারা আরও প্রান্তিক, তঁাদের কী অবস্থা, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমি নারীদের নিয়ে কাজ করি। প্রতিদিন অসংখ্য নারী এসে তঁাদের সমস্যার কথা বলেন। আমাদের এক সদস্যের মাকে তাঁর বাবা নির্যাতন করেছেন। তাঁর শরীরে মারের দাগ না থাকায় পুলিশ মামলা নেয়নি। আমাদের একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন না হলে সমস্যার সমাধান হবে না।

মেয়েদের অগ্রগতি হচ্ছে কিন্তু পুরুষেরা কি এগোচ্ছেন? আমরা পুরুষদের জন্য কী করছি। দেশের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিনির্ভর। প্রযুক্তি দিয়ে কীভাবে হয়রানির শিকার হতে পারেন, নারীরা সেটা জানেন না। আর প্রযুক্তির যতটুকু জানেন, সমস্যা এর অনেক গভীরে। মেয়েদের আরও অনেক বেশি ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে হবে।

পূর্ণিমা ইসলাম

আমি ক্লাস নাইনে পড়ার সময় আমার এক বান্ধবীকে এক ছেলে জোর করে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু তার বাবা একজন টাকাওয়ালা বয়স্ক মানুষের সঙ্গে তাঁকে বিয়ে দেন। আমার বন্ধবীর এক সন্তান হয়। কিন্তু নবজাতক এত অসুস্থ হয় যে তাকে আইসিইউতে রাখতে হয়। আমি এখনো শিশু। আমার যদি বিয়ে হয়, তাহলে শারীরিক, মানসিক ও সাংসারিক চাপ সৃষ্টি হবে। আমাদের দেশে মেয়েদের স্বামী, শ্বশুর–শাশুড়ি, দেবর, ননদ—সবার সেবা করতে হয়।

আমার এলাকায় বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বললেই বলে যে অনেক কথা শিখেছে, তুমি কী বোঝো। এত বোঝার দরকার নেই। তোমার বাসায় বিচার দেব ইত্যাদি। একশনএইড বাংলাদেশে কাজ না করার জন্য বাসায় বিচার দেয়। বলে যে মেয়ে খারাপ হয়ে যাবে। রাস্তায় বের হলেও আমার বাবার কাছে আমার সম্পর্কে উল্টাপাল্টা বলে।

আমাদের এলাকায় অনেক মানুষ মাদকাসক্ত। মেয়েরা ঘরের বাইরে গেলেই তাদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করে। তখন এই মাদকাসক্ত খারাপ ছেলেদের দোষ না দিয়ে মেয়েকে দোষ দেয়। বাড়িতে এসে বলে আপনার মেয়ে খারাপ হয়ে গেছে। রাস্তার মানুষ এসব বলে। তাকে বিয়ে দেন।

ছেলেদের আলাদা রাখলে হবে না। নারী নির্যাতন রোধে ছেলে ও অভিভাবক—সবাইকে নিয়ে কর্মশালা করতে হবে।

জাহানারা আলম

আমি জাতীয় দলে প্রায় ১৭ বছর ক্রিকেট খেলছি। আমার ১০ বছর বয়স থেকে খেলা শুরু করি। আর তখন থেকে ইভ টিজিংয়ের শিকার হই। ক্লাস সেভেনে ওঠার সময় আমার বান্ধবীর কাছ থেকে একটি প্রেমের উপন্যাস নিয়েছিলাম। বাবা এটা দেখে আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল। আমি হ্যান্ডবল, ভলিবল খুব ভালো খেলতাম। খুলনা বিভাগীয় দলে নির্বাচিত হই। তখন স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া পুরস্কার দেওয়া হচ্ছিল। আমি কয়েকটি পুরস্কার জিতেছি। বাবা তো স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু পুরস্কার আনতে যাওয়ার জন্য বাবাকে অনেক অনুরোধ করলাম। তিনি রাজি হলেন। সেদিন অনেকগুলো পুরস্কার নিয়ে বাসায় ফিরলাম। বাবা খুব খুশি হলেন। আমি তখনই বুঝেছি, প্রথমে সফল হতে হবে। তাহলে পরিবার থেকে শুরু করে সব জায়গায় সম্মান ও অধিকার পাওয়া যাবে।

