প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থান

এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থান’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২২ মার্চ ২০২৩। আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

রাশেদ খান মেনন এমপি,

সভাপতি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

মো. জোহর আলী

যুগ্ম সচিব; সদস্য, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়

ফারজানা খান

মহাব্যবস্থাপক, এসএমই ফাউন্ডেশন

মো. শফিকুল ইসলাম

পরিচালক, রিসোর্স সিস্টেম অ্যান্ড কালচার, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল

তাহেরা জাবিন

সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডভাইজার, ব্রিটিশ হাইকমিশন, ঢাকা

গোলাম ফারুক হামিম

বাংলাদেশ প্রোগ্রাম টিম লিড, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল

খন্দকার জহুরুল আলম

নির্বাহী পরিচালক, সিএসআইডি

সালমা মাহবুব

সাধারণ সম্পাদক, বি-স্ক্যান ও পিএনএসপি

তাওহিদা জাহান

সহকারী অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারপারসন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মুর্তেজা খান

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বাংলাদেশ বিজনেস ডিজঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্ক

আসাদুজ্জামান চৌধুরী রাসেল

সভাপতি, রজনীগন্ধা উন্নয়ন সংস্থা, রাজশাহী

উৎপল মল্লিক

প্রকল্প ব্যবস্থাপক, সাইটসেভার্স বাংলাদেশ

এম মাহ্জুজ আলী

ম্যানেজার, ব্র্যাক দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি

সাজ্জাদ কবীর

ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার, সিডিডি

মো. মাহমুদ হাসান তালুকদার

ম্যানেজার, ইভালুয়েশন, রিসার্চ অ্যান্ড লার্নিং, ইউসেপ বাংলাদেশ

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা:

আব্দুল কাইয়ুম

আজকের আলোচনার মূল বিষয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতার উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থান। আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন। কীভাবে তঁাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, সেটাই আজকের আলোচনা। এমনও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কথা জানি, যিনি পা দিয়ে লিখেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন।

একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া বড় কথা না। তিনি যেন স্বাবলম্বী হতে পারেন, সে লক্ষ্যে কাজ করা প্রয়োজন।

মো. শফিকুল ইসলাম

মো. শফিকুল ইসলাম

আজকের আলোচনার মূল বিষয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতার উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থান। এডিডি ইন্টারন্যাশনাল অন্তর্ভুক্তিমূলক

কর্মসংস্থান প্রকল্প ইউকে এইডের সহায়তায় বাস্তবায়ন করেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে ব্র্যাকের স্টার মডেলের অনুসরণে। এই মডেলের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে ছিল সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) ও লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড। আমরা সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন জায়গায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছি। এ কাজের অনেক অভিজ্ঞতা আছে। তবে আজ আমরা এডিডির কর্ম এলাকার কাজের অভিজ্ঞতা আলোচনা করব। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ভবিষ্যতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, সেটিও আলোচনায় আসবে।

সাইটসেভার্স ইন্টারন্যাশনাল ইউকে এইডের সঙ্গে অংশীদারি ভিত্তিতে ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্প প্রায় শেষের দিকে। তবে তহবিল পেলে আরও বড় আকারে এটা চলতে পারে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, এসএমই ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন পক্ষের সহায়তায় ভবিষ্যতে আরও ভালো করা যেতে পারে। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে।

সুযোগ-সুবিধার অনেক তথ্য আছে। হয়তো সেগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছানো যাচ্ছে না। আজকে সবার পরামর্শ এ ধরনের প্রকল্পের ভবিষ্যৎকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলে আশা করি। আইন, নীতি বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা আছে। এরপরও আমাদের বছরের পর বছর একই কথা বলতে হচ্ছে। জাতীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী আইনের বিভিন্ন ধারা বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সবার জোর দিতে হবে। এ বিষয়ে প্রচারণা চালাতে হবে।

