ক্যানসার ও বিরল রোগের চিকিৎসা ব্যয়: বেসরকারি অংশীজনের ভূমিকা
অংশগ্রহণকারী
মো. এনামুল হক
মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট
রোবেদ আমিন
লাইন ডিরেক্টর (এনসিডিসি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
পরিচালক, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
মো. আজিজ ইসলাম
কনসালট্যান্ট ফিজিশিয়ান জেনারেল, ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব মেডিকেল সার্ভিস
কামরুজ্জামান চৌধুরী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার ও জেনারেল হাসপাতাল
তাসনিম আরা
অধ্যাপক, হেমাটোলজি ও বিএমটি বিভাগ,
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর
প্রকল্প পরিচালক, এটুআই
মোহাম্মদ আফরোজ জলিল
কান্ট্রি ম্যানেজার, রোশ বাংলাদেশ
তাহমিনা গাফ্ফার
প্রেসিডেন্ট, অপরাজিতা সোসাইটি
অ্যাগেইনস্ট ক্যানসার
নাবিলা পূর্ণ
প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট, ইউএনএফপিএ
আলবাব-উর রহমান
প্রোগ্রাম কো–অর্ডিনেটর, স্বাস্থ্যপুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচি, ব্র্যাক
শিশির মোড়ল
বিশেষ প্রতিনিধি, প্রথম আলো
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন
মো. আরিফ রায়হান
হেলথকেয়ার সিস্টেমস পার্টনার, রোশ বাংলাদেশ
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ক্যানসারের রোগী বাড়ছে। ক্যানসারের চিকিৎসা আছে। কিন্তু খুবই ব্যয়বহুল। যদি প্রাথমিক অবস্থায় ক্যানসার ধরা পড়ে, তাহলে এ রোগ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি। এক নারী সরকারি কর্মকর্তার কথা জানি। তিনি সন্দেহ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরীক্ষা করেছেন। ক্যানসার ধরা পড়েছে। যাবতীয় চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছেন। এখন তিনি ক্যানসারের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছেন।
সাধারণ মানুষের পক্ষে ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয় বহন করা কঠিন। নাগরিক সমাজসহ সবাই মিলে একটা ট্রাস্ট ফান্ড করা জরুরি। ক্যানসার নিয়ে এখন খুব বেশি ভয় নেই। অনেক আধুনিক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। ক্যানসার চিকিৎসার বিভিন্ন দিক আজকের আলোচনায় আসবে।
মো. এনামুল হক
গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৮-১৯ সালে বাংলাদেশে ক্যানসারের রোগী ছিল প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার। এর মধ্যে দেখা গেছে, ৬০ হাজার রোগী কোনো চিকিৎসা নেয়নি। একটা আন্তর্জাতিক জার্নালে দেখা গেছে, ক্যানসারের ধরনের জন্য খরচও কম-বেশি হয়। সার্ভিক্যাল ক্যানসারের খরচ সবচেয়ে কম। তা-ও খরচ গড়ে প্রায় ৬ লাখ ১০ হাজার টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ কোলন ক্যানসারের ব্যয় বের করেছিলেন। এটা তিনি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করেছেন।
তাতে তিনি দেখিয়েছেন কোলন ক্যানসারে গড়ে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। এটা শুধু চিকিৎসার খরচ। কিন্তু একজন রোগীর কয়েক মাস চিকিৎসা নিতে হয়। তাঁদের সঙ্গে দু-তিনজন মানুষ থাকে। মাসব্যাপী তাঁদের যোগাযোগ, থাকা-খাওয়ার খরচ ধরলে সেটা অনেক হবে।