২০০৩ সালে খুলনা জেলা থেকে নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় ফুটবল খেলতে এলাম। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। ২০০৭ সালে ক্রিকেট খেলা শুরু করি। ২০০৮ সালে আমার এসএসসি পরীক্ষা। তখন জাতীয় দলে ডাক পাই। বাবা বললেন পরীক্ষা অনেকবার দেওয়া যাবে। তুমি যেহেতু দেশের প্রতিনিধিত্ব করবা, যাও।

অনেক ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়েছি। কিন্তু বাসায় বলিনি, যদি বাবা আটকে দেন। আমাদের এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে স্কুলে যাওয়ার পথে আমার ছোট বোনের পথ বন্ধ করে দাঁড়ায়। সে বাড়িতে এসে কান্না করে। মা–বাবার নিষেধ না শুনেই আমি সেদিন কড়া প্রতিবাদ করেছিলাম। আমরা যদি আরেকটু সাহসী হই, সবাই মিলে একসঙ্গে প্রতিবাদ করি, তাহলে পরিবর্তন আসতে পারে।

তাসলিমা ইয়াসমীন

যৌন হয়রানি বন্ধে উচ্চ আদালতের একটা গাইডলাইন আছে। ২০০৯ সালে এ গাইডলাইন হয়েছে। ২০১৮ সালে একশনএইড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ গাইডলাইনের প্রয়োগ নিয়ে একটা গবেষণা করেছিলাম। গবেষণায় এসেছে, অধিকাংশ করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা এটা জানেন না। তারপর একশনএইড বাংলাদেশ এটা প্রচারের উদ্যোগ নিল। এখন প্রশ্ন হতে পারে, গত এক দশকে কী পরিবর্তন হয়েছে?

গবেষণার পর দেখা গেল, অনেক প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে সচেতন হয়েছে। এরা যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কমিটি করেছে। উচ্চ আদালত থেকে বলা হয়েছিল, আইন না হওয়া পর্যন্ত এই গাইডলাইন অনুসরণ করতে হবে। তবে আজ ২০২৩ সালে এসেও কোনো আইন হয়নি। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বিরুদ্ধে কমিটি গঠিত হয়, কিন্তু সেই কমিটি যদি কাজ না করে, কমিটির কোনো অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া নেওয়া না হয়, তখন সে প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। একদম জেল–জরিমানা দিতেই হবে, তা নয়।

ইউএন উইমেনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যৌন হয়রানি আইনের একটি খসড়া করেছিল। সেখানে কর্তৃপক্ষকে দায়বদ্ধ করার বিষয়টি ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটা বাদ দেওয়া হয়েছে।

এখানে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। তাদের সব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে হবে। যদি সবার ইতিবাচক মানসিকতা থাকে, তাহলে সবাইকে নিয়ে সবার স্বার্থ রক্ষা করেও একটা ভালো আইন করা যায়।

পারিবারিক সহিংসতা বিষয়ক আইনে পারিবারিক সহিংসতা বলে কোনো অপরাধ নেই। এ ক্ষেত্রে সিভিল কিছু রিমেডি দেওয়া হয়। আবার একজন ছেলেসন্তান এবং পুরুষও যে যৌন হয়রানির শিকার হতে পারে, এ আইনে সেটা বিবেচনাই করা হয়নি। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

