পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করতে হবে নগরবাসীকেও

বক্তারা বলেন, পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বিতভাবে কাজ করলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ–সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব।

রাজধানীর পয়োবর্জ্যের ব্যবস্থাপনা অনিয়ন্ত্রিত। এ কারণে বেশিরভাগ বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় জলাধারে মিশে নিরাপদ পানির উৎসগুলো ধ্বংস ও দূষিত করছে। পয়োবর্জ্যের সমস্যা সমাধানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা সম্পর্কে নগরবাসীকে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দিতে হবে। নগরবাসী সমস্যাটি অনুধাবন না করলে সমাধান হবে না। কাজেই পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নগরবাসীকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনও জরুরি।

গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), ইউনিসেফ ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘নিরাপদ স্যানিটেশন: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের রোডম্যাপ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সভাকক্ষে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তারা আরও বলেন, পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বিতভাবে কাজ করলে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতীয়ভাবে এ–সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সম্ভব।

গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও ইউনিসেফের কারিগরি উপদেষ্টা মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ঢাকার স্যানিটেশন অবস্থা একটু নাজুক। এ বার্তা নগরবাসীর কাছে পৌঁছাতে হবে। কারণ, তাঁরাই বর্জ্য শৌচাগার থেকে বের করে দিচ্ছে। জনগণের সচেতনতা ছাড়া পরিকল্পনায় এগোনো যাবে না।

গবেষণার তথ্য উপস্থাপন করে মুজিবুর রহমান বলেন, রাজধানীর মাত্র ২৫ ভাগ বাসাবাড়ির পয়োবর্জ্য ওয়াসার নালায় যায়। বাকি ৭৫ ভাগ পয়োবর্জ্য সেপটিক ট্যাংকে থাকে। নালার মাধ্যমেও বর্জ্য শোধনাগারে পৌঁছাচ্ছে না। লিফটিং পাম্পগুলো নষ্ট থাকায় এ সমস্যা হচ্ছে। পাগলার শোধনাগারে দৈনিক ১ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার পয়োবর্জ্য ধারণের ক্ষমতা থাকলেও মাত্র ৩০ থেকে ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য সেখানে যাচ্ছে।

বৈঠকে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘খালের দায়িত্ব নিয়েই দেখেছি, দূষিত পানি প্রথমে নালা, পরে খালে ও নদীতে মিশে দূষিত করছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবাইকে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন করছি। বাসাবাড়ি থেকেই এটা শুরু করতে হবে। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে পয়োবর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনায় কাজ করা হবে।’

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ‘দায়িত্ব নিয়ে দেখলাম, ঢাকা ওয়াসার কোনো নিজস্ব মহাপরিকল্পনা নেই। তারা “দিন আনি দিন খাই”–এর মতো কাজ করে। ২০১২ সালে মহা পরিকল্পনা করে প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন করা হয়েছে। এখন পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ২০৩০ সাল পর্যন্ত ওয়াসার একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ আছে।’

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিকল্পনা শাখার সদস্য মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, নাগরিকেরা শহরকে পরিষ্কার ও সুস্থ রাখতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করলে শহরে সমস্যা থাকত না।

ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এস এম শরীফ উল ইসলাম বলেন, সমস্যা চিহ্নিতের মাধ্যমে ৫০ ভাগ কাজ হয়। বাকি কাজের জন্য ভালো নেতৃত্ব ও সদিচ্ছা দরকার।

বনানী সোসাইটির চেয়ারম্যান শওকাত আলী ভুইয়া বলেন, কার বাসায় পয়োনিষ্কাশনের সংযোগ আছে আর কার নেই, সেটি খুঁজে বের করে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ কাজে বনানী সোসাইটি সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং আইটিএনের পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, পয়োনালা নির্মাণের মাধ্যমে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান সম্ভব নয়। পয়োবর্জ্য শোধনাগারের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেপটিক ট্যাংকে বর্জ্য সংরক্ষণ, সেখান থেকে অপসারণ ও শোধনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

ব্র্যাকের সংক্রামক ব্যাধি ও ওয়াশ প্রকল্পের পরিচালক আকরামুল ইসলাম বলেন, পয়োবর্জ্যের জন্য সেপটিক ট্যাংক থাকলেও কোথায় বর্জ্য শোধন করা হবে তা অনিশ্চিত।

ইউনিসেফের ওয়াশ অফিসার সৈয়দ আদনান ইবনে হাকিম বলেন, পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের মূল অংশীদার দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন। ঢাকা উত্তর সিটির উদ্যোগ অন্য সিটি করপোরেশনের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করবে। পয়োবর্জ্যের কারণে বাসার ভেতরেই শিশুরা দূষণের শিকার হয়।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহসভাপতি সোহেল রানা বলেন, ভবনে সেপটিক ট্যাংক করলেও পরে এর ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বাসিন্দারা সচেতন ও সতর্ক নয়। রিহ্যাব এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে।

ঢাকা উত্তর সিটির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তারিক বিন ইউসুফ বলেন, পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সম্প্রতি সিটি করপোরেশন নিয়েছে। তবে শুধু সিটি করপোরেশনের পক্ষে কাজটি করা সম্ভব হবে না।

গোলটেবিল বৈঠকে সূচনা বক্তব্য রাখেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখি পয়োবর্জ্য এখনো খাল ও ঝিলে মেশে। এখানে নগরবাসীর সচেতনতার অভাব। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের তদারকিরও অভাব।’

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।