একজন ক্যানসারের রোগীর সার্জারি, কেমো, রেডিওথেরাপি—প্রায় সবাই লাগে। ২০৩০ সালের মধ্যে সরকার ইউনিভার্সেল হেলথকেয়ার দেবে। ২০১২ সালে হেলথকেয়ার ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হয়েছিল। এ সময় আউট অব পকেট ব্যয় ছিল ৬৪ শতাংশ। একজন মানুষের মোট আয়ের ১০ ভাগের বেশি যদি স্বাস্থ্য খাতে খরচ হয়, সেটা হলো আউট অব পকেট ব্যয়।
আমাদের শিক্ষা, বিয়েশাদি—সবকিছুর বাজেট আছে। কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য কোনো বাজেট থাকে না। এই সরকার দরিদ্র ও স্বাস্থ্যবান্ধব সরকার। করোনায় আমরা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ভ্যাকসিন কিনেছি। প্রায় সবাই বলে যে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট কম। কিন্তু সেই কমটাই খরচ করতে পারি না। জিডিপির দশমিক ৭ শতাংশ খরচ করতে পারি। এই জায়গায় আমাদের কাজ করতে হবে। অনেক হাসপাতালে টাকা থেকে যায়। তারা দরিদ্র রোগীদের জন্য অনেক জরুরি ওষুধ কিনতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কেনে না।
কিন্তু ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ সব ধরনের পরীক্ষা নিজেরা করছে। মোট খরচের একটা অংশ তারা রোগীদের কাছ থেকে নেয়। এতে রোগীদের অনেক উপকার হয়েছে। একটা গ্রুপ চায় না যে সব পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে হোক।
ইউনিভার্সেল হেলথকেয়ার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশাল জটিলতা আছে। আমরা ধীরে ধীরে এসব সমস্যার সমাধান করে ইউনিভার্সেল হেলথকেয়ার সেবা চালু করব। তখন দরিদ্র মানুষ বিনা পয়সায় স্বাস্থ্যসেবা পাবে।
তাহমিনা গাফ্ফার
আমি একজন ক্যানসার রোগী। ক্যানসারের চিকিৎসা কতটা ব্যয়বহুল, নিজে রোগী না হলে বুঝতে পারতাম না। রোগীদের অসহায়ত্ব কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না। আর ক্যানসার যাঁদের হয়, তাঁরা প্রচণ্ড মানসিক রোগে ভুগতে থাকেন। তাঁদের সব সময় মনে হয়, এই বুঝি মারা যাবেন। অনেকে বলেন যে একসময় তাঁরা জাকাত দিতেন। ক্যানসারের চিকিৎসা করতে করতে আজ সর্বস্বান্ত। এখন তাঁরা কারও সাহায্য ছাড়া চিকিৎসা করতে পারেন না। একটা শিশুকে একবার তার মা অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে হয়তো কেমো দিলেন। কিন্তু পরেরবার ওই শিশুর মায়ের আর কেমো দেওয়ার সামর্থ্য থাকে না। শিশুদের কষ্ট যখন দেখি, তখন আর আমরা সহ্য করতে পারি না। রাতে আমাদের ঘুমের সমস্যা হয়। সত্যি কথা বলতে, রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয়।
অনেক রোগী বলেন যে তাঁকে যেন কম দামি ওষুধ দেওয়া হয়। দামি ওষুধ কিনতে পারবেন না। আমি ভারতের মুম্বাইতে গেলাম চিকিৎসা করাতে। ওখানকার চিকিৎসক বললেন, ‘আপনাদের দেশে ভালো ডাক্তার আছেন। তাঁরা ভালো চিকিৎসা করেন। সেখানেই আপনার খরচ কম হবে।’
সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যম ভূমিকা রাখে। আমরা নাটক–সিনেমায় দেখে থাকি, ক্যানসার রোগীরা ধীরে ধীরে মারা যায়। তবে গণমাধ্যমের প্রচারের ফলে এখন মানুষ জানে, ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসা আছে। ক্যানসার হলে কী ধরনের চিকিৎসা করতে হয়ে, কীভাবে সচেতন হতে হয়। এখন প্রায় সবই মানুষের জানা।
কিন্তু অনেকে চিকিৎসা করতে দেরি করেন। তাঁরা নিজেকে অবহেলা করে পরিবারের সবার যত্ন করেন। ফলে তাঁরা এমন সময় চিকিৎসকের কাছে যান, যখন ক্যানসার আর প্রাথমিক স্তরে থাকে না। ক্যানসারের রোগী পরিবার থেকেও অবহেলা পান। অনেকে তাঁকে ছেড়ে যান।
শিশির মোড়ল