এত দিন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে যে চিন্তাধারা ও মানসিকতা নিয়ে কাজ করেছি, সেটা থেকে বেরিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ সব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ বাড়ানোসহ জাতীয় কর্মপরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন হলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আরও কল্যাণ হবে বলে আশা করি।

ফারজানা খান

ফারজানা খান

এসএমই ফাউন্ডেশন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর এসএমই ফাউন্ডেশনের মেলা হয়। মেলায় আমরা প্রতিবন্ধীদের ব্যক্তিদের জন্য স্টল রাখি। আমাদের এই মেলায় দেখেছি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এত সুন্দর পণ্য নিয়ে আসেন, যেগুলো মানুষকে আকৃষ্ট করে। এমনকি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা অনেক সুন্দর পণ্যের স্টল দেন। প্রতিবন্ধী হিসেবে না, পণ্যের মানের জন্যই মানুষ এসব পণ্য মেলা থেকে কেনেন।

কোভিডের সময় মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকার জন্য আমরা কর্মসূচি নিয়েছিলাম। এটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্যও নিতে পারি। আমাদের একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে। সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রশিক্ষণ নিতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কয়েকজন একসঙ্গে আবেদন করলে আমরা তাঁদের উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষণ দিতে পারব। এটা অনলাইন-অফলাইন—দুভাবেই হতে পারে। আমরা তঁাদের অনলাইনে ব্যবসা করার প্রশিক্ষণ দিতে পারি।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ হতে পারেন, উদে্যাক্তা হতে পারেন, তাহলে তঁারা দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবেন। এমএমই ফাউন্ডেশন থেকে তঁাদের সহযোগিতার জন্য চেষ্টা করব।

রাশেদ খান মেনন

রাশেদ খান মেনন

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। তঁারা আইনগত সুরক্ষা পেয়েছেন। তঁাদের জন্য দুটি ভালো আইন আছে। এ দুটি আইন হলো প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট (এনডিডি) আইন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়নে এখনো পিছিয়ে আছি। সরকারের উদ্যোগগুলো ঠিকভাবে কাজ করেনি।

আমরা একবার ইশারা ভাষা নিয়ে কাজ করলাম। একটা ইনস্টিটিউট করার জন্য জায়গাও ঠিক করেছিলাম। কিন্তু পরে বিষয়টি থেমে গেল। থেমে যাওয়ার একটা বড় কারণ ছিল কোভিড। কোভিড ও ইউক্রেনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ আমাদেরও আছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য এখন অনেক সুবিধা আছে।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের জন্য রিসোর্স পারসন তৈরি করা প্রয়োজন। এ জন্য আমি সংসদীয় কমিটি ও মন্ত্রণালয় চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। অনেকে রিসোর্স পারসন হচ্ছেন। কিন্তু তঁারা নিজেরা ব্রেইল জানেন না। ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দিতে পারেন না। এর সঙ্গে আবার নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে।

এখন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা টাচ মোবাইল ও কম্পিউটার ব্যবহার করছেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মেধা, যোগ্যতাকে আমরা ব্যবহার করতে পারছি না।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিসংখ্যান নিয়ে জটিলতা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যানের মিল নেই। আবার কারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এটা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সরকার ও এনজিওগুলো মিলে যৌথভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একটি সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয় করতে হবে।

প্রতিবন্ধী ভাতা শুরু হলে অনেক ভালো মানুষও প্রতিবন্ধী হওয়া শুরু করল। প্রতিটি উপজেলায় আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য স্কুল করতে চেয়েছি। তখন দেখা গেল একটা ইউনিয়নে চারটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির স্কুল হয়ে গেছে। একই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে প্রতি স্কুলে শিক্ষার্থী হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

চাকরি মেলা থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চেইন শপে চাকরি হয়েছিল। এসব চেইন শপের মালিকেরা বলেছেন তঁারা বেশি উদ্যোগী ও ভালো কাজ করেন।