শামীমা আক্তার

অনেক বছর ধরে আমি জেন্ডার রাইটস নিয়ে কাজ করেছি। করপোরেট প্রতিষ্ঠান সমাজকে সেবা দেয়। একটা ভালো পণ্যের সঙ্গে সামাজিক উন্নয়নের সম্পর্ক রয়েছে। পাঁচ বছর আগে জাতিসংঘ থেকে একজন নারী আমাদের অফিসে আসেন। তিনি বলেন যে কীভাবে তিনি আমাদের ব্র্যান্ড পাওয়ার ব্যবহার করতে পারেন। করপোরেট প্রতিষ্ঠান মুনাফার সঙ্গে সমাজেও অবদান রাখে। তখন আমরা এমন একটা বিজ্ঞাপন করলাম, যেন নারীদের প্রতি পুরুষের ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি হয়। আমাদের ডাব পণ্যের বিজ্ঞাপন কিশোরীদের আত্মবিশ্বাস তৈরিতে কাজ করে। ডাব হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্র্যান্ড। এর মাধ্যমে আমরা কিশোরীদের অধিকারের বিষয়টি সামনে আনতে পারি।

ইউনিলিভার বৈশ্বিকভাবে সমাজে প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ মানুষের ঘরে ইউনিলিভারের পণ্য যায়। ইউনিলিভারে বিশালসংখ্যক নারী কর্মী রয়েছে। বাংলাদেশে ইউনিলিভারে ৪৪ শতাংশ নারী ব্যবস্থাপনা পদে রয়েছেন। টপ ম্যানেজমেন্টে এটা প্রায় ৫০ শতাংশ। আমাদের একটা নীতি হলো, কেউ যদি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন, আমাদের কাছে আসেন, তাঁকে ৩০ দিন বাইরে থাকার সহযোগিতা দেব। তঁার আইনি খরচও প্রতিষ্ঠান বহন করবে।

আমাদের ইকোলজিক্যাল পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমাদের টোল ফ্রি সাইকোলিজিক্যাল কাউন্সেলিংয়ে অনেকে আসেন।

আজমেরী হক বাঁধন

সমাজে অনেক কুসংস্কার ও গোঁড়ামি আছে। অনেক ক্ষেত্রে নানা বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। আমরা দেখি, অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধি, মেয়েদের পিরিয়ড—এসব জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলা হয় না। এসব বিষয়ে সব শ্রেণির মানুষকে আরও সচেতন করতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।

আমাদের দেশে নারীবিদ্বেষী বিষয়বস্তুকে পুঁজি করে কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়ে থাকে, যা একটি ভয়াবহ প্রবণতা। এসব চলচ্চিত্রের প্রভাবের কারণে অনেক সময় নারীরা নির্যাতনের শিকার হন। দুঃখজনক হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে এসব চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়ে যায়। এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা না করার জন্য গণমাধ্যমের সচেতনতামূলক প্রচার চালানো জরুরি।

এখানে যঁারা বিনিয়োগ করেন, তাঁদের ভাবতে হবে, সিনেমা শুধুই টাকা বানানোর মাধ্যম নয়, সমাজকে ভালো কিছু দেওয়ার কথাও তাঁদের ভাবতে হবে। এ বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আবার অনেক বিজ্ঞাপনেও নারীর উপস্থাপন নিয়ে প্রশ্ন আছে। এসব নিয়ে সমাজে কোনো আলোচনা নেই। এর কোনো জবাবদিহি নেই। এসব বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

আয়শা আখতার

রেপ ল রিফর্ম কোয়ালিশনে আমরা সেক্রেটারিয়েট হিসেবে কাজ করি। ১০টি বিষয় নিয়ে কাজ করেছি। এর দুটি বিষয়ে আমরা লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি। ইংরেজদের সময় থেকে আমাদের দেশে ১৫৫ ও ১৪৪ সেকশন সি ক্লজ ছিল। এখানে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়ে কোনো ব্যক্তি এলে তখন তাঁর অতীত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন। এ জন্য আমরা যত ধর্ষণের ঘটনার কথা জানি, এর খুব কম সংখ্যাই আইনের আশ্রয় নেয়। কারণ, যিনি ধর্ষণের শিকার হন, তিনি একটা মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যান। আইনের আশ্রয় নিতে গেলে থানা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে তাঁকে বিব্রতকর প্রশ্ন করা হয়। এ জন্য অনেকে আইনের আশ্রয় নিতে আসেন না।