আমি চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু ক্যানসারসহ স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করতে হয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আলোচনা করতে চাই। সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো পুলিৎজার। ২০১১ সালে সিদ্ধার্থ মুখার্জি নামের এক চিকিৎসক পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি যে বইয়ের জন্য পুরস্কার পেয়েছিলেন তার নাম ছিল দ্য এম্পারার অব অল মেলাডিস আ বায়োগ্রাফি অব ক্যানসার। বইটিতে তিনি লিখেছেন যে ক্যানসার কোনো একটিমাত্র রোগ নয়। এটি অনেক রোগের সমাহার। আমরা এদের সবাইকে ক্যানসার বলি। কারণ, এদের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেটি হচ্ছে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এখান থেকে আমি ক্যানসার সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করেছি।
আমরা যদি হৃদ্রোগ, কিডনি বা ডায়াবেটিসের চিকিৎসার কথা বলি, তাহলে কোথায় যেতে হবে, সেটা নিয়ে একধরনের ধারণা পাই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ক্যানসারের ক্ষেত্রে সেটা পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে আমরা দ্রুত বলতে পারি না যে কোথায় গেলে ক্যানসারের ভালো চিকিৎসা হবে বা ভালো চিকিৎসক আছে। এ ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি আছে নেতৃত্বের। এ জন্য বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। আমাদের দেশে ক্যানসারের চিকিৎসা কিছুটা এলোমেলো। এ জন্য কেউ যখন ক্যানসারে আক্রান্ত হন, তখনই তাঁরা ভারতে যাওয়ার কথা চিন্তা করেন। বেশি টাকা থাকলে অন্য দেশে যাওয়ার কথা চিন্তা করেন।
এ ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট নেতৃত্ব দিতে পারত। আমার বাবার ক্যানসার চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে গেলাম। বিশেষ একটা পরীক্ষা চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে করতে বলল। কিন্তু সেই পরীক্ষার সিরিয়াল পড়ল প্রায় ছয় মাস পর।
কেন যেন মনে হয়েছে, ক্যানসারের ওষুধে একটা মনোপলি আছে। এটা ভাঙার ব্যবস্থা
করা দরকার।
মোহাম্মদ আফরোজ জলিল
সহস্রাব্দ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে স্বাস্থ্য খাতে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসায় বিশেষ নজর দিতে হবে। ক্রমবর্ধমান ক্যানসার রোগীর চিকিৎসাসেবা সরকারের একার পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি অংশীদারিত্ব জোরালো করতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে আটটি বিভাগীয় ক্যানসার সেন্টার স্থাপন করছে, যা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যয় একটি বড় বাধা হবে। বিশেষ করে ক্যানসারের চিকিৎসাসেবা দেশে সুনিশ্চিত করতে হলে এর কাঠামোগত উন্নয়ন এবং সেবা ব্যয় সাশ্রয়ী হতে হবে। ক্যানসারসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একটি স্বচ্ছ কাঠামোর মাধ্যমে সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। উদ্ভাবনী পদ্ধতি নিয়ে যেন সরকার, রোগী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবাই লাভবান হয়।
