মাদকসেবীদের রোগী হিসেবে দেখুন

মাদকসেবীদের চিকিৎসায় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও কাঠামোগত বাধা দূর করার আহ্বান।

আজিজুল ইসলাম, আহমেদুল কবির, খুরশীদ আলম, হাবিবুর রহমান ও লিমা রহমান
ছবি : প্রথম আলো

মাদকসেবীদের অপরাধী নয়, রোগী হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করলে তাঁদের স্থান হবে কারাগারে। আর রোগী হিসেবে বিবেচনা করলে তাঁদের চিকিৎসা হবে। সুস্থ হলে তাঁদের জীবন নিয়ে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু আইনি কাঠামোতে মাদকসেবীরা অপরাধী হওয়ার কারণে অনেককেই চিকিৎসার বদলে কারাগারে যেতে হয়। কাঠামোগত এমন অনেক বাধা এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মাদকসেবীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। তবে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে কাঠামোগত বাধা দূর করা সম্ভব।

‘বাংলাদেশে মাদক ও এইচআইভি: কাঠামোগত বাধা অপসারণে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইচআইভি/এইডস প্রোগ্রামের সহায়তায় বৈঠকের আয়োজন করে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ ও প্রথম আলো। বৈঠকে বক্তারা বলেন, শিরায় মাদক গ্রহণকারীর একটি বড় অংশ এইচআইভিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। একসময় এইচআইভিতে আক্রান্ত মোট রোগীর প্রায় ২২ শতাংশই ছিলেন শিরায় মাদক গ্রহণকারী। তবে নতুন করে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) আহমেদুল কবিরও মাদক নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত সেল গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। পাশাপাশি তিনি ভাসমান মাদকসেবীদের পুনর্বাসনের কথা বলেন। তিনি বলেন, ভাসমান মাদকাসক্তদের অপরাধী হিসেবে বিবেচনা না করে, মানুষ হিসেবে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসা গেলে ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব হবে।

গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় উঠে এসেছে, মাদকসেবীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে দেশে এখনো গ্রহণযোগ্য গাইডলাইন তৈরি করা সম্ভব হয়নি। দেশে অনুমোদনহীন অনেক মাদক নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি দেশের প্রেক্ষাপটে একটি চিকিৎসাসেবার গাইডলাইন তৈরি করবে।

পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমান বলেন, একজন মাদকসেবী হঠাৎ করে শিরায় মাদক নেন না। ছোট ছোট মাদকে অভ্যস্ত হওয়ার একপর্যায়ে তিনি শিরায় মাদক নেন। প্রাথমিক অবস্থায় যদি এটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে তিনি শিরায় আর মাদক নেবেন না।

গোলটেবিল বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর মো. খুরশীদ আলম বলেন, শিরায় মাদক গ্রহণ করার ফলে যেসব রোগ হচ্ছে, তার চিকিৎসাব্যয় অনেক বেশি। এসব রোগে মৃত্যুর হারও বেশি। এ থেকে উত্তরণে বিভিন্ন সংস্থা এবং কমিউনিটির সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন।

কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চিফ কনসালট্যান্ট শোয়েবুর রেজা চৌধুরী বলেন, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ড থেকে তাঁদের দূরে রাখতে পারি। কিন্তু মাদকসেবীদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হয় না। সমাজ ও পরিবারে তাঁরা অবহেলিত।

দেশের মাদকসংক্রান্ত নীতির পরিবর্তন দরকার জানিয়ে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য পুষ্টি ও এইচআইভি সেক্টরের পরিচালক লিমা রহমান বলেন, আমরা মাদক সেবনকারী বা গ্রহণকারীকে অপরাধী হিসেবে দেখি। কখনোই তাঁদের রোগী হিসেবে দেখা হয় না। তাঁরা যে মানসিক সমস্যায় রয়েছেন, সেটি বিবেচনায় নিই না।

আইসিডিডিআরবির এইচআইভি প্রোগ্রামের সাবেক সিনিয়র সায়েন্টিস্ট তাসনীম আজিম বলেন, ভাসমান মাদকসেবীদের কীভাবে পুনর্বাসন করা যায়, তা চিন্তা করা উচিত।

একসময় এইচআইভিতে আক্রান্ত মোট রোগীর প্রায় ২২ শতাংশই ছিলেন শিরায় মাদক গ্রহণকারী।

এইচআইভি ভাইরাস প্রতিরোধে শিরায় মাদকসেবীদের নিডল সিরিঞ্জ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের মাধ্যমে নিরাপদ সুই ও সিরিঞ্জ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থাকে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি জানিয়ে ইউএন এইডস বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সায়মা খান বলেন, নিডল সিরিঞ্জ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম কিন্তু মাদক নেওয়াকে উৎসাহিত করে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এই প্রোগ্রাম পরিচালনা করে।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থার ন্যাশনাল প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর (ড্রাগস অ্যান্ড এইচআইভি/এইডস) আবু তাহের বলেন, মাদকের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ‘ড্রাগ এডুকেশন’ পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। মাদকসেবীদের বিষয়ে আইন নয়, মানবাধিকারের জায়গা থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিবেচনার ওপর তিনি গুরুত্ব দেন।

কেয়ার বাংলাদেশের হেলথ প্রোগ্রামের পরিচালক ইখতিয়ার উদ্দীন খন্দকার বলেন, যাঁরা ভাসমান মাদকসেবী আছেন, তাঁদের জন্য কী করা যায়, সেটিও ভাবতে হবে।

কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আবাসিক মনোরোগবিদ রাহানুল ইসলাম বলেন, মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য আমাদের এখন প্রয়োজন জাতীয়ভাবে একটি সামগ্রিক গাইডলাইন।

আইসিডিআরবির এইচআইভি ও এইডস প্রোগ্রামের সিনিয়র রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর নিয়াজ মোর্শেদ খান বলেন, ভাসমান মাদকসেবীদের পুনর্বাসন এবং সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে সমাজসেবা অধিদপ্তর উদ্যোগ নিতে পারে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন দ্য গ্লোবাল ফান্ড বাংলাদেশের বিসিসিএম কো–অর্ডিনেটর মনোজ কুমার বিশ্বাস, নেটওয়ার্ক অব পিপল হু ইউজ ড্রাগের প্রেসিডেন্ট সাহেদ ইবনে ওবায়েদ, কেয়ার বাংলাদেশের জিএফ-পিডব্লিউআইডি প্রকল্পের টিম লিডার আখতার জাহান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিপি প্রোগ্রামের সিনিয়র ম্যানেজার মো. আখতারুজ্জামান এবং সেভ দ্য চিলড্রেনের এইচআইভি/ এইডস প্রোগ্রামের সিনিয়র ম্যানেজার ডা. মো. শহিদুল ইসলাম।

গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের এইচআইভি/এইডস প্রোগ্রামের উপদেষ্টা এজাজুল ইসলাম চৌধুরী। বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।