আমরা দীর্ঘদিন এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তাতে অগ্রগতি হয়েছে। এ ‍দুটি সেকশনের একটা সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে। ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ১৪৭ সি সেকশনে বলা হয়েছে, বিচারকের অনুমতি নিয়ে প্রশ্ন করা যেতে পারে। ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে শাস্তি কম হওয়ার কারণ, ভিকটিম অ্যান্ড উইটনেস প্রোটেকশন।

ভিকটিম অ্যান্ড উইটনেস প্রোটেকশন ড্রাফট অ্যাক্টের খসড়া হয়েছিল ২০০৬ সালে। ২০১১ সালে এটা রিভাইজ হয়। আমরাও খসড়া দিয়েছি। একবার সাক্ষী না এলে মামলা এক মাস পিছিয়ে যায়। এখন ডিজিটাল সাক্ষীও গ্রহণ করা হচ্ছে। বাল্যবিবাহ বন্ধের কমিটি আছে। এ কমিটির অনেক সদস্য জানেন না যে তিনি কমিটির সদস্য। এসব বিষয়ের পরিবর্তন দরকার।

নিশাত রহমান মিথুন

আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই, সহিংসতার শিকার হয়ে নারীরা আমাদের কাছে কম আসুক। ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ সবাইকে নিয়ে কর্মশালা করতে হবে। আমরা পরিবারে একটা শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে চাই। আমি একসময় কামরাঙ্গীরচরে কর্মরত ছিলাম। সেখানকার সমস্যা আর গুলশানের সমস্যা এক নয়। কামরাঙ্গীরচরে দেখেছি পাঁচ থেকে ছয় বছরের শিশুরাও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এসব জায়গায় যদি ডে-কেয়ার সেন্টার থাকে, তাহলে মায়েরা তাঁদের সন্তানদের রেখে কাজে যেতে পারতেন।

সারা দেশে মেয়েরা এখন শিক্ষায় ভালো করছেন। কিন্তু সবাই কর্মক্ষেত্রে আসছেন না। অনেকে হয়তো এখনো নিরাপত্তাহীনতার কথা ভাবেন। আমার অনেক বান্ধবী ‍পরীক্ষায় ভালো করার পরও চাকরিতে আসেননি। এক আপার স্বামী চান না বলে ব্যাংকের বড় চাকরি তিনি ছেড়ে দিয়েছেন।

অধিকাংশ অভিভাবক মেয়েদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেন না। অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরাও কতটুকু দেখেন, সেটাও এক প্রশ্ন। গ্রামের দরিদ্র মেয়েদের যারা শিক্ষা, খেলাধুলা, গান, নাটকে ভালো, কেবল তাদের জন্য যদি কোনো প্রকল্প থাকে যেন তারা সফল হতে পারে। তাহলে একটা উদাহরণ তৈরি হতে পারে। আমাদের বাহিনীর সবাই যে জেন্ডার–সংবেদনশীল, তা হয়তো না। কিন্তু আমরা সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করছি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানির শিকার নারীকে সুরক্ষা দেওয়া এখন কঠিন হয়েছে। কারণ, অপরাধীকে ধরতে হলে আদালতের অনুমতি নিতে হয়। তত দিনে অপরাধী ডিভাইস নষ্ট করে ফেলার সুযোগ নিতে পারে। মেয়েদের জন্য অপরাধ আমলযোগ্য করে একটা সেকশন করা হলে তারা আইনি সুরক্ষা পেত।

সহশিক্ষায় না পড়ার কারণে ছেলে–মেয়েরা ভিন্ন মানসিকতায় বেড়ে উঠছে। তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়া হচ্ছে না। এক্ষেত্রে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।

নুরুন নাহার বেগম

নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। সবাই মিলে একটা সুন্দর পরিবেশ গড়তে চাই। আমরা জেন্ডারবেজড ভায়োলেন্সকে শূন্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যদি শূন্য করতে চায়, তাহলেও অনেক উন্নতি হবে। তাহলে সবাই মনে করবে যে কোনো অন্যায় হলে তাঁর চাকরি থাকবে না। তখন কিন্তু সবাই ভয় পাবেন। হঠাৎ সব ঠিক হবে, তা হয়তো নয়।