আপনাদের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এটাকে সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে চালিয়ে নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আগামী বাজেটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ বরাদ্দের বিষয়টি সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। আপনাদের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আমাদের দিলে সংসদীয় কমিটিতে আমরা সেটা সামনে আনার চেষ্টা করব।

তাওহিদা জাহান

তাওহিদা জাহান

আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের কাজ করার সক্ষমতা আছে। তাঁদের এই সক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। যেখানে শিশুদের বিশেষ চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি উপস্থিত ছিলেন। সেখানে একজন প্রতিবন্ধী শিশু ভাষা আন্দোলন নিয়ে সেদিনের সবচেয়ে সুন্দর ছবিটি পা দিয়ে এঁকেছিল। ৩৫০ জন শিশুর মধ্যে সে প্রথম হয়েছিল। প্রথম পুরস্কার নেওয়ার জন্য তার দুটি হাত ছিল না। আমাদের চোখ ভিজে গিয়েছিল। আমাদের চারপাশে এ ধরনের অনেক মেধাবী প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তি রয়েছেন। মানুষের মস্তিষ্কে কাজ করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হবে। 

শুরুতেই প্রতিবন্ধী শিশুর দৈনন্দিন জীবনে নিজের কাজ যেন নিজে করতে পারে, সে দক্ষতার উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। এরপর তাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দিতে হবে। সেখানে সে তার সমবয়সীদের সঙ্গে একযোগে মানিয়ে নিয়ে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়লে তার বিশেষ শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে বিশেষ শিক্ষা বিদ্যালয় সরকারি অর্থায়নে হওয়া উচিত। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশেষ শিশুদের জন্য একজন বিশেষ শিক্ষক এবং ভাষা দক্ষতা উন্নয়নে স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট নিয়োগ দিতে হবে। 

উচ্চশিক্ষায় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সুযোগের জন্য ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টি, বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের কোটা ছিল। ২০১৮ সাল থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত হয়। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের সাধারণ ভর্তি কমিটির সভায় স্নায়ু বিকাশগত প্রতিবন্ধকতাবিষয়ক কোটা যুক্ত করার বিষয়টি আমি প্রস্তাব করি। সেই শিক্ষাবর্ষ থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্নায়ু বিকাশগত প্রতিবন্ধিতাকেও প্রতিবন্ধী কোটার অন্তর্ভুক্ত করে। আমরা আশা করছি, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নেবে।

মো. জোহর আলী

মো. জোহর আলী

জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান দেড় বছর ধরে চলছে। এর আগে করোনায় বন্ধ ছিল। ২০২২ সাল থেকে এনএসডিএ (জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) নীতি হয়েছে। এনএসডিএ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য কাজ করে। দক্ষতা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়, পর্যবেক্ষণ ও তদারক করে। প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণের মূল্যায়নসহ বিভিন্ন কাজ করে। এককথায়, এনএসডিএ দক্ষতা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সবার ছাতা হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে থাকে।

এনএসডিএ কোনো দক্ষতা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেওয়ার সময় নিশ্চিত করে, সেখানে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তির প্রবেশগম্যতা, টয়লেট–সুবিধা ও প্রশিক্ষণের উপকরণ আছে কি না ইত্যাদি।

ব্র্যাকের স্টার মডেল প্রকল্পে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে আইটিতে কাউকে দেখলাম না। এটা খুব জরুরি। কারণ, এ ক্ষেত্রে ঘরে বসে কাজ করা যায়। আইটির বিষয় সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে বলে মনে করি। বেশির ভাগ চাকরি অপ্রচলিত খাতে। এ খাতে সঠিক দক্ষতা ছাড়া কাজ পাওয়া যাবে না। কারণ, বেসরকারি খাত মুনাফাকে গুরুত্ব দেয়।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরি করতে প্রকৃত দক্ষতা অর্জন করতে হয়। মালিককে এমনভাবে সেবা দিতে হয়, যেন মালিক তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জন করেন। ২০০৯ সালের আগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সেভাবে ভাবা হয়নি। বর্তমান সরকারই তাঁদের জন্য আইনসহ সব সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। দেশে দক্ষতা উন্নয়ন শিক্ষাকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। কোনো পরিবারে যে সন্তান সবচেয়ে খারাপ, তাকে কারিগরি শিক্ষায় দেওয়া হয়। এসব বিষয়ে মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আরও উন্নয়ন হবে।