রোশ-এর মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। অভিজ্ঞতা বিনিময়, বিভিন্ন চিকিৎসাসেবা মডেল বিনিময়, দক্ষতা উন্নয়ন ছাড়াও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ওষুধ, রোগনির্ণয়সেবা, তথ্য-উপাত্ত এবং সর্বশেষ গবেষণায় উঠে আসা তথ্যাদি রোগীর কল্যাণে নিয়োজিত করতে সক্ষম, যা সরকারের সময়, বৈদেশিক মুদ্রা এবং চিকিৎসা ব্যয় সাশ্রয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এ ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে নীতিমালা যেমন ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, একটি বহুমাত্রিক (মাল্টিসেক্টরাল) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
রোশ বাংলাদেশে গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সেবা দিয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও এই সেবা চলমান রাখতে বদ্ধপরিকর। তবে সরকারের সহযোগিতা এবং অংশীদারত্ব পেলে আরও বড় পরিসরে সেবা দেওয়া সম্ভব, যা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এ ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উদ্ভাবনী ব্যবসাপদ্ধতি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
পপুলেশন বেজড ক্যানসার রেজিস্ট্রি বাস্তবায়ন করতে হবে। বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসাসেবা নিয়ে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। ক্যানসার নির্ণয়ে আধুনিক রোগনির্ণয় সেবা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগনির্ণয়ে মনোযোগ দিতে হবে।
তাসনিম আরা
ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয় যে অনেক বেশি, সেটা সবাই জানি। আমাদের রোগীরা ক্যানসারের ব্যাপারে সচেতন নন। দেশে ক্যানসারের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ কম। এত বেশি রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়া অনেক কঠিন। রোগীরা সাধারণত এত দেরি করে আসেন যে তখন শরীরে ক্যানসার মারাত্মক আকার ধারণ করে। ব্লাড ক্যানসার খুব দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে যায়। এক মাসের মধ্যে ভর্তি করতে না পারলে রোগী মারা যাবে। এমন অবস্থায়ও তাদের ভর্তি করতে পারি না। কারণ, অধিকাংশ সময় বেড খালি থাকে না।
অ্যাকিউট মাই লয়েড ক্যানসার নামে একধরনের ক্যানসার আছে। এর মধ্যে একটা ভ্যারাইটি আছে, যার ৯০ ভাগ সেরে যায়। এর চিকিৎসা ব্যয়ও খুব বেশি নয়। আমরা রোগীদের বলি যে চিকিৎসা ব্যয় খুব বেশি হবে না। আমরাও সহযোগিতা করব। আমাদের এখানে চিকিৎসক, নার্স, বেডভাড়া—সবই ফ্রি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা শুধু ওষুধের খরচটুকুও বহন করতে পারেন না। যাঁরা গরিব, তাঁদের আত্মীয়স্বজনও গরিব থাকেন। তাঁরা কোনোভাবেই টাকা সংগ্রহ করতে পারেন না। ঢাকা মেডিকেলে এসব রোগীর অবস্থা খুব খারাপ।
আমাদের দেশে ক্যানসারের পরীক্ষা খুব ভালো হয় না। একেক জায়গায় একেক রকম রিপোর্ট আসে। এ জন্য পরীক্ষার জন্য ভারতে পাঠাতে হয়। আমাদের নিবন্ধিত কোনো প্যাথলজি নেই। এরা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলছে। প্যাথলজি যেভাবে প্রতিবেদন দেয়, অনেক চিকিৎসক সেটাই মেনে নেন। কারণ, অনেক চিকিৎসকের প্যাথলজি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করার দক্ষতা নেই।
সরকারের একার পক্ষে ক্যানসারের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। এখানে এনজিও, ফার্মাসিউটিক্যালস ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের শতভাগ ক্যানসার চিকিৎসক আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আমাদের দেশে সেটা নেই। তাহলে কীভাবে রোগীরা ভালো চিকিৎসা পাবেন! আমি কার কাছে আরও শিখব। কারণ, কেউ নেই। এসব বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে বলে আমি মনে করি।