যে পরিবারে সহিংসতা হয়, সে পরিবারের সন্তানেরা সাধারণত সহিংসপ্রবণ হয়ে বেড়ে ওঠে। পরিবারে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। আমরা অ্যাডলোসেন্ট কর্নার করেছি। কিন্তু সেখানে ছেলে-মেয়ে এলে তাদের নিয়ে আবার সমালোচনা হয়।

কর্নারে বিবাহিতরা সহজে সেবা পেলেও অবিবাহিতদের অনেক প্রশ্ন করা হয়। এ জন্য তারা বিব্রত বোধ করে। এখন কর্নারে যাঁরা সেবা দেবেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।

আমরা স্কুলে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। শিক্ষার্থীদের নিয়ে কমিটি করে দিতে হবে, তাহলে ওরা নিজেরাও অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারবে। স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে শক্ত রাজনৈতিক লিডারশিপ থাকতে হবে।

আয়েশা কবির

২০২৩ সালে এসেও এটা নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হচ্ছে, এটাই দুঃখজনক। এত উদ্যোগ, এত কাজ হচ্ছে, তবু সহিংসতা কমছে না। এর মানে হলো কোথাও একটা সমস্যা রয়েছে। আমাদের সমাজে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই ধরনের গল্প আছে। আমাদের আজকের আলোচনায় প্রতিষ্ঠিত নারী অভিনয়শিল্পী, পুলিশ অফিসার ও খেলোয়াড় আছেন। এঁদের সফলতার গল্প লেখা যায়। এঁরা সবাই রোল মডেল।

সংবাদপত্রের প্রথম পাতা যদি ইতিবাচক সংবাদ দিতে পারি, তাহলে মানুষ ভালো অনুভব করবে। আমরা অনেক সময় সঠিক শব্দ ব্যবহার করি না। আমরা ধর্ষণ বলব, লিখব। ইভ টিজিং না, এটা সরাসরি যৌন হয়রানি।

গণমাধ্যম আইনের বিষয় জানাতে পারে। কিন্তু শুধু জানালেই সব হবে না; প্রতিকারের জন্য কার কাছে যেতে হবে, খরচ কত হবে, কীভাবে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে—গণমাধ্যমে এসব বিস্তারিত লিখতে হবে। গণমাধ্যমে অনেক বেশি নারী কর্মীর কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া দরকার।

গীতাঞ্জলি সিং

বিশ্বের কোনো দেশই সম্পূর্ণভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করতে পারেনি। কোনো দেশই সবক্ষেত্রে জেন্ডার–সমতা অর্জন করতে পারেনি। আমরা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানে নারীর আরও উন্নতি আশা করি। আমি বাংলাদেশের অনেক জায়গায় গিয়েছি। নারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার মনে হয়েছে, নারীর ক্ষমতায়নে তাঁদের প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন দরকার। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নারীরা পর্যন্ত সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। গত দুই দশকে নারীর যে ধরনের অগ্রগতি হওয়ার কথা, সেটা হয়নি। কিছু আইন হয়েছে, যেখানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের বিশেষ প্রভিশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নারীদের কিছু সেবা পাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু এখন এটা প্রমাণিত হয়েছে যে অত্যন্ত কম খরচে সহিংসতা রোধ করা যায়। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে যে উদ্যোগগুলো আছে, এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। নারী নির্যাতন রোধে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের তদারক করা হচ্ছে না। নারী নির্যাতন রোধে যে আইন আছে, মাঝেমধ্যে সেটার সংশোধন করা প্রয়োজন।

নারীর প্রতি সহিংসতার সঠিক তথ্যের অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে। দেখতে হবে কীভাবে সহিংসতা হচ্ছে এবং সহিংসতা রোধে কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সঠিক তথ্য থাকলে অনলাইন সহিংসতাও রোধ করা সম্ভব হবে।

