চাই কৃষিতে নারীর কাজের স্বীকৃতি

পারিবারিক কৃষিতে নারীর শ্রম ও টেকসই কৃষি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে একশনএইড বাংলাদেশ।

বলাই কৃষ্ণ হাজরা,মোয়াজ্জেম হোসেন, ফারাহ কবির ও ইমানুন নবী খান

কৃষিতে নারীর বড় অবদান থাকা সত্ত্বেও স্বীকৃতি নেই। নারীর অবদানকে স্বীকার করে স্বীকৃতির পাশাপাশি নারী কৃষকদের নিয়ে সমবায় গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক বাজারজাত থেকে শুরু করে কৃষি ব্যবস্থাপনায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে এক গোলটেবিল আলোচনায়।

একশনএইড বাংলাদেশের আয়োজনে ও নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহযোগিতায় গতকাল রোববার ‘পারিবারিক কৃষিতে নারীর শ্রম ও
টেকসই কৃষি’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো

আলোনায় অংশ নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (বীজ) বলাই কৃষ্ণ হাজরা বলেন, বীজ সংরক্ষণে নারীর ভূমিকা অনেক। কৃষিতে মানসম্পন্ন বীজ না হলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। দেশের বীজের বড় অংশ আসে এই কৃষকদের কাছ থেকে। সরকার নারীর ক্ষমতায়ন ও কৃষিতে অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে জানিয়ে তিনি সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা তুলে ধরেন।

বীজ বাজারজাতকরণে নারীর অংশগ্রহণ থাকলে পরিবারে আর্থিক সংগতি বৃদ্ধি পাবে বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, কৃষিকে নারী ব্যতীত চিন্তা করার সুযোগ নেই। সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে নারী কৃষকদের মূল ধারায় নিয়ে আসার জন্য কাজ করছে।

সভাপতির বক্তব্যে একশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, নারী কৃষকদের বিষয়ে যেসব সুপারিশ এসেছে, তা বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। নারীদের প্রশিক্ষণ, আত্মবিশ্বাস ও স্বীকৃতির পাশাপাশি সংঘবদ্ধ করতে হবে। সমবায় করতে হবে। সম্মিলিত শক্তি একটি বড় শক্তি। নারী যাতে নিরাপদভাবে কৃষিবাজারে ঢুকতে পারেন, সে বিষয়েও কাজ করার কথা বলেন তিনি।

নারীদের সমবায়ের ওপর জোর দেন ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) মিসিং মিডল ইনিশিয়েটিভের সমন্বয়ক ইমানুন নবী খান। তিনি বলেন, সমবায় করে কাজ করতে পারলে নারীরা নিজেদের দর-কষাকষির জায়গা তৈরি করতে পারবে। এখনো ব্যাংকগুলো দলীয়ভাবে কৃষকদের কোনো সমবায়কে ঋণ দেয় না বলে উল্লেখ করেন তিনি। করোনার সময়ে নারী কৃষকদের ভূমিকার কথাও তুলে ধরেন ইমানুন নবী।

সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, পারিবারিক কৃষিতে নারীর বড় ভূমিকা রয়েছে। তাঁর সেই মর্যাদাটা দিতে হবে। তাহলে টেকসই কৃষির জায়গা তৈরি হবে।

এশীয় খাদ্যনিরাপত্তা নেটওয়ার্কের (এএফএসএন) আঞ্চলিক সমন্বয়ক আহমেদ বোরহান মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা স্বীকার করা হয় না। এখনো অর্ধেকের বেশি সিদ্ধান্ত আসে পুরুষের দিক থেকে। তিনি বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পারিবারিক কৃষির সুরক্ষা ও বিকাশে সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তোলা, গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি, কৃষিতে নারীদের জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান করা, পারিবারিক কৃষি প্ল্যাটফর্ম চালু, যুব ও নারী কৃষকদের সংগঠনকে শক্তিশালী করা।

নারী যেসব কৃষির সঙ্গে জড়িত আছে, সেসব কৃষিকে ব্যবসার সঙ্গে যোগ করার কথা বলেন বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার ওসমান হারুনি। বাজারে কী ধরনের চাহিদা, সে চাহিদার সঙ্গে নারীকে যুক্ত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নারীর দক্ষতা বাড়াতে হবে। বাজারের সঙ্গে যুক্ত করা গেলে নারী আয়ের ক্ষেত্রে আরও ভূমিকা রাখতে পারবেন। নারী কৃষকেরা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হলে বাজারে অনেক ভূমিকা রাখতে পারেন বলে মনে করেন ওসমান হারুনি।

জমিতে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) উপনির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান। তিনি বলেন, উৎপাদনের মূল হচ্ছে জমি। সেই জমিতে নারীর প্রবেশাধিকার নিয়ে ভাবতে হবে। খাসজমি পাওয়ার আইনটাকে বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে সংশোধনের আহ্বান জানান তিনি।

হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আতাউর রহমান বলেন, এখনকার কৃষি যান্ত্রিক হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে নারীর অংশগ্রহণ কীভাবে হবে, সেটা ভাবতে হবে। কৃষির অগ্রগতির কথা বললে সেখানে নারী যাতে ছিটকে না পড়েন, পিছিয়ে না থাকেন, এর পরিকল্পনাও সরকারকে করতে হবে।

বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিএআরই) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন বলেন, কৃষিতে নারীর বড় অবদান থাকলেও এখনো আলাদা পরিচয় হয়নি। জিডিপিতেও তা যুক্ত হয় না। সেই পরিচয় ও কাজের স্বীকৃতি সবচেয়ে বেশি জরুরি। অনেক নীতি প্রণয়ন হয়। কিন্তু প্রয়োগ বা চর্চা হয় না। সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, কৃষিতে নারীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

মারিয়া সিড টেকনলজির কৃষি বিশেষজ্ঞ এ কে এম জাকারিয়া একটি গ্রামের উদাহরণ দিয়ে বলেন, নারীকে সঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে তাঁরা ভালো মানের বীজ তৈরি করতে পারবেন। বীজ তৈরির মাধ্যমে জিডিপিতে নারী যে অবদান রাখছেন, তার জন্য কী করা হচ্ছে এবং সরকারের বাজেট কী, সে প্রশ্ন রাখেন তিনি।

এএফএর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী আমিরুল ইসলাম বলেন, কৃষিঋণ থেকে শুরু করে বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে নারীদের যুক্ত করতে হবে। তাঁদের পথ করে দিতে হবে। নারী কৃষকদের গৃহস্থালির কাজের ভারও অন্যকে নিতে হবে। তাঁকে সাহায্য করতে পারলে তিনি আরও বেশি কৃষিতে মনোযোগ দিতে পারবেন।

প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরীর সঞ্চালনায় ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিলে আরও বক্তব্য দেন বিন্দু নারী উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি জান্নাতুল মাওয়া ও বাংলাদশে কৃষাণী ফেডারেশনের শামসুন্নাহার ডলি।