কামরুজ্জামান চৌধুরী
আমার বর্তমান কর্মক্ষেত্র আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালে প্রতিনিয়ত দেখছি, ক্যানসারের চিকিৎসা দেওয়া কত কঠিন। দেশে যদি ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য কিছু করতে হয়, তাহলে হসপিটাল বেজড অথবা জাতীয় ক্যানসার রেজিস্ট্রি করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তিনটি হাসপাতালে ক্যানসার রেজিস্ট্রি শুরু করেছে, এটা খুবই জরুরি কাজ। কারণ, কোন ধরনের বা কোন স্তরের রোগী হাসপাতালে আসছে, সেটা না জেনে কোনো পরিকল্পনা করা যাবে না।
গত এক বছরে আহ্ছানিয়া হাসপাতালে তিন হাজার ক্যানসারের রোগী এসেছেন। এর মধ্যে স্তন ক্যানসারের রোগী হলো ৫৬০ জন। ফুসফুস ক্যানসারের প্রায় ৭০০ জন। কিন্তু তাঁরা সবাই অনেক দেরি করে এসেছেন। তাহলে আমাদের স্ক্রিনিং ও প্রিভেনশনে যাওয়া উচিত।
৪০ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, আমেরিকায় স্তন ক্যানসারে মৃত্যুহার কমে গেছে। তারা স্ক্রিনিং করে শুরুতে শনাক্ত করছে। তারপর আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা প্রয়োগ করছে। এটা হলো সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। আমাদের এভাবে কাজ করতে হবে। এখন আহ্ছানিয়া মিশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তিনটি হাসপাতাল ক্যানসার রেজিস্ট্রির কাজ শুরু করেছে। এটা করলে আমরা ধারণা পাব, কোন ধরনের ক্যানসারের রোগী কোন স্তরে আসছে।
চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। ক্যানসার রেজিস্ট্রির মাধ্যমে বুঝতে পারব চিকিৎসা লাগবে কি না। এ জন্য ক্যানসার রোগীর চিকিৎসার জন্য অবশ্যই ক্যানসার রেজিস্ট্রি করতে হবে। রেফারেন্স ল্যাব অতি জরুরি। ডায়াগনসিসের জন্য কেন বাইরে যেতে হবে। দেশেই ডায়াগনসিস হতে হবে। এখন রেফারেন্স ল্যাব খুব জরুরি।
ক্যানসারের কিছু পরীক্ষা দেশের বাইরে পাঠাতে হয়। সরকার স্বাস্থ্যসেবায় কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় ক্যানসারের সব পরীক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে।
রোগী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সংস্থা মিলে চিকিৎসা ব্যয়ের একটা সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রায় কোনো দেশের সরকারই সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করে না।
ক্যানসার চিকিৎসায় টার্গেটেড থেরাপি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং দিন দিন এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। তাই টার্গেটেড থেরাপি সরকারি হাসপাতালে সহজলভ্য করার জন্য সবার কাজ করা উচিত।
আলবাব-উর রহমান
ক্যানসার সেবা উপজেলা পর্যায় নিতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একটা করে নন–কমিউনিকেবল ডিজিজ কর্নার থাকা প্রয়োজন। উপজেলায় চিকিৎসা না হলেও অন্তত পরীক্ষার ব্যবস্থাটা যেন থাকে। আমাদের নারী স্বাস্থ্যকর্মীরা গ্রামাঞ্চলে কিছু নারীর অবস্থা দেখে বুঝতে পারেন যে তাঁদের ক্যানসার হতে পারে। এখন তাঁকে অন্তত জেলা হাসপাতালে যেতে হবে। চিকিৎসার খরচ যদি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকাও হয়, তা–ও অনেকের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না।