ইউএন উইমেন সঠিক তথ্যের জন্য বিবিএসের সঙ্গে কাজ করছে। এক তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ৭৮ শতাংশ নারী তাঁদের স্বামীদের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর পরের অবস্থা জানা নেই। সহিংসতা রোধে বাজেট বরাদ্দ করা প্রয়োজন। বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন স্বামীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হন। বিশ্বে প্রায় ৭০ কোটি নারী এভাবে সহিংসতার শিকার হন।

তানিয়া হক

শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই নারীর প্রতি সহিংসতার নিত্যনতুন ঘটনা ঘটছে। এর থেকে মুক্তি আছে কি না, সেটাও একটা জটিল প্রশ্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলে নারীরা নারীদের নিপীড়ন করছেন। কোনো কোনো মাদ্রাসায় ও যুদ্ধের সময় পুরুষ পুরুষকে যৌন হয়রানি করছেন। যেসব নারী বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছেন, সেখানেও তাঁরা পরিত্রাণ পাচ্ছেন না। যত উন্নতির কথা বলি না কেন, নারীকে এখনো নারী হিসেবেই দেখা হয়, তিনি যেন মানুষ নন।

সহিংসতার ও সহিংসতা পরবর্তী একটা বিশাল ব্যয় আছে। এটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সবাই মনে করেন, নারীর প্রতি সহিংসতার খরচ শুধু ভিকটিম বহন করে। অভিযুক্তকেও ব্যয় বহন করতে হয়। একজন স্বামী যদি তাঁর স্ত্রীকে এমন নির্যাতন করেন যে তাঁকে বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে নিতে হয়, তখন তাঁকে চিকিৎসার খরচ বহন করতে হয়। স্ত্রী যদি স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন, তখন তাঁকে মামলার খরচ বহন করতে হয়।

পুরুষতন্ত্র শুধু নারীকে নয়, পুরুষকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে—এটা সামনে আনতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আয়ের চাপ সহ্য করতে না পেরে নারীর তুলনায় বিশ্বে দ্বিগুণ পুরুষ আত্মহত্যা করছেন। কিন্তু পুরুষ এটা কখনো তাঁর স্ত্রীকে বলেন না যে আমি একা পেরে উঠছি না, আমাকে সাহায্য করো।

বড় সমস্যা হলো নারী নিজেও মনে করেন ঘরের কাজ শুধু তাঁর। একজন মা তাঁর মেয়েকে ভালো রান্না শেখান, কিন্তু ছেলেকে শেখান না। রান্নাঘর এমনভাবে করতে হবে, যেন পুরুষ দেখতে পান নারী সারাক্ষণ কাজ করছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণের মতো ঘরের কাজে ৩৩ শতাংশ পুরুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিন্ত করা জরুরি।

যোগ্য বাবা হতে হলে সন্তানকে ভালোবাসতে হবে। সে যেন মনে করে মা–বাবা তার অনেক বড় বন্ধু। তাহলে সন্তানের আত্মবিশ্বাস বাড়বে, জীবনে সফল হবে।

ফারাহ্‌ কবির

গোলটেবিল আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য একশনএইড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ।

সুপারিশ

  • নারী নির্যাতন রোধে ছেলে, মেয়ে, অভিভাবক—সবাইকে নিয়ে কর্মশালা করতে হবে।

  • সব শ্রেণির মানুষকে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে আরও সচেতন করতে হবে।

  • পরিবারে শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।

  • গ্রামের দরিদ্র মেয়েদের যারা শিক্ষা, খেলাধুলা, গান, নাটকে ভালো, তাদের রোল মডেল তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

  • পুলিশের কর্মকর্তাদের আরও জেন্ডার–সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন।

  • দরিদ্র নারীদের শিশুসন্তানের জন্য ডে-কেয়ারের ব্যবস্থা করতে হবে।

  • ছেলেমেয়েদের সহশিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।

  • মেয়েদের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে হবে।