গোলাম ফারুক হামিম

গোলাম ফারুক হামিম

সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫০ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দুই ধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। ন্যাশনাল সার্ভে অন পারসন্স উইথ ডিজঅ্যাবিলিট ২০২১ অনুযায়ী দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ২ দশমিক ৮০ শতাংশ। তাদেরই আরেকটি জরিপে পাওয়া গেছে ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ। এর মধ্যে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৬৬ দশমিক ২২ শতাংশ কোনো ধরনের আয় বৃদ্ধিমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত না। যুক্তরাজ্য সরকারের ফরেন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) অর্থায়ন, সাইটসেভার্সের তত্ত্বাবধান, ব্র্যাকের নেতৃত্ব এবং সেন্স ইন্টারন্যাশনালের কারিগরি সহযোগিতায় এডিডি, ব্র্যাক ও সিডিডি ‘ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুসিভ ভোকেশনাল ট্রেনিং অ্যান্ড ইউথ এমপ্লয়মেন্ট’ টাস্ক অর্ডার-১২ নামে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। করোনার জন্য এ প্রকল্প কিছুদিন বন্ধ ছিল। ২০২১ সাল থেকে আবার শুরু হয়েছে।

এটি ব্র্যাকের স্কিলস ট্রেনিং ফর অ্যাডভান্সিং রিসোর্সেস মডেলের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রয়োগের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশের ৪৯ জেলায় বাস্তবায়িত হয়েছে।

অনানুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের জন্য এই পদ্ধতি সুনাম অর্জন করেছে। প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচন, তাদের কর্মক্ষমতা ট্র্যাকিং, চাকরির স্থান নির্ধারণ, স্থানীয় বাজার কমিটি এবং অন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে এই প্রকল্পে প্রতিবন্ধী সংগঠনগুলোর বড় ভূমিকা রয়েছে।

এই প্রকল্পে এডিডি ৫০ জন, ব্র্যাক ১১৫২ জন ও সেন্স/সিডিডি ৩০ জন প্রতিবন্ধী তরুণ-তরুণীর পরীক্ষামূলক প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

অনানুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রের শর্ত হলো নিজেকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর। এটা কেবল সঠিক কারিগরি ও সফটস্কিল প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা প্রয়োজন।

আমরা শারীরিক, মানসিক, বাক্, শ্রবণ, দৃষ্টি, বুদ্ধি ও বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতাসহ নান ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। পোশাক, বিউটি পারলার, আসবাব, মোবাইল, ইলেকট্রিক্যাল, মোটরসাইকেল সার্ভিসিং সেলুনসহ বিভিন্ন পেশায় এখন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কাজ করছেন।

প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের ৫০ জনের মধ্যে ৪৮ জন আয়মূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এঁদের অধিকাংশই যেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, সেখানে কাজের সুযোগ পেয়েছেন। এঁদের মধ্যে সাতজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি প্রশিক্ষণ নিয়ে পা দিয়ে মোবাইল সার্ভিসিং করছেন। এটি এক অর্থে বিস্ময়কর। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যদি যোগাযোগ, কর্মপরিবেশসহ কিছু বিষয় নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তঁারা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রায় সবাই আয়মূলক কাজে যুক্ত হতে পারেন। তাঁরা সামাজিক মর্যাদা নিয়ে সমাজে বসবাস করতে পারেন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্মিলিতভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে পরিকল্পনা নিতে হবে।

উৎপল মল্লিক

উৎপল মল্লিক

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য আমরা যুক্তরাজ্য সরকারের সহযোগিতা পাচ্ছি। এটা আমাদের জন্য ভালো দিক। বিশ্বের অনেক দেশই এই সহায়তা পাচ্ছে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে কার্যকর মডেল তৈরি হয়েছে। এই মডেলের সঙ্গে যেসব প্রতিবন্ধী সংগঠন যুক্ত হয়েছে, তাদের চিন্তার বিকাশ ঘটেছে।

আমরা এখন জানি, কারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে কাজ করতে পারবে। কারিগরি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কী করা সম্ভব। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে ৫ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করেছে। এটা ভালো উদ্যোগ। এসব বিষয়কে আরও ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা যুক্তরাজ্য সরকারকে অনুরোধ করব, তারা যেন আমাদের সহায়তা অব্যাহত রাখে। প্রথম আলো অনেক সামাজিক কাজ করে। তারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্যও এগিয়ে আসবে বলে আশা করি।

সালমা মাহবুব

সালমা মাহবুব

আমি একজন প্রতিবন্ধী মানুষ। আমি জানি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কষ্ট কী। অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি লেখাপড়া শিখেও কাজ পাচ্ছেন না। চাকরির কোটা না থাকায় শিক্ষিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও চাকরি পাচ্ছেন না। অধিকাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পোশাকশিল্পে কাজ করছেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এভাবে এগিয়ে আসছে না। যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা সভা করি, সেসব প্রতিষ্ঠানে যদি ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে চাকরি দেয়, তাহলেও তাঁদের অনেক উন্নতি হয়। আমাদের কর্মপরিকল্পনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাজেটে তঁাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না। কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণের জন্য যে বাজেট প্রয়োজন, সেটি পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ব্যবসা করছেন, তাঁদের সহজে মূলধনের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নানা বাধার জন্য চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারছেন না।

মো. মাহমুদ হাসান তালুকদার

মো. মাহমুদ হাসান তালুকদার

স্বাধীনতার পর থেকে আমারা বাংলাদেশে কাজ করছি। আজকের আলোচনায় প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান—এই দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরির ব্যবস্থা করি। আমরা বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করি। তাদের কী ধরনের মানবসম্পদ প্রয়োজন, সেটি যাচাই করি। সেভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ অন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করি। সারা বাংলাদেশে কী ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ দরকার, তার একটি জরিপ করতে হবে। সরকার, এনজিও ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন মিলে এ কাজ করতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে যুক্ত করতে পারলে, তাঁদের ভাগ্যের উন্নয়ন হবে। তঁারা দেশের জন্য সম্পদ হয়ে উঠবেন।

মুর্তেজা খান

মুর্তেজা খান

অনেক দিন থেকে দেশে চাকরির সংকট। আমাদের উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এসব সংগঠনকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। এরা কারিগরি ও নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করতে হবে। অভিজ্ঞতায় দেখছি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ বেশি কার্যকর। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কীভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের গ্রহণ করছেন, এর ওপর তাঁদের সফলতা নির্ভর করে। এত দিন পোশাক খাতেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের বেশি সুযোগ ছিল। এখন ট্যুরিজমসহ আরও কিছু খাতে তাঁদের চাকরি হচ্ছে। আমরা আরও অনেক ধরনের প্রতিষ্ঠানে তাঁদের চাকরির জন্য যোগাযোগ করছি।

খন্দকার জহুরুল আলম

খন্দকার জহুরুল আলম

ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব পারসন্স উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিতে (ইউএনসিআরপিডি) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের কথা বলা আছে। প্রতিবন্ধী অধিকার সুরক্ষা আইনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের কথা বলা আছে। সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর কর্মপরিকল্পনা আছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে এটা অনুমোদিত হয়। এই কর্মপরিকল্পনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান, চাকরির ক্ষেত্রে কোটা, আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি সংস্থার দায়িত্ব, করপোরেট প্রতিষ্ঠানে ১০ শতাংশ চাকরি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কর রেয়াত ইত্যাদি বিষয়ে বলা আছে।

কার্যকর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এনজিও ব্যুরো, জনপ্রশাসন, অর্থ, শিল্প, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া আছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কীভাবে প্রশিক্ষণ হবে, কীভাবে কর্মসংস্থান হবে—এসব বিষয় ঠিক করার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় আজ পর্যন্ত তাদের নিয়ে একসঙ্গে বসতে পারেনি। তাদের একমাত্র কাজ হলো এতিমদের দেখাশোনা করা। আর প্রতিবন্ধীদের মাসে ৮৫০ টাকা ভাতা দেওয়া। তাঁরা কীভাবে অধিক আয় করতে পারেন, সেদিকে তাঁদের কোনো ভাবনা নেই।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কল্যাণে সমবায় সমিতি করতে গিয়ে আমাদের প্রতিনিধিরা ফিরে এসেছেন। সেখানে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শুধু বিসিএস জবের ক্ষেত্রে কোটা উঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এখন কোনো চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পাচ্ছেন না। যখনই প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ হয়, তখন এক হাজারের বেশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিয়োগ পান। এবার মাত্র ২৫৪ জন লিখিত পরীক্ষায় নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা স্মার্ট না বলে ভাইভায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি নিয়ে হাইকোর্টে রিট করতে হয়েছে।

এম মাহ্জুজ আলী

এম মাহ্জুজ আলী

২০১২ সাল থেকে ব্র্যাকের স্টার মডেল শুরু হয়। শুরু থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ১০ শতাংশ এ মডেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ব্র্যাকের স্টার মডেলে প্রায় ৬ হাজারের বেশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর ৯০ শতাংশ কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত। অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যোগাযোগের ব্যবস্থা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেকে মনে করেন, তাঁরা কিছুই পারবেন না। যদি এ ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন না হয়, তাহলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অনেক কিছুই করা সম্ভব হবে না।

তাঁদের নিয়ে অনেক কুসংস্কার আছে। এ জন্য তাঁরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ২০২০ সাল থেকে আমরা এসব বিষয়ে কাজ করছি। আমাদের কিছু গবেষণা আছে।

এসব বিষয় মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।

আসাদুজ্জামান চৌধুরী রাসেল

আসাদুজ্জামান চৌধুরী রাসেল

আমরা এডিডি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে কাজ করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থান করা। কতটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারব, প্রথমে এ বিষয়ে সংশয় ছিল। কারণ, যঁাদের সামান্য সমস্যা, তঁাদের কোনো না কোনো কাজে যুক্ত করা সহজ। কিন্তু যঁারা চরম প্রতিবন্ধী, অর্থাৎ যঁাদের দুটি হাত নেই, একটি পা নেই, কেউ হয়তো শুনতে পায় না বা হুইলচেয়ার ছাড়া চলতে পারে না, তঁাদের কীভাবে কর্মসংস্থান করব, সেটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল।

আবার এঁদের পরিবার থেকেও রাজি ছিল না। কারণ, তারা মনে করত এরা কোনো কাজ করতে পারবেন না। যারা এদের প্রশিক্ষণ দেবে, অনেক ক্ষেত্রে তারাও রাজি হতে চায়নি। কিন্তু আমরা তাদের বুঝিয়ে রাজি করাই।

এখন আমরা আনন্দিত যে তারা প্রত্যেকেই আগ্রহের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। প্রায় সবাই আয়মূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তবে আমরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলাম, সেটা হলো তাদের যোগাযোগের ভালো ব্যবস্থা করেছিলাম। বাড়ির পাশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলাম। যঁার হুইলচেয়ার প্রয়োজন, তঁাকে এটা দিয়েছিলাম। যিনি কানে শোনে না, তঁাকে হিয়ারিং এইড মেশিন দিয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে প্রতিষ্ঠানে তঁারা কাজ শিখেছেন, তারাই তঁাদের কাজে লাগিয়েছে।