কোনো কোনো পরিবার এই চিকিৎসা করাতেও চায় না। এমন অসংখ্য মানুষের কথা আপনারা হয়তো একেবারেই জানেন না। এ জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটা ডায়াগনসিস সেন্টার থাকা প্রয়োজন। আমাদের নারী স্বাস্থ্যকর্মীরা গ্রামের নারীদের পরীক্ষা করেন। বেসিক স্ক্রিনিংটা করেন। আবার অনেক কষ্ট করে যাঁরা ক্যানসার চিকিৎসার টাকা সংগ্রহ করছেন, তাঁরা মানসম্মত চিকিৎসা পাচ্ছেন কি না, সেটিও একটি বিষয়।
নাবিলা পূর্ণ
আমরা যদি কোনো পরিকল্পনা করতে চাই, তখন শুরুতেই তৃণমূলের কথা ভাবতে হবে। কাদের জন্য পরিকল্পনা করব, তারা কী ধরনের ক্যানসারে মারা যায়, কী ধরনের চিকিৎসা তাদের লাগবে—পরিকল্পনার সময় এসব প্রশ্ন করতে হবে। যথাযথ ক্যানসার রেজিস্ট্রি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। আমাদের নাগরিকের কারা ক্যানসার চিকিৎসা করতে আসছে, কোন স্তরে আসছে, কী ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে আসছে, তাদের কী চিকিৎসা লাগবে, সেই চিকিৎসা পেলে তারা কত দিন বাঁচবে, এটা জানতে হবে।
গ্রামের দরিদ্র মানুষেরাই সরকারি হাসপাতালে আসে। এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে, যেন সবাই চিকিৎসাসেবা পায়।
জরায়ুমুখের ক্যানসার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে এই ক্যানসার নির্মূল করতে চায়। এইচপিভির জন্য এটা হয়। এ জন্য এইচপিভি টিকাদান গুরুত্বপূর্ণ। এটা সহজে স্ক্রিনিং করা যায়। ২০০০ সালে আমরা এই কর্মসূচি শুরু করি। তখন এটা ছিল পাইলট প্রোগ্রাম। এখন এটা জাতীয় কর্মসূচি হয়েছে।
দেশের ২৫ জেলায় আমরা স্ক্রিনিং শুরু করেছি। আমরা গত দেড় বছরে ৪ লাখ ৫০ হাজার নারীর স্ক্রিনিং করেছি। ৮ হাজার নারীর পজিটিভ হয়েছে। তাঁদের ১ হাজার ৩০০ জনকে আমরা চিকিৎসার আওতায় রাখতে পেরেছি। অন্যদের আর পাওয়া যায়নি। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি আমাদের ডাক্তার, নার্সদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে যতটুকু দক্ষ হওয়ার কথা, সেটা কিন্তু তাঁরা হচ্ছেন না। এসব বিষয়ে কাজ করতে হবে।
স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম, জাতীয় অধ্যাপক ডা. আব্দুল মালিক ও কাজী দীন মোহাম্মদ তাঁরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু দৃষ্টান্ত না থাকলেও সমবেত প্রচেষ্টায় কাজ হয়। দালালদের দৌরাত্ম্য, অব্যবস্থাপনা এসব থেকে মুক্তির জন্য দরকার শিক্ষা। শিক্ষিত মানুষের কাছে কোনো দালাল যাবে না। মেধা বিকাশের জন্য তেমন অর্থ ব্যয় হয় না।
উন্নত দেশের কিছু হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের হাসপাতালের উদাহরণ দেওয়া হয়। তাদের চিকিৎসা খাতের বরাদ্দ, চিকিৎসকের সুযোগ-সুবিধা আমাদের বহুগুণ বেশি। স্বাস্থ্য খাতে আমাদের বরাদ্দ ১ দশমিক ৫ শতাংশ। এই বরাদ্দ দিয়ে সরকার ক্যানসারের মতো ব্যয়বহুল ওষুধ কিনতে পারে না। স্বাস্থ্য খাতে কেন এত কম বরাদ্দ, এটা নীতিনির্ধারণী বিষয়। এ অবস্থায় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করে লাভ নেই।
পৃথিবীতে বাংলাদেশ মনে হয় একমাত্র দেশ, যেখানে কোনো ইকোনমিক হেলথ কার্ড নেই। কেউ যদি প্রভাবশালী হন, তিনি সরকারের সর্বোচ্চ সুযোগ নিয়ে নেন। তাঁর বাড়ির কাজের মানুষটিও ওই একই হাসপাতালে যায়। ধনীদের অবশ্যই সরকারি হাসপাতালে সেবার জন্য অর্থ ব্যয় করতে হবে।