আমরা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করেছি। তারাও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহযোগিতার কথা বলেছেন। এটা একটা ভালো উদ্যোগ ছিল। এ উদে্যাগ লমান থাকলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কল্যাণ হবে।

তাহেরা জাবিন

তাহেরা জাবিন

বিশ্বে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান ৩৬ শতাংশ। সেখানে আমাদের দেশে কত শতাংশ, তা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। কারণ, আমাদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। যাঁরা চাকরিতে আছেন, তাঁদের বেতন খুব কম। চাকরির নিরাপত্তা নেই। নারীদের অবস্থা এ ক্ষেত্রে আরও খারাপ। মানসিক প্রতিবন্ধিতার বিষয়টি এখানে আনতে হবে। এটি সব সময় অবহেলিত থেকে যায়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান করতে পারলে তাঁরা জিডিপিতেও ভূমিকা রাখবেন।

আমাদের প্রতিবন্ধিতা নীতিতে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোটাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা বলা আছে। ৮৫ শতাংশ চাকরি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। কিন্তু এ খাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরির সুযোগ তেমন হচ্ছে না। প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোয় দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাব আছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাই যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষক হতে পারেন, সেদিকে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত এবং এনজিওগুলোর মধ্যে একটি সমন্বয় করতে হবে। এখনো অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতায় বাধা রয়েছে। যুক্তরাজ্য সরকার বিশ্বের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নাগরিক অধিকারসহ স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ২০১৮ সালে কেনিয়ায় যুক্তরাজ্য ও কেনিয়া সরকার যৌথভাবে বৈশ্বিক প্রতিবন্ধী সম্মেলন করে। সেখানে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছিল। এরপর ২০২২ সালে নরওয়ে এবং ঘানা সরকার যৌথভাবে নরওয়েতে বৈশ্বিক প্রতিবন্ধী সম্মেলনের আয়োজন করে। দ্বিতীয় সম্মেলনেও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে এ সম্মেলনে সরকার, নাগরিক সমাজ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধি একসঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা এই সম্মেলনে ১১টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার এসব বাস্তবায়ন করবে।

এখন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব সরকারকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করা। সরকার কী করছে, সে বিষয়ে খোঁজ রাখা। তাহলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে আরও সফলতা আসবে।

সাজ্জাদ কবীর

সাজ্জাদ কবীর

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রথমে প্রতিবন্ধিতার ধরন ঠিক করতে হয়। এ সময় অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বাদ পড়ে যান। যেমন স্টার মডেলে একটা ন্যূনতম যোগ্যতা লাগে। আবার যাঁদের জমি আছে, তাঁরাও এ মডেলে আসতে পারবেন না। তাই নির্বাচনের সময় অনেকে বাদ পড়ে যান। আবার প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনের ৩৩ ও ৩৫ ধারায় যোগ্যতার কথা বলা আছে। এসব ধারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে।

একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বলা হচ্ছে, যোগ্যতা থাকলে প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন। তিনি যোগ্যতা কোথায় পাবেন? এ জন্য আমরা বাড়িতে প্রশিক্ষণ শুরু করেছি। একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে চার মাস বাড়িতে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এরপর তিনি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আসতে পেরেছেন। আমাদের প্রকল্পে ৩০ জন প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এর ২৯ জনের চাকরি হয়েছে।

ফিরোজ চৌধুরী: আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

সুপারিশ:

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তার সঙ্গে স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়টিতে জোর দিতে হবে।

• দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের জন্য রিসোর্স পারসন তৈরি করা প্রয়োজন

• জরুরিভিত্তিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয় করতে হবে।

• প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়নে ভূমিকা নেওয়া জরুরি

• সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আয়মূলক কাজে যুক্ত করতে হবে।

• প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, সে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

• সারা দেশে বিশেষ শিক্ষা বিদ্যালয় সরকারি অর্থায়নে হওয়া উচিত।

• প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশেষ শিশুদের জন্য একজন বিশেষ শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন।

• প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন, সরকার এবং এনজিওদের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।