ভারতে ক্যানসারের চিকিৎসা ভালো। ক্যানসার রোগীর জন্য তাদের ট্রেন ভ্রমণ ফ্রি। আগুন লেগেছে, বন্যা হচ্ছে, সরকারকে ডাকো। নিজের টাকায় পান–সিগারেট খেয়ে ক্যানসার হচ্ছে, সরকার কেন চিকিৎসা করছে না। এভাবে তো একটা দেশ চলতে পারে না। কয়েকটি ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য। এর মধ্যে রয়েছে, জরায়ুমুখের ক্যানসার। শুধু টিকার মাধ্যমে এটা দূর করা যায়। ওরাল ক্যাভিটি ক্যানসার, তামাকজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ না করলেই এটা থেকে মুক্ত থাকা যায়। তামাক থেকে এনবিআর যে রাজস্ব পায়, এর কয়েক গুণ বেশি অর্থ ব্যয় হয় তামাক থেকে শারীরিক ক্ষতির চিকিৎসা ব্যয়ে। আমাদের সমন্বিতভাবে ক্যানসারের চিকিৎসা থেকে প্রতিরোধে জোর দিতে হবে।
মো. আজিজুল ইসলাম
আমাদের একটা কমপ্রিহেনসিভ ক্যানসার হাসপাতাল দরকার। আমি যখন সিএমএইচে কাজ শুরু করি, তখন সেখানে কোনো ক্যানসার ওয়ার্ড ছিল না। তারপর ছোট থেকে বড় ওয়ার্ড হয়েছে। এখন একটা ক্যানসার সেন্টার হয়েছে। আমাদের এখানে রেডিও এবং মেডিকেল অনকোলজি আছে। ৩০ শতাংশ সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকি।
আমরা দ্বিতীয় রেডিওথেরাপি মেশিন আনব। এই মেশিন এলে ৭৫ শতাংশ সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দিতে পারব। এখন প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন সিভিল রোগীকে কেমোথেরাপি দিতে পারি। ক্যানসারের ক্ষেত্রে বায়োপসি করতে হয়। আমাদের দেশে বায়োপসি খুব একটা ভালো হয় না। এ ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষা করতে দুই থেকে তিন মাস চলে যায়। ওয়ান স্টপ সার্ভিস কোথায় নেই।
আমার অনুরোধ থাকবে, সরকারি হাসপাতালে যেন অনকো, হিস্টো, রেডিও, মলিকুলার, সার্জিক্যালসহ ক্যানসারের সব ধরনের পরীক্ষার সুযোগ থাকে। রেডিও অনকোলজিস্ট যা–ই থাক না কেন, মেশিন নেই। প্রয়োজনের তুলনায় ২০ শতাংশ মেশিন আছে। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রোগী রেডিওথেরাপি পায়। অন্যরা পায় না।
কোনো কোনো অনকোলজিস্ট আর সময়
নেই বলে রোগীদের ফিরিয়ে দেন। আমি মনে করি, এটি খুবই অমানবিক একটা কাজ। আমাদের কাছে রোগীরা আসে। আমাদের কিছু একটা করতেই হবে। রোগীর নিয়তির ওপর নির্ভর করে কী হবে না হবে। তবে ক্যানসারের সমন্বিত চিকিৎসার কোনো বিকল্প নেই।
দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর
আমাদের সম্পদের অভাব আছে। অংশীজনের মাধ্যমে কীভাবে পূরণ করা যায়, সেটা পরিকল্পনা করতে হবে। এটিই আজকের আলোচনার বিষয়। কিন্তু এটা সেভাবে আলোচনায় আসেনি। সরকার, ব্যক্তি খাত, রোগী, অভিভাবকসহ সবার সচেতনতার অভাব আছে। সবাইকে কীভাবে সচেতন করা যায়, সেটা পরিকল্পনা করতে হবে।
দেশে প্রায় ১৫ লাখ ক্যানসারের রোগী আছে। প্রতিবছর দুই লাখ যুক্ত হচ্ছে। সংবিধানে সরকারের প্রতিশ্রুতি হলো অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান দিতে হবে। এসডিজিতে সরকারের প্রতিশ্রুতি হলো অসংক্রামক রোগের এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে হবে। কোভিডে আমরা সীমিত সম্পদ দিয়ে বিশাল সাফল্য কীভাবে অর্জন করলাম। আমরা সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছি। সরকারি–বেসরকারি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডেটা শেয়ার হয় না। যে যার মতো চলছে। এটুআইয়ের সহযোগিতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ই–হেলথ চালু করতে যাচ্ছে। এতে রোগীরা আরও ভালো সেবা পাবে বলে আশা করি।
রোবেদ আমিন
বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত একটা ন্যাশনাল ক্যানসার স্ট্র্যাটেজি করা হয়েছিল। কিন্তু এর ব্যয় নির্ণয় ও স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না থাকায় কার্যকর করা যায়নি। তবে এর মধ্যে কয়েকটি ভালো বিষয় ছিল। এর মধ্যে ক্যানসার কন্ট্রোল কাউন্সিল, ন্যাশনাল ক্যানসার টাস্কফোর্স ও কমিটি হওয়ার কথা ছিল। এর সঙ্গে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জড়িত থাকার কথা ছিল। আসলে এসবের কিছুই হয়নি। বিশ্বে প্রায় এমন কোনো দেশ নেই, যে দেশে একটি জাতীয় ক্যানসার কাউন্সিল নেই। কিন্তু আমাদের এখনো এটা হয়নি।
একটা দেশের ক্যানসার চিকিৎসার চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সির মাধ্যমে ইম্প্যাক্ট রিভিউ হয়। প্রায় দেড় বছর সময় লাগে। ২০১৩ সালে আমাদের এমন একটি ইম্প্যাক্ট রিভিউ হয়। তাদের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় ক্যানসার চিকিৎসায় আমরা বেশ ভালো অবস্থানে ছিলাম। কিন্তু সেই সুযোগটা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি।
আমি আহ্ছানিয়া ক্যানসার হাসপাতালে গিয়েছি। কষ্ট হলেও ওখানে ক্যানসারের কমপ্রিহেনসিভ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আমরা যে ক্যানসার রেজিস্ট্রি করছি, সেখানেও কামরুজ্জামান স্যার সহযোগিতা করছেন। দুই মাসে আমরা পাঁচ হাজার রোগীর ফলোআপ দেখেছি। আমাদের যেকোনো পরিকল্পনার জন্য ক্যানসার রেজিস্ট্রির কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট বিশাল সেবা দিচ্ছে। এই হাসপাতালের বেড পূর্ণ হয়ে বারান্দা থেকে রাস্তা পর্যন্ত রোগী শুয়ে আছে। সে জানে দেরি হলেও তার চিকিৎসা হবে। এত রোগীকে কোয়ালিটি সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। সরকার একটা ভালো উদ্যোগ নিচ্ছে। আট বিভাগে ক্যানসার ইউনিট করা হবে। এখানে প্রায় এক হাজার বেড থাকবে। তখন মানুষ আরও সেবা পাবে।
সরকার স্বাস্থ্যের বিষয়ে খুবই সচেতন। অর্থ আমাদের বড় সমস্যা হবে না। কেমো দিতে হলে, রেডিওথেরাপি দিতে হলে পরিকল্পনা লাগে। সেটা এখনো করা হয়নি। তবে এখন সময় এসেছে এসব করার। আজকের আলোচনায় ক্যানসার চিকিৎসায় যেসব পরামর্শ এসেছে, আমরা সেসব কাজে লাগানোর চেষ্টা করব।
ফিরোজ চৌধুরী
ক্যানসার চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। অর্থের অভাবে অনেক দরিদ্র মানুষ চিকিৎসা করতে পারেন না। তাঁদের জন্য তহবিল সহায়তা জরুরি। আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
সুপারিশ
* পপুলেশন বেজড ক্যানসার রেজিস্ট্রি বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি।
* সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসায় জীবন রক্ষাকারী টার্গেটেড থেরাপি সহজলভ্য করা জরুরি।
* প্রাথমিক স্তরে ক্যানসার নির্ণয় করা গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা নিরাময় করা সম্ভব।
* দেশে ক্যানসারের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে বেসরকারি অংশীদারত্ব, সংযোগ ও সমন্বয় জোরালো করতে হবে।
* ক্যানসারের চিকিৎসায় নাগরিক সমাজসহ সবাই মিলে একটা ট্রাস্ট ফান্ড
করা জরুরি।
* ক্যানসার চিকিৎসায় রেফারেন্স ল্যাব করা অতি জরুরি।
* ক্যানসার চিকিৎসার কোনো পরীক্ষা যেন দেশের বাইরে করতে না হয়, সে বিষয়ে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে।
* জাতীয় পর্যায়ে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসাসেবা নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
* প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একটা নন–কমিউনিকেবল ডিজিজ কর্নার থাকা প্রয